ইউরোপ-আমেরিকার ভিসা পাওয়ার সহজ উপায় ব্লগিং
বাংলাদেশী ব্লগারদের এখন সুসময় (!)। ইউরোপ আমেরিকা যেতে চাইলে নিজেকে ব্লগার প্রমাণ করতে পারলেই হলো। ব্যাস, আর কী। সেই সাথে ইসলামবিদ্বেষী প্রমাণ করতে পারলে হয়তো মিলে যাবে ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশের আশ্রয়। জানা গেছে, ইতিমধ্যে বেশ কিছু ব্লগার ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। আরো শতাধিক ব্লগার বিদেশে আশ্রয়ের চেষ্টা করছেন। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ব্লগারদের সেদেশে আশ্রয়ের কথা জানানো হয়েছে। ইউরোপের জার্মানী এবং সুইডেনতো আগে থেকেই ব্লগারদের আশ্রয় দিচ্ছে। এমনকি একসময় বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে সুইডেনে আশ্রয় পেয়েছিলেন বিতর্কিত ও তথাকথিক নারীবাদী এবং ইসলামবিদ্বেষী লেখিকা তসলিমা নাসরিনও। আর এই সুযোগে ব্লগার পরিচয়ে ইউরোপ আমেরিকায় আদম ব্যবসারও দোকান খুলে বসেছে কিছু আদমবেপারী। ইতিমধ্যে সোমবার ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-মুখপাত্র মার্ক টোনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে হুমকির মুখে থাকা ব্লগার ও ধর্মনিরপেক্ষ অ্যাকটিভিস্টরা যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পেতে আবেদন করতে পারবেন। তিনি বলেছেন, মানবিক প্যারোলের আওতায় তারা আবেদন করতে পারবেন। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় মার্কিন প্রবাসী ব্লগার অভিজিৎ রায় নিহত হবার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির কাছে বাংলাদেশে ইসলামী উগ্রবাদীদের হুমকি রয়েছে জানিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশি ব্লগার বা লেখকদের আশ্রয় দেবার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আবেদন জানায় কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং পেন আমেরিকান সেন্টারের নেতৃত্বে আটটি সংগঠনের একটি জোট। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডারস এবং ফ্রিডম হাউজ এর মতো প্রভাবশালী সংগঠনও ছিল। বিদেশে যাওয়ার এমন সুযোগ পেলে এমন পরিস্থিতি কি হতে পারে যে কেউ ইচ্ছে করে ইসলাম বা নবী মোহাম্মদকে নিয়ে কিছু লিখলো এবং আমেরিকায় আশ্রয় চাইলো? এমন প্রশ্নের জবাবে সংবাদমাধ্যমের সাথে ব্লগার আরিফ জেবতিক বলেছিলেন, অনেকে চেষ্টা করছে। তারা দূতাবাসে ধর্ণা দিয়ে নির্যাতিত ব্লগার বলে পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করছে। পেশাদার আদম ব্যাপারীরা হয়তো বিভিন্ন জায়গা থেকে তরুণকে ব্লগার সাজিয়ে পাঠানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্লগারদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছে না এ অভিযোগ এনে যে যেভাবে পারছেন দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত আলোচিত অন্তত ৩০ জন ব্লগার দেশ ছেড়ে গেছেন বলে জানা গেছে। অচিরেই দেশ ছাড়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন আরও অন্তত ১০-১২ জন। সূত্র বলছে, এরা সবাই ব্রিটেন, জার্মানি, সুইডেন ও আমেরিকায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আরো শতাধিক ব্লগার বিভিন্নভাবে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। ব্লগারদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকেও হুমকিতে থাকা ব্লগারদের সতর্ক থাকার পাশাপাশি ‘আন-অফিশিয়ালি’ বিদেশ চলে যেতে বলা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজীব হায়দার শোভন ওরফে থাবা বাবা নামে একজন ব্লগার নিহত হন। এরপর থেকেই মূলত নিজেকে নাস্তিক প্রমাণের মাধ্যমে ব্লগার সেজে ইউরোপ আমেরিকা যাবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ব্লগাররা বলছেন, একের পর এক ব্লগার হত্যাকা- ঠেকাতে না পারার কারণে অনেকেই নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া ব্লগাররা হলেন- আসিফ মহিউদ্দিন, ওমর ফারুক লুক্স, অনন্য আজাদ, গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক শাম্মী হক, মশিউর রহমান বিপ্লব, রাসেল পারভেজ, সৈকত চৌধুরী, সুব্রত শুভ, ক্যামেলিয়া কামাল, রতন (সন্ন্যাসী), সবাক, কৌশিক, পারভেজ আলম, অমি রহমান পিয়াল, শামীমা মিতু, আজম খান, মাহমুদুল হক মুন্সি ওরফে বাঁধন, তন্ময় প্রমুখ। ব্লগার সূত্র জানায়, ব্লগারদের বেশির ভাগই গত দুই বছরে বেশি দেশ ছেড়েছেন। গত বছর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ব্লগার নিরাপত্তাজিনত কারণে দেশ ছাড়েন। ব্লগার ও লেখক সৈকত চৌধুরী গত বছর দেশ ছেড়ে যান। ড. হুমায়ুন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদ হুমকির কারণে দেশ ছাড়েন গত বছরের ২৯ জুলাই। ব্লগার শাম্মী হক জার্মানিতে চলে যান গত বছরের অক্টোবরে। গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্ব দেয়া মাহমুদুল হক মুন্সী ওরফে বাঁধন ও অমি রহমান পিয়াল দেশ ছাড়েন গত বছরের নভেম্বরে। প্রায় একই সময়ে দেশ ছেড়ে যান সাংবাদিক ও ব্লগার শামীমা মিতুও। ব্লগার সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্লগার ক্যামেলিয়া কামাল, অমি রহমান পিয়াল, সুব্রত শুভ ও আজম খান বর্তমানে সুইডেনে রয়েছেন। পারভেজ আলম রয়েছেন নেদারল্যান্ডসে। শাম্মী হক, অনন্য আজাদ, তন্ময় কর্মকার, আসিফ মহিউদ্দিন ও মাহমুদুল হক মুন্সী ওরফে বাঁধন রয়েছেন জার্মানিতে। সন্ন্যাসী রতন রয়েছেন নরওয়েতে। ব্লগার মনির রয়েছেন ফ্রান্সে। দুর্বৃত্তদের হামলায় আহত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন ব্লগার ও প্রকাশক শুদ্ধশ্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলও সবার অগোচরে দেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান। ব্লগার-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ নাজিমউদ্দিনকে হত্যার পর অনেক ব্লগার বিদেশ যাওয়ার জন্য আবার চেষ্টা শুরু করেছেন। একটি ইউরোপীয় লেখক অধিকার সংরক্ষণ সংগঠনে চারশ’রও বেশি আবেদন জমা হয়েছে শুধু বাংলাদেশ থেকে। কেউ স্বল্পকালীন, কেউ বা দীর্ঘমেয়াদী আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। এদের অনেকেই ব্লগার। অনেকে আবার লেখালেখিই করেন না। কিন্তু ব্লগার হত্যায় কোনও না কোনওভাবে আতঙ্কিত বোধ করছেন বলেই আবেদন করেছেন তারা।
জানা গেছে, ব্রিটেনসহ ইউরোপে ব্লগার পরিচয়ে এসাইলাম আবেদনকারীদের এখন পোয়াবারো মৌসুম চলছে। কোন কালে লেখালেখি, ব্লগিং বা সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও কেবল এসাইলাম পেতে দেশ থেকে আসা স্টুডেন্ট, ভিজিট ভিসায় আসা ব্যাক্তিরাও এখন সাংবাদিক বা ব্লগার পরিচয়ে এসাইলাম সিকারের আসায় আবেদন করছেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। সর্বশেষ জনৈক আলবাব, জুয়েলসহ গত এক মাসে শতাধিক ব্যাক্তি ব্রিটেনে ব্লগার পরিচয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। নিজেদের দেশে নিরাপত্তাহীনতার গল্প সাজাতে এরা আশ্রয় নিচ্ছেন নানা কৌশলের। বাংলাদেশের ব্লগারদের পাশে দাঁড়িয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন। গত বছরের শেষ দিকে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে তাদের সহায়তায় অনুষ্ঠিত হয় এক সংহতি বইমেলা, যেখানে নির্বাসিত বাংলাদেশি ব্লগাররা অংশ নেন। ‘বাংলাদেশ সংহতি বইমেলা’ শিরোনামের আয়োজনটি করে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন দ্য হেগ পিস প্রজেক্ট এবং মুক্তমনা ব্লগ। তাদের সহায়তায় ছিল ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট অ্যান্ড এথিকাল ইউনিয়ন (আইএইচইইউ)। হেগের বিকল্প বইমেলায় অংশ নেবার পর তখন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন জানিয়েছিলেন, কমপক্ষে ২৮ জন ব্লগার দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ পরিবারসহ চলে এসেছেন। এদের অধিকাংশই অবস্থান করছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মহিউদ্দীন বলেন, আরো অন্তত ৪০ জন ব্লগার বাংলাদেশে ভয়ে, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তারাও যে কোনো সময় দেশত্যাগে বাধ্য হতে পারেন। এছাড়া পরিস্থিতি না বদলালে আরো অনেকে বাংলাদেশ ছাড়ার চিন্তা করতে পারেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুবিধালোভী ব্লগারদের অনেকেই বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের আশায় বিদেশের দূতাবাসগুলোতে যোগাযোগ করছেন। এদের অনেকেরই বিদেশে থাকার আবেদন সে দেশের সরকার গ্রহণ করেছে, কারও আবেদন আবার বাতিল করা হয়েছে।