পানামা পেপারস বিতর্কে আবারও স্নায়ুযুদ্ধ?

Panamaসত্যরাজ দাস: মূলত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের পর বিশ্বের কয়েকটি শক্তিধর দেশে আলোচনার ঝড় উঠেছে। ফাঁস হওয়া এ নথিতে ২ লাখের বেশি নামের মধ্যে মাত্র ২১১ মার্কিন নাগরিকের নাম উঠে এসেছে। এত কমসংখ্যক মার্কিনীর নামের তালিকা থাকাটা চমকে যাওয়ার মতোই মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। কারণ এই সংখ্যা বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন ও সুইজারল্যান্ডের নাগরিকদের সংখ্যার তুলনায় তা নগণ্য। যদিও বিশ্লষকদের অনেকেই বিষয় নিয়ে বেশ ভিন্নমতও পোষণ করছেন।
তাদের দাবি, পানামার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে এমন অনেক কোম্পানি, যেখানে অবৈধ অর্থ লুকানো অধিকতর সহজ বলেই মনে হয়। কিন্তু এ নিয়ে বিতর্ক কোন ভাবেই পিছু ছাড়ছে না। বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও বেশ জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ারও সম্ভাবনা দেখাও দিয়েছে। যা বিশ্বের সচেতন মানুষকে কিছুটা হলেও ভাবিয়ে তুলেছে।
পানামা পেপারস ফাঁসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। বিভিন্ন দেশের গোপন নথি ফাঁসকারী প্রতিষ্ঠান উইকিলিকস এর দাবি- এই ফাঁসের পেছনে রয়েছে খোদ যুক্তরাষ্ট্র। তালিকায় কোনও উল্লেখযোগ্য মার্কিনী না থাকার বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়া ফাঁস হওয়া সব তথ্য অনলাইনে প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন উইকিলিকসসহ অনেকেই। তবে ‘স্পর্শকাতর’ তথ্য প্রকাশ হওয়ার আশঙ্কায় সব প্রকাশ করবে না বলে জানিয়েছে আইসিআইজি। বিতর্ক উঠেছে ‘দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা’ নিয়েও।
গত ৬ এপ্রিল টুইটারে উইকিলিকস দাবি করেছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে আক্রমণ করতেই যুক্তরাষ্ট্র এ তথ্য ফাঁস করেছে। উইকিলিকসের দাবি, অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)-ই পানামা পেপারস ফাঁসের ঘটনাটি ঘটিয়েছে। রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে লক্ষ্য করেই এই ফাঁস করা হয়েছে। পুতিনকে লক্ষ্য করে চালানো এ ফাঁসের পেছনে অর্থের যোগান দিয়েছে ইউএসএইড (ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) ও যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের জর্জ সরস। আরেকটি টুইটে উইকিলিকস আইসিআইজির উদ্দেশে বলেছে, যদি ৯৯ শতাংশ তথ্য গোপন রাখা হয় তাহলে সংজ্ঞা অনুসারে আপনারা মাত্র ১ শতাংশ সাংবাদিকতা করছেন।
রাশিয়ান সংবাদমাধ্যম আরটি ডট কমের খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন ধনকুবের জর্জ সরসের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে রাশিয়াতে অবাঞ্ছিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। গত বছর রাশিয়ার প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় সরসের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন এবং ওপেন সোসাইটি ইনস্টিটিউট অ্যাসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশনকে দেশটিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পে রাশিয়ার নাগরিক ও সংস্থার অংশগ্রহণও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
জার্মান সাংবাদিক ও লেখক আর্নেন্ট উলফ জানান, বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন সরকারের। আর সে জন্যই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রভূত সংখ্যক মানুষ তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং আরও প্রচুর অর্থ ট্যাক্স হ্যাভেন যুক্তরাষ্ট্রে আসার পথে। যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা চায় বিশ্বের অর্থ যেন অন্য দেশের ভল্টে না থাকে, সব অর্থ যেন তাদের ভল্টে থাকে।
গত ৪ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজি) জানায়, পুতিনকে আক্রমণ করে পানামা পেপারস ফাঁস করা হয়নি। এর উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিকভাবে যেভাবে বিদেশে কর ফাঁকি দিয়ে গোপনে বিনিয়োগ করা হয় তা প্রকাশ করা। আইসিআইজি প্রধান গেরার্ড রাইল বলেছিলেন, এটা রাশিয়াকে নিয়ে কোনও ঘটনা নয়। এটা গোপনে অন্য দেশে বিনিয়োগের বিষয়।
এসব ফাঁসের ঘটনায় রাশিয়াবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ক্রেমলিনে মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, পুতিনভীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রাশিয়া সম্পর্কে ভালো কিছু অথবা সাফল্য সম্পর্কে বলা এখন অসম্ভব। এখন রাশিয়াকে নিয়ে শুধু নেতিবাচক কথাই বলা যায় যত বেশি ততো ভালো। যখন কিছুই বলার থাকে না তখন কিছু একটা বানিয়ে নিতে হয়।
এদিকে পানামা পেপারসের ঘটনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে মার্কিন বিশেষজ্ঞ ক্লিফর্ড গ্যাডি। তিনি দাবি  করেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের নির্দেশেই ফাঁস হয়েছে বিশ্ব কাঁপানো পানামা পেপারস। এর নথিতে পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহচরদের নাম থাকায় ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু এটি পুতিনের চালাকি। কারণ, তার নিজের অর্থ পাচারের কোনো প্রমাণ নেই। উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকে ক্লিফর্ড গ্যাডি রুশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। পুতিনকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বইও তিনি লিখেছেন।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ওয়েবসাইটে এক নিবন্ধে ক্লিফর্ড গ্যাডি দাবি করেছেন, সহচরদের তুলনায় নিজেকে সৎ প্রমাণ করতে পুতিন পানামা পেপারস ফাঁসে উৎসাহ দিতে পারেন। গ্যাডির আরও একটি বিষয়ও এখানে যোগ করেছেন। তা হলো রুশ সরকারের সমর্থন রয়েছে এমন একজন হ্যাকার প্রথম একটি জার্মান দৈনিকের কাছে নথিগুলি ফাঁস করে। পশ্চিমা মাধ্যমে জোর গুজব ছিল, পুতিন কম করে হলেও ২০ হাজার কোটি ডলারের মালিক। এই বিশাল সম্পদের বেশির ভাগই বিদেশি ব্যাংকে রয়েছে। অথচ পানামা পেপারসে পুতিনের নাম নেই।
পশ্চিমা প-িতেরা এতে অবাক হয়েছেন বটে। তবে পুতিন বলছেন, রুশদের চরিত্রে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে মার্কিনরা এসব নথি ফাঁস করেছে। মজার ব্যাপার হলো, নিজেদের অর্থ বিদেশি ব্যাংকে লুকানোর ব্যাপারে মার্কিনরাই বেশি এগিয়ে বলে দাবি করা হয়। এর প্রমাণ মেলে পানামা পেপারসেও। এসব নথিতে খুব বেশি মার্কিনীর নাম নেই। এর ব্যাখ্যায় গ্যাডি বলেন, খুব সম্ভব পুতিন এগুলোকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করছেন। অনেক মার্কিনের পাচারের তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। এই তথ্য ব্যবহার করেই মার্কিনদের ব্ল্যাকমেল করা হবে।
এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রোগ্রাম বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রুতি শাহ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রেই এমন অর্থের লগ্নি গোপন করে তার মালিককে লুকিয়ে রাখার মতো অনেক কোম্পানি রয়েছে। সেজন্য পানামা বা অন্য কোনো ‘ট্যাক্স হ্যাভেনে’র দ্বারস্থ হতে হবে না। তিনি আরও বলেন, দেশটিতে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, যেখানে এমন অর্থ গোপন করে রাখা যায়। বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গ রাজ্যে এমন প্রতিষ্ঠান অলিগলিতে দৃশ্যমান। ২০১৫ সালের ট্যাক্স লুকোনোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্যাক্স হ্যাভেনের এ তালিকায় প্রথম সুইজারল্যান্ড এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে হংকং। বর্তমানে আলোচিত করস্বর্গের দেশ পানামা এ তালিকায় ১৩তম অবস্থানে রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনশোর কোম্পানিগুলো পরিচালনা করতে রয়েছে বহু শেল কোম্পানি, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির জাল টাকা রাষ্ট্রচক্ষুর আড়ালে রাখা সম্ভব। এগুলোর মধ্যে আটলান্টিক স্টেট দেলাওয়ার, ওইয়োমিং ও নেভাদায় সবচেয়ে বেশি। এ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এ রাজ্য তিনটিকে ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ অঙ্গরাজ্য বলা যেতে পারে। শেল কোম্পানি ঘরে-বাইরে সবখানেই তৈরি করা সম্ভব।
লুইজিয়ানার সাবেক কংগ্রেসম্যান উইলিয়াম জেফারসন ৮টি শেল কোম্পানি খুলে ঘুষের হাজার হাজার ডলার লুপ্ত করে রেখেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির পাবলিক লাইব্রেরির কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তাহলে তা পুনরায় চালু করতে গাড়ির লাইসেন্স বা ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ডের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু যদি কেউ শেল কোম্পানির একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে চায়, তাহলে তার জন্য এত কাঠখড় পোড়ানোর কোনো দরকার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট ডিভিশন ওয়েবসাইটের দাবি, দেশটির ব্যবসায়িক পলিসিতে শেল কোম্পানির অ্যাকাউন্ট খোলা কোনো অপরাধমূলক কাজ নয়। শুধু দেলওয়ারেই রয়েছে ১০ লাখেরও অধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সংযুক্ততা।
যুক্তরাষ্ট্রের ৬৪ শতাংশ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দেলওয়ারকেই ‘সেফহোম’ হিসেবে গ্রহণ করে। তবে দেলওয়ারকে ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ মানতে নারাজ ইউনিভার্সিটি অব দেলাওয়ারের জন এল ওয়েনবার্গ সেন্টারের পরিচালক চার্লস নেলসন। তিনি বলেন, দেলওয়ার এমন একটি স্থান যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থের পরামর্শ নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা জড়ো হন। তবে এখানে অনেক কোম্পানি অবৈধ অর্থের পাহাড় নিয়ে হাজির হয় সত্যি কিন্তু সবই বেআইনি নয় বলে জানান নেলসন। এদিকে বিশ্লেষকদের দাবি, পানামা কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর বেলিজ, পানামা ও সাইমান দ্বীপে থাকা অবৈধ এসব অর্থ মোড় নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে।
মূলত বহুল আলোচিত পানামা পেপারসে অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস করার পর নড়েচড়ে উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ এসব ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। কারো কারো পদত্যাগ করারও দাবি উঠেছে। সম্প্রতি মোসাক ফনসেকা নামের পানামার একটি আইনী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ফাঁস হওয়া নথিতে ১৪০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ শতাধিক ক্ষমতাধর মানুষ বা তাদের নিকটাত্মীয়দের বিদেশে টাকা পাচার করার তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্বের যেসব প্রতিষ্ঠান গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বিখ্যাত, মোসাক ফনসেকা সেগুলোর একটি। পানামার এ প্রতিষ্ঠানের অজস্র নথি ফাঁসের এ ঘটনা ‘পানামা পেপারস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এ বিষয়টি ‘টক অব দ্য আর্থ’ এ পরিণত হয়েছে। এতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন ব্যক্তির নাম না আসলেও মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। বাংলাদেশের মানুষ গণমাধ্যমের ওপর তীক্ষè নজর রাখছেন।
অজানা সূত্র থেকে মোসাক ফনসেকার ওই ১ কোটি ১৫ লাখ নথি জার্মান দৈনিক জিটডয়েচ সাইতংয়ের হাতে আসে। পত্রিকাটি সেসব নথি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসকে (আইসিআইজে) দেয়। ১৯৭৭ থেকে ২০১৫, প্রায় ৪০ বছরের এসব নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার কিছু অংশ আইসিআইজে প্রকাশ করে। আগামী মে মাসে আরও নথি প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি।
২০০৮ সালে আইসল্যান্ডের ব্যাংক ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে, তখন দেশটির এই প্রধানমন্ত্রী গোপনে কোটি কোটি ডলারের ব্যাংক বন্ডের মালিক হয়েছেন। মোসাক ফনসেকার সম্পদশালী ৮০০ মক্কেলের বিষয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে। স্পেনের বিচার বিভাগীয় সূত্র জানায়, স্পেন এরই মধ্যে আইনী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ পাচার-বিষয়ক তদন্ত শুরু হয়েছে।
কেলেঙ্কারির ঘটনার কারণে আলোচিত পানামাও বিষয়গুলো তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে এবং আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে, আর তা প্রমাণিত হয়, তাহলে পুরস্কৃত করা হবে। পানামার প্রেসিডেন্ট জুয়ান কার্লোস বলেছেন, আন্তর্জাতিক তদন্তে পানামা সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে তিনি দেশের ভাবমর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতিও দেন।
বিশ্ব ফুটবলের তারকা লিওনেল মেসি ও তার বাবার নাম আছে এ তালিকায়। নথি অনুযায়ী, বাবা-ছেলে মিলে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মেগা স্টার এন্টারপ্রাইজের নামে অর্থ পাচার করেছেন। এখন স্পেনে কর ফাঁকি দেয়ার একটি অভিযোগ আছে মেসির বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা ও অবমাননাকর।
তালিকায় এসেছে রাশিয়ার শক্তিধর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বন্ধু সের্গেই রোলদুগিনের নামও। তার বিরুদ্ধে ২০০ কোটির বেশি ডলার পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ দাবি করেন, তথ্য ফাঁসকারী সাংবাদিকেরা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পুতিন, রাশিয়া, আমাদের দেশ, আমাদের স্থিতিশীলতা ও আসন্ন নির্বাচনকে লক্ষ্য করে এসব খবর রটানো হচ্ছে; বিশেষ করে পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে।
তালিকায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কোর নাম থাকলেও তিনি কোনো ভুল করেননি বলে দাবি জানান। তবে তাকে অভিশংসনের মুখে পড়তে হতে পারে। এছাড়া লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে ১৯৮৩ সালে চার কোটি ডলার মূল্যের ব্রিটিশ সোনা-রুপার বার ডাকাতির ঘটনায় লাখ লাখ ডলার ফাঁকি দেয়ার বিষয়ে পানামার একটি শেল কোম্পানি সহায়তা করেছে। পানামার একটি আইনী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা রামোন ফনসেকা আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, নথি ফাঁস হওয়া ‘একটি গুরুতর অপরাধ’ এবং ‘পানামার ওপর হামলা’।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন ক্ষমতাধর ও  তাদের স্বজনরা। পানামা পেপারসের মাধ্যমে কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের বিশাল যে ঘটনা ফাঁস হয়েছে, তাতে নাম এসেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ক্ষমতাধর ও ধনাঢ্য ব্যক্তি বা তাদের আত্মীয়স্বজনের। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে আরো আছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের তিন সন্তান, অমিতাভ-ঐশ্বরিয়াসহ ভারতের শিল্পপতি ও চলচ্চিত্র তারকা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ বহু ব্যক্তির নাম। এ ছাড়াও নথিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাতারের সাবেক আমির শেখ হামাদ আল থানি, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, লিবিয়ার সাবেক (মরহুম) নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নাম এসেছে।
ফাঁস হওয়া নথিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনজন মরিয়ম, হাসান ও হোসেনের নাম এসেছে। নথি বলছে, নওয়াজের সন্তানেরা মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে পরিচালিত বিভিন্ন অফশোর কোম্পানির মালিকানার অংশীদার। এর মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসভিত্তিক তিনটি প্রতিষ্ঠান। তবে নওয়াজ পরিবারের দাবি, তারা অন্যায় কিছু করেনি। নওয়াজের ছেলে হোসেন নওয়াজ শরিফ দেশটির জিয়ো টিভিকে বলেন, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশের আইন মেনেই সবকিছু করা হয়েছে। এসব আইনে অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে অযথা কর এড়ানোর বিষয়টি একটি  বৈধ উপায়।
ফাঁস হওয়া নথি মোতাবেক চীনা প্রেসিডেন্টসহ দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান ও সাবেক অন্তত আটজন শীর্ষ নেতার পরিবার নিজেদের সম্পদের তথ্য গোপন করতে বিভিন্ন কর রেয়াত অঞ্চলকে ব্যবহার করেছে। নথিতে নাম থাকা ব্যক্তিদের একজন জিনপিংয়ের শ্যালক দেং জিয়াগুই। নথিতে চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি পেংয়ের মেয়ে লি জিয়াওলিনের নামও রয়েছে।
পানামা পেপারস অনুযায়ী, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের প্রয়াত বাবা ইয়ান ক্যামেরনও মোসাক ফনসেকার সেবা নিয়েছিলেন। তার রেখে যাওয়া ২৭ লাখ পাউন্ডের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে ক্যামেরন পেয়েছেন তিন লাখ পাউন্ড। তবে তিনি এ জন্য কর শোধ করেননি, এমন কোনো ইঙ্গিত নথিতে নেই। নথি মোতাবেক মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ছেলে নাজিফুদ্দিন নাজিব মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে দুটি অফশোর কোম্পানি গড়ে তুলেছেন।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের ঘটনায় বিতর্কটা বেশ জমে উঠেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে দোষারোপ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রুশ-মার্কিন সম্পর্কটা বেশ ভাল যাচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহে আগে পরমাণু অস্ত্রের নিরাপত্তা বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে রুশ-মার্কিন তিক্ততা নতুন করে শুরু হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এ তিক্ততাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের মাধ্যমে। এক ঘটনা বিশ্বের বৃহৎ শক্তির দু’টি রাষ্ট্রকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যা নতুন করে শীতল যুদ্ধের সূচনা করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে সত্যটা প্রকাশিত হোক এটাই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button