ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত ইশতেহার
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ১৪-১৫ এপ্রিল ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ১৩তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিশেষ করে দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের দুর্দশা, নির্যাতন, বঞ্চনা নিয়ে তারা ব্যাপক আলোচনা করেন। সম্মেলন শেষে নেতৃবৃন্দ ২১৮ দফার ইশতেহার প্রকাশ করেন। এখানে ইশতেহারের গুরুত্বপূর্ণ দফাগুলো তুলে ধরেছেন মোহাম্মদ হাসান শরীফ
* সম্মেলনে ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আল কুদস শরিফকে রাজধানী করে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়। এতে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার কথা আবারো দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করা হয়।
* ফিলিস্তিনি জনগণকে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা দেয়া, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো এবং সংশ্লিষ্ট জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব ও আরব শান্তি উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য অবিলম্বে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আয়োজনের আহ্বান জানানো হয়।
* এতে আল আকসা মসজিদসহ পবিত্র স্থাপনাগুলো ইসরাইলিদের অবমাননার নিন্দা জানানো হয়।
* ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বৈধ সব উপায়ে নিজস্ব ভূখণ্ড রক্ষার লড়াইয়ে লেবাননের প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করে ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন।
* সম্মেলন আজারবাইজানের বিরুদ্ধে আর্মেনিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানায়। জাতিসঙ্ঘ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আজারবাইজানি ভূমি দখল করার জন্য আর্মেনিয়ার শক্তি প্রয়োগেরও সমালোচনা করা হয়। অবিলম্বে আজারবাইজান এলাকা থেকে নিঃশর্তভাবে আর্মেনিয়ার সব সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয় সম্মেলনে। এ ছাড়া নাগার্নো-কারাবাখ এবং দখল করা অন্যান্য অঞ্চলও আজারবাইজানের কাছে ফেরত দেয়ার দাবি জানানো হয়। সম্মেলন জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে আজারবাইজানকে সমর্থন করার প্রতিশ্র“তিও দেয়া হয়।
* সম্মেলন আফগান ঐক্য সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ওআইসি সদস্য রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সরকারের প্রতি সহায়তা ও সমর্থন প্রদানের আহ্বান জানায় সম্মেলন। এ ছাড়া সন্ত্রাস দমন, মাদক পাচার রোধ, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা অর্জনে সাহায্য করার জন্যও সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
* আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সম্মেলন ‘হার্ট অব এশিয়া-ইস্তাম্বুল প্রসেসের’ প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। তা ছাড়া কাবুল সরকারের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য আফগানিস্তান, চীন, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত চার-জাতি সমন্বয় গ্র“পের প্রতিও সমর্থন প্রকাশ করা হয়।
* সম্মেলন জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের অধিকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বাস্তবায়নের প্রতি সমর্থন আবারো ঘোষণা করা হয়। এতে আরো বলা হয়, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার বিরোধের মূল বিষয় হলো জম্মু ও কাশ্মির। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এটাই প্রধান ইস্যু।
* সম্মেলনে কাশ্মির প্রশ্নে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ৬৮ বছর আগে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের কাছে তাদের দেয়া প্রতিশ্র“তির কথা আবারো তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়।
* জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক হারে মানবাধিকার লঙ্ঘনেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় বাহিনীর হাতে নারী, পুরুষ, শিশুসহ শত শত নিরীহ মানুষের প্রাণহানির সমালোচনা করা হয় এতে। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অতিসম্প্রতি গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় শায়েস্তা হামিদ নামে ২২ বছর বয়সের এক নারীকে হত্যা করার কথাও বলা হয়েছে।
* তুর্কি সিপ্রিয়ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুসলিম তুর্কি সিপ্রিয়টদের বৈধ অধিকারের প্রতি সম্মেলন পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
* সম্মেলন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা জনগণের সরকারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। দেশটি এবং এর জনগণের আরো সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয় এতে।
* সম্মেলন কসোভোর জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে। জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবের আলোকে স্বাধীন কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
* সম্মেলন ইসলামি রাষ্ট্রগুলো এবং ইরানের মধ্যে সুপ্রতিবেশী, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, স্বাধীন ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়।
* সম্মেলন ইরানের তেহরান ও মোসাদে সৌদি মিশনে আগ্রাসন চালানোর নিন্দা করা হয়। এটা কূটনৈতিক-বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন বলেও অভিহিত করা হয়।
* সৌদি আরবের বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ইরানের উসকানিমূলক বিবৃতির নিন্দা করা হয়। বাহরাইন, ইয়েমেন, সিরিয়া ও সোমালিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইরানের হস্তক্ষেপে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
* মালিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলজিয়ার্স চুক্তির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করা হয়।
* সোমালিয়ায় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
* আইভরি কোস্ট, গিনি ও বারকিনা ফাসো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
* জিবুতি, ইরিত্রিয়া সমস্যা সমাধানে কাতারের আমিরের ভূমিকাকে স্বাগত জানানো হয়।
* সিরিয়ায় অব্যাহত সহিংসতা ও রক্তপাতে সম্মেলন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। সিরিয়ার ঐক্য, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা সুরক্ষার প্রতি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। জেনেভা ইশতেহারের আলোকে সিরিয়া সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানানো হয়। সিরিয়াকে একটি বহুত্ববাদী, অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও নাগরিকভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়।
* সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানানোর জন্য বিশেষভাবে মিসর, জর্ডান, লেবানন, ইরাক ও তুরস্ককে ধন্যবাদ জানানো হয়।
* সম্মেলনে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবের ভিত্তিতে লিবিয়ায় সঙ্ঘাত অবসানের আহ্বান জানানো হয়। দেশটিতে যেকোনো ধরনের সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়।
* ইরারেক রাজনৈতিক ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা অর্জনের প্রতি সমর্থন দেয়া হয়।
* সম্মেলনে ইসলামি স্টেটের (দায়েশ) নৃশংসতার নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়।
* সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট আবদু রাবু মনসুর হাদির নেতৃত্বাধীন ইয়েমেনি সরকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করা হয়।
* অর্থনৈতিক সমস্যা কাটানোর জন্য সুদানের প্রয়াসের প্রতি সম্মেলন সমর্থন প্রকাশ করে।
* ওআইসি সম্মেলনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি অব্যাহত বৈষম্যের অবসান এবং তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নাগরিক অধিকার প্রদানের আহ্বান জানানো হয়। এতে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আবারো আহ্বান জানানো হয়। রোহিঙ্গা মুসলমানদের কাছে যাতে সহজে ত্রাণসহায়তা পৌঁছতে পারে, সে সুযোগ দেয়ার জন্যও মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
* সম্মেলন মরো মুসলিমদের প্রতি দেয়া ফিলিপাইন সরকারের প্রতিশ্র“তি পূরণের আহ্বান জানানো হয়। সই করা শান্তিচুক্তি লঙ্ঘন প্রয়াসের বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
* দক্ষিণ থাইল্যান্ডের মুসলিমদের অবস্থায় সম্মেলন উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংলাপের মাধ্যমে ওই এলাকার মুসলমানদের দুর্দশা অবসানের আহ্বান জানানো হয় থাই সরকারের প্রতি।
* ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিমদের মর্যাদা, নিরাপত্তাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে সম্মেলন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়।
* সম্মেলন আগামী দশকের জন্য ‘ওআইসি-২০২৫ : প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন’ গ্রহণ করে। এটা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ওআইসির সদস্য রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
* সম্মেলনে ওআইসি দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৩ সালের ১৮.৬৪ শতাংশ থেকে ২০১৪ সালে ওআইসি দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯.৩৩ শতাংশ।
* আইইউটি-এ ছাত্রী ভর্তি অনুমোদন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সম্মেলন বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে।
* সম্মেলনে মুসলিমদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন দেশে বিদেশীভীতি, সহিংস চরমপন্থা অবলম্বন, বৈষম্য প্রদর্শন, বর্ণবাদী আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এসব সমস্যা সমাধানে সম্মেলন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানায়।
* সম্মেলন কাতারে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন নিয়ে পাশ্চাত্য মিডিয়ার বৈষম্যমূলক কভারেজের সমালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, পাশ্চাত্য মিডিয়াগুলো কাতারবিরোধী নানা ধরনের কাল্পনিক, মিথ্যা, অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে যাচ্ছে। সম্মেলন ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনে কাতারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন আবারো ব্যক্ত করে। এতে মুসলিম দেশ ও মিডিয়াকে কাতারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করার আহ্বান জানানো হয়।
* সম্মেলনে ফিলিস্তিন, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা, মিয়ানমার এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সদস্য রাষ্ট্র, দাতা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিওগুলোর প্রতি সহায়তার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয় এতে।
* সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী ওআইসি শীর্ষ সম্মেলন হবে গাম্বিয়ায়। তবে আলোচনাসাপেক্ষে তারিখ পরে নির্ধারণ করা হবে।