৭ বছরে ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি : সুজন
গত দেড় দশকে ব্যাংকিং খাতে ৯টি বড় ধরণের আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। আর গত ৭ বছরে ঘটা ৬টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ।
বৃহস্পতিবার দুপরে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় করণীয় শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে তিনি একথা জানান।
তিনি বলেন, বেশ কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে চলেছে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম বাধা। এ নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আস্থাহীনতা ও উৎকণ্ঠা।
বখতিয়ার আহমেদ বলেন, নিকট অতীতে পুজিবাজার, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারির সাথে সাম্প্রতিক যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনা। ভবিষ্যতে এ সকল ঘটনা উত্তরণে এবং ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ খাতের বিদ্যমান সমস্যা গুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
তিনি প্রবন্ধের শুরুতে ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান কিছু সমস্যা তুলে ধরেন। সমস্যাগুলো হলো- ১. বিনিয়োগ না বাড়ায় ব্যাংকগুলোতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত পড়ে থাকা, ২.ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিচ্ছে তা আদায় করতে না পারা, কিংবা কাকে ঋণ দেয়া হবে তা নিয়ে সংকট তৈরি হওয়া, ৩. ব্যাংকিং খাতের নানা অনিয়ম ও জালিয়াতি, ৪. ব্যাংকগুলোর কেবল লাভের পেছনে ছোটা, ৫. বিপুল অঙ্কের খেলাপি ও মন্দ ঋণ, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে, ৬. ব্যাংকগুলোর আইটি সিস্টেম সুরক্ষিত না থাকা, ৭. মূলধন ঘাটতি, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে, ৮. আমানত সংগ্রহে অসম প্রতিযোগিতা, ৯. ব্যবস্থাপনার সংকট, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর, ১০. সরকারি এবং বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে পরিচালকদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, ১১. বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সিবিএ নেতাদের দৌরাত্ম্য।
সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জনাব মির্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক আবু আহমেদ, সুজন নির্বাহী সদস্য জনাব আলী ইমাম মজুমদার ও ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. সাজ্জাদ জহির, জনাব নুরুল হক মজুমদার, আব্দুল্লাহ ক্বাফী রতন প্রমুখ।
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এ খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। কি কারণে আজ এ অবস্থা তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। দলীয়করণ ও রাজনীতি ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক এর কর্তৃত্ব ও নজরদারি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আছে কি না সে বিষয় নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেন।’
মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা যে কম আছে তা নয়, ক্ষমতা যতটুকু আছে তার কতটুকু প্রয়োগ করছে তা বিবেচ্য বিষয়। ক্ষমতার প্রয়োগের জন্য যথাযথ ও যোগ্য লোক নিয়োগ প্রদান করতে হবে। তিনি ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অডিট নিয়মিত করা, ব্যাংকগুলো যাতে বড় ধরণের ঝুকির মধ্যে না পড়ে সেদিকে নজর রাখা, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কাকে ঋণ প্রদান করা হবে সেটি বিবেচনায় আনা, ঋণ আবেদনকারীর তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।’
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এর নীতিমালা যা আছে তা আর্ন্তজাতিক মানের কিন্তু নিয়ম/নীতিমালা আমাদেরকে পালন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে অন্যান্য ব্যাংকসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আবার বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, একটা ভারসাম্য রাখতে হবে। এছাড়াও সৎ, যোগ্য ও দক্ষ মানুষকে নিয়োগ প্রদান করতে হবে। আর্থিক খাতের অনিয়মের জন্য বিচার করতে হবে তাহলে বারবার এরকম দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।’
তিনি আরো বলেন, ‘আর্থিক খাতের মত একটি খাতে যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয় তাহলে তা ধ্বংস হতে বাধ্য। তিনি ঋণ প্রদান কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, সবমসময় টাকাওয়ালাদের ঋণ প্রদান করা হয়। কিন্তু তা না করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও মহিলাদের ঋণ প্রদান করা যেতে পারে।’
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের আর্থিক খাতে বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে, আর এ অবস্থা চলতে থাকলে রিজার্ভের টাকা চুরি, বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক ও পুঁজি বাজার কেলেঙ্কারীর মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।’
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অযাচিত সব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দু:খ প্রকাশ করে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এর রিজার্ভ চুরির ঘটনা অতীতে কখনো ঘটেনি, অন্যান্য দেশেও এরকম ঘটেছে বলে আমার অন্তত জনা নেই। আর্থিক খাতের দুর্নীতিরোধে যাদের দায়িত্ব রয়েছে তাদের অনেকেই দুর্নীতির সাথে জড়িত বলে তিনি মন্তব্য করেন। ব্যাংকিং খাতের এ হতাশাজনক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নতুন গর্ভনর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যাক্ত করেন।
ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকিং খাতে বা আর্থিক খাতে না সকল খাতেই বিচারহীনতা বিরাজ করছে। অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি বিরাজ করছে। তবে আশার কথা যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির বিষয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে তারা যথাসময়ে তাদের প্রতিবেদন পেশ করেছে।
ড. সাজ্জাদ জহির বলেন, অর্থখাতের যে পরিবর্তনগুলো সারা বিশ্বব্যাপী ঘটছে তার সাথে সঙ্গতি রেখে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। আমাদের সেই দক্ষ জনবল নেই যারা প্রযুক্তির ওপর প্রভাব রাখে। প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে যে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন তা করা হচ্ছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।