ফেসবুক লাইভ
১০০ কোটিরও বেশি মানুষ আছে ফেসবুকে। তাদের জন্যই চালু হলো সরাসরি ভিডিও দেখা ও দেখানোর সুবিধা ‘ফেসবুক লাইভ’। এখন যে কেউ মোবাইল দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি প্রচার করতে পারবে। বিশ্বের যেকোনো জায়গায় থেকে দেখতে পারবে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। লিখেছেন আহমেদ ইফতেখার
সরাসরি ভিডিও সম্প্রচার সেবা ‘ফেসবুক লাইভ’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালে। চলতি মাসে এতে যুক্ত হয় নতুন কিছু সুবিধা। যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাপী সম্প্রচারিত ভিডিওর ম্যাপ এবং অন্য প্ল্যাটফর্মেও ভিডিও সম্প্রচার সুবিধার বর্ধিত অনুসন্ধান এবং ফিল্টার। ফেসবুক মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রামের মতো এখানেও থাকছে ভিডিওকে সাদা-কালো ছবিতে রূপান্তর করার সুবিধা এবং অতিসত্বর স্ন্যাপচ্যাটের মতো এখানেও ব্যবহারকারীরা ডুডল যোগ করার সুবিধা পাবেন। গত ৬ এপ্রিল থেকে সরাসরি ভিডিও সম্প্রচার সেবা ‘ফেসবুক লাইভ’-এর পরিসর বৃদ্ধি করেছে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের তাৎক্ষণিক অনুসন্ধান এবং মন্তব্য করার জন্য নতুন সুবিধা যোগ করল ফেসবুক, আর সব ব্যবহারকারী নিজেদের স্মার্টফোনের অ্যাপ থেকেই এখন তারা সরাসরি ভিডিও সম্প্রচার করতে পারবেন।
ফেসবুক লাইভ এখন পর্যন্ত ফেসবুকের নেয়া সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ বলে জানিয়েছে রয়টার্স। এর আগে এ ধরনের সুবিধা দিয়ে আসছিল টুইটারের পেরিস্কোপ লাইভ-স্ট্রিমিং সেবা, স্ন্যাপচ্যাটের ভিডিও ফিচার এবং অ্যালফাবেটসের ইউটিউব। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে এগুলোর পাশাপাশি টেলিভিশনেরও সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল ফেসবুক।
সামাজিক যোগাযোগ ক্ষেত্রগুলোতে সরাসরি ভিডিও সম্প্রচার দিন দিন বেশ প্রতিযোগিতামূলক একটি সেবা হয়ে উঠছে। গুরুত্বপূর্ণ খেলা বা অস্কার, গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড শোর মতো বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচার করা প্রতিষ্ঠানগুলোও রয়েছে এ প্রতিযোগিতায়।
ফেসবুক লাইভের প্রধান ক্রিস কক্স ৬ এপ্রিল উপস্থাপক হিসেবে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে এই সেবাটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এটি ব্যবহার করে ‘সন্তানের প্রথম হাঁটা’র মতো একান্ত পারিবারিক মুহূর্ত থেকে শুরু করে বিখ্যাত ব্যক্তি উপস্থাপিত অনুষ্ঠান এবং তাৎক্ষণিক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, সবই প্রচারিত হবে ফেসবুক আশা করছে বলে তিনি জানান। ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে ফেসবুক লাইভ উন্মুক্ত করার অনুষ্ঠানে ফেসবুকের সেবাগুলোর ভাইস প্রেসিডেন্ট উইল ক্যাথকার্ট রয়টার্সকে জানান, প্রতিষ্ঠানটি ফেসবুক লাইভ দ্রুত উন্মুক্ত করার জন্য কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রচারের জন্য ভিডিও সরবরাহ করতে অর্থ প্রদান করেছে।
প্রায় ৬০টি দেশে অ্যাড্রয়েড এবং আইওসে ফেসবুক অ্যাপেই লাইভের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ জানুয়ারিতে বিনিয়োগকারীদের জানান, প্রতিদিন ৫০ কোটি মানুষ ফেসবুকে ভিডিও দেখে।
অ্যান্ড্রয়েডে ফেসবুক লাইভ
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকেই ফেসবুক ঘোষণা দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিভিন্ন দেশেও তাদের লাইভ স্ট্রিমিং ফিচারটি পৌঁছে গেছে। প্রথমে ফিচারটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সেলিব্রিটিদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পর নির্দিষ্ট কিছু আইওএস ব্যবহারকারীও সুযোগ পায় ফেসবুকে লাইভ স্ট্রিমিং করার। এবার বিশ্বের এই সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ঘোষণা দিয়েছে শুধু আইওএস নয়, অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরাও উপভোগ করতে পারছে ফিচারটি।
বর্তমানে ব্যক্তিগত প্রোফাইল ছাড়াও পেজগুলো থেকেও পাওয়া যাচ্ছে লাইভ স্ট্রিমিং ফিচারটি। আপনার অনন্ড্রয়েডে মোবাইলে লাইভ স্ট্রিমিং ফিচারটি পৌঁছে গেছে কিনা, তা দেখার জন্য ব্যবহারকারীদের ফেসবুক অ্যাপের নিউজ ফিডের ওপরে আপডেট স্ট্যাটাসে চাপ দিতে হবে। যদি কোনো ব্যবহারকারীর ফোনে ফিচারটি পৌঁছে যায় তাহলে একটি ভিডিও আইকন দেখা যাবে।
ফেসবুকের এই লাইভ ভিডিও অনেকটা টুইটারের পেরিস্কোপের মতোই কাজ করে। ব্যবহারকারীরা এরপরও লাইভ ভিডিও স্ট্রিম করতে পারবেন ইচ্ছে মতো এবং দর্শকরা সেই স্ট্রিমিং উপভোগের সাথে সাথে লাইক ও কমেন্টও করতে পারবেন। লাইক-কমেন্টের সাথে সাথে কতজন ভিডিও স্ট্রিমিংটি দেখেছেন, সে সংখ্যাটিও জানাবে ফেসবুক।
নতুন এই আপডেটের ফলে শুধু ব্যক্তিবিশেষের জন্য এই সুবিধা সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং বিভিন্ন গ্রুপ কিংবা ইভেন্টেও ব্যবহার করা যাবে ফেসবুক লাইভ। শুরুতে শুধু ভেরিফাইড ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে সরাসরি বিভিন্ন ভিডিও সম্প্রচার করা যেত। এখন যেকোনো ফেসবুক ব্যবহারকারী তার পছন্দের মুহূর্তগুলো সরাসরি প্রচার করতে পারবেন তার বন্ধুদের সাথে। লাইভ ভিডিওর সাথে সাথে লাইভ রিঅ্যাকশন নিয়েও কাজ করছে ফেসবুক। এখন থেকে খুব সহজেই ভিডিও সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়ার সময় বিভিন্ন রিঅ্যাকশন জানানো যাবে। কিছু দিন আগেই সব পোস্টের সাথে রিঅ্যাকশন ফিচার চালু করেছে ফেসবুক। ফলে শুধু লাইক কিংবা কমেন্ট নয়, এখন নিজেদের অনুভূতি আরো নির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারছেন ব্যবহারকারীরা।
ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, লাইভ ফিচার অনেকটা টিভি ক্যামেরা নিজের পকেটে রাখার মতো। ফোন হাতে যেকোনো মানুষ এখন পৃথিবীর যেকোনো মানুষের কাছে নিজেকে সম্প্রচার করতে পারবে।
লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং
লাইভ ভিডিও ধারণ করার জন্য ‘ব্রডকাস্ট নাউ!’ নামে আপনি কোনো বড় অপশন ফেসবুকে পাবেন না। তবে স্ট্যাটাস আইকনের মধ্যেই রয়েছে লাইভ স্ট্রিমিং ভিডিও অপশন। চেক ইন আইকনের পাশেই আপনি নতুন একটি আইকন পাবেন। আপনি যদি সম্প্রতি কোনো স্ট্যাটাস না দিয়ে থাকেন তবে আপনি ভাসমানভাবে একটি নটিফিকেশন দেখবেন চেক ইন আইকনের ওপরে। যেখানে লেখা থাকবে, ‘নিউ! রেকর্ড অ্যান্ড শেয়ার লাইভ ভিডিও।’
আপনি যদি লাইভ ভিডিও ধারণ এবং সম্প্রচারের জন্য প্রস্তুত থাকেন তাহলে আইকনটি সিলেক্ট করুন এবং ফেসবুক কে অনুমতি দিন আপনার ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন প্রবেশ করার। ব্যস! আপনার কাজ শেষ।
তারপর যখন আপনি নীল রঙের ‘কন্টিনিউ’ বাটনটিতে টাচ করবেন, আপনাকে আপনার ব্রডকাস্ট সম্পর্কে বর্ণনা করার জন্য জিজ্ঞেস করবে। একই স্ক্রিনে আপনি আপনার ভিডিওর প্রাইভেসি নির্ধারণ করতে পারবেন। আপনি কি আপনার বন্ধুদের সাথেই ভিডিও শেয়ার করতে চান নাকি সবার সাথে শেয়ার করতে চান তা নির্ধারণ করতে পারবেন ভিডিও প্রাইভেসিতে। এমনকি আপনি ভিডিওটি শুধু আপনি দেখার জন্যও অপশন নির্ধারণ করতে পারবেন।
লাইভ স্ট্রিমিং ভিডিও আপনি আপনার সেলফি অথবা রিয়ার যেকোনো ক্যামেরা দিয়েই ধারণ করতে পারবেন। প্রোট্রেট বা ল্যান্ডস্কেপ যেভাবেই ভিডিও ধারণ করেন না কেন, ভিডিও সব সময় স্কয়ার স্ক্রিনেই শো করবে। আপনি যদি প্রোট্রেটে ভিডিও ধারণ করেন, তাহলে ফেসবুক কমেন্টের অপশন থাকবে ভিডিওর নিচে। ল্যান্ডস্কেপ মোডে কমেন্টের অপশন থাকবে ডান পাশে।
যখন থেকে আপনি লাইভে যাবেন, তখন থেকেই ভিডিও ফিড আপনার টাইমলাইনে দেখা যাবে। ব্রডকাস্ট স্ক্রিনে আপনি দেখতে পাবেন কতজন দর্শনার্থী ভিডিওটি দেখছে, আপনি কতক্ষণ রেকর্ডিং করছেন এবং এমনকি লাইভ কমেন্টও। মজার ব্যাপার হলো ভিডিও ধারণ করার সময় আপনার কোনো টাইম লিমিট নেই।
টিভির বিকল্প ফেসবুক লাইভ!
১০০ কোটিরও বেশি মানুষ আছে ফেসবুকে। এসব মানুষ বিশ্বের যেকোনো জায়গায় থেকে দেখতে পারবে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। বিষয়টি টেলিভিশন মিডিয়ার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
কোথাও একটা ঘটনা ঘটছে আর সেটার লাইভ ভিডিও চলে এলো ফেসবুকের ওয়ালে। তখন কি আর আপনি টিভি খুলবেন? নাকি ঘটনাস্থল থেকে পাঠানো বন্ধুদের লাইভ ভিডিও দেখবেন? এমনিতেই ফেসবুকের নিউজ ফিডের জন্য সরাসরি টিভির খবরে তাকাচ্ছে বা সরাসরি খবরের সাইটে ঢুকছে কম। ফেসবুকে যুক্ত থাকলে ‘নিউজফিড’-এ আপনাতেই চলে আসে খবর। ভিডিওর ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও সদ্য কাটিয়ে উঠেছে সে সমস্যাও।
মার্ক জুকারবার্গ তো টেলিভিশন মিডিয়াকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমরা আসছি লাইভ ভিডিও নিয়ে।’ একটি ঘটনার পর টেলিভিশন আপনাকে যেভাবে দেখায় আপনাকে সেভাবেই দেখতে হয়। কিন্তু ফেসবুক লাইভে ঘটনার পর অসংখ্য ব্যবহারকারীর প্রোফাইল থেকে লাইভ ভিডিও দেখতে পারবেন। নিজের মতো বিচার করতে পারবেন ঘটনাটিকে। জুকারবার্গ লাইভ ভিডিও উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, এই প্রযুক্তিটি পুরো গণমাধ্যম ব্যবস্থাই বদলে দেবে। এজন্য এটি কার্যকর করতে আমরা সর্বোচ্চ শ্রম দিচ্ছি। আপনার আশপাশের কোনো ঘটনা সথে সথে ফেসবুকে লাইভ ভিডিও মুড চালু করে দিতে পারেন। ধরা যাক, আপনার পাশেই একটি দুর্ঘটনা হলো। আপনি তখনই সেটিকে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারেন আপনার মোবাইল ক্যামেরার মাধ্যমে। কিছু মানুষের সাথে কথা বলে আপনি প্রচার করতে পারেন পুরোদস্তুর টেলিভিশন রিপোর্ট। এর আগে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন পেরিস্কোপ ও মিরকাট লাইভ ভিডিও চালু করলেও সেটি খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেনি। তবে ফেসবুকের বিষয়টা ভিন্ন। কারণ তাদের বিশাল ব্যবহারকারীর সংখ্যা এটিকে পৌঁছে দেবে নতুন দিগন্তে। শুরু করেছেন যারা ফেসবুক লাইভ ব্যবহার করে প্রথম পেশাদার লাইভ শো’র নাম হচ্ছে চেদ্দার। এটি দেখে কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে বাঘা বাঘা সব খবরভিত্তিক টেলিভিশন কম্পানির। অনেকেই ফেসবুক লাইভে শো প্রকাশের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। একাধিক শো পরিচালনা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সিএনএন। কিছুদিন আগেই হয়ে যাওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় আইসিসির ফেসবুক পেইজ থেকে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলন সরাসরি ফেসবুকে সম্প্রচার করা হয়।