যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর প্রচেষ্টা
দীর্ঘদিন যাবৎ টানাপোড়েনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে সুসম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ ব্যাপারে ১৩ চুক্তি ও প্রস্তাব স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বও পাচ্ছে একটি মার্কিন কোম্পানি। এ খবর দিয়েছে অনলাইন পত্রিকা শীর্ষ নিউজ।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ফখরুদ্দিন-মইন উ আহমেদের দেয়া নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর দেশে ঘটতে থাকে একের পর এক নানা ঘটনা। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মী গুম-অপহরণের শিকার হন। যুক্তরাষ্ট্র এসবকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে আসছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশে বাধাদানের মাধ্যমে সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করেছে বলেও যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে আসছে। এসব বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় উদ্বেগের পাশাপাশি সরকারের ওপরও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
তারপর ড. ইউনূস এবং জিএসপি ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হয় সরকারের। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের আরও চরম অবনতি ঘটে।
সবদলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বারবার তাগাদা দিলেও আওয়ামী সরকার দেশটিকে কোনো পাত্তাই দেয়নি। এতে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরো খারাপ হতে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রীরা প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ- এমনকি জাতীয় সংসদেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। এদিকে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার হচ্ছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশই যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থপাচার প্রতিরোধ বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ।
অর্থপাচার প্রতিরোধ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরো ১২টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও এমওইউ স্বাক্ষরের প্রস্তাব রয়েছে বাংলাদেশের। এর মধ্যে বিমান এবং সাইবার নিরাপত্তা বা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়ও রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠার জন্যও এমওইউ স্বাক্ষরের বিষয় পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এসব চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হকের সভাপতিত্বে আগামী ৬ এপ্রিল আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছে মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুক্তরাষ্ট্র অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস মোট ১৩টি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের একটি প্রস্তাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এসব চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আšঃÍমন্ত্রণালয় বৈঠক ডাকা হয়েছে।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো প্রস্তাবে দুই দেশের মধ্যে ভূমিকম্প ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা, দক্ষ জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, দুই দেশের বিভিন্ন শহরের মধ্যে ট্রাফিক ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষণাপত্র বিনিময়, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিস প্রশিক্ষণ কেন্দ্রদ্বয়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফায়ারআই কোম্পানিকে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘটনা তদন্তে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে। অর্থ ফেরত পেতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস ও বিশ্বব্যাংককে। প্রয়োজনে মামলা দায়ের করতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থপাচার প্রতিরোধ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তা চুরি হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে কিছুটা সহায়ক হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
আর সাইবার নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সাইবার অপরাধ তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার পর যুক্তরাজ্য নিরাপত্তা ঘাটতির অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে যাত্রীবাহী বিমানে কার্গো বহন নিষিদ্ধ করেছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা তদারকির কাজ ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের যাত্রীবাহী বিমানের নিরাপত্তা নিয়েও বিভিন্ন সময় অভিযোগ তুলেছে কোনো কোনো দেশ। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিমান নিরাপত্তা বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দিয়েছে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস।