জাস্টিন ট্রুডো-সাদিক খানের ঘটনা ঘটতে পারে মার্কিন নির্বাচনেও
বিষাক্ত প্রচারণার উল্টো ফল পেয়েছেন জ্যাক গোল্ডস্মিথ
লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সবাইকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন লেবার পার্টির প্রার্থী সাদিক খান। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ টোরি দলের জ্যাক গোল্ডস্মিথকে ১৩.৬ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন তিনি। এ নির্বাচনে সাদিকের অর্জন যতটা উৎসাহব্যঞ্জক তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রচারণা ছিলো ততটাই কদর্য ও নোংরা।
যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল লেবার পার্টির প্রার্থী সাদিক খান পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এবং মুসলিম। তার এই পরিচয়কে হাতিয়ার করে প্রচারণায় নেমেছিলেন জ্যাক গোল্ডস্মিথ। জ্যাক তার ‘বিষাক্ত’ প্রচারণায় সাদিককে একজন গোঁড়া মৌলবাদী, চরম বর্ণবাদী এবং মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি অন্ধভক্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এমনকি জ্যাক জনপ্রিয় ডেইল মেইল পত্রিকার রোববারের সংস্করণে নিজের লেখা একটি কলামে ২০০৫ সালে লন্ডন বোমা হামলার ছবির পাশে সাদিকের ছবি দিয়ে লিখেছিলেন, সাদিক এই হামলার সমর্থক।
কিন্তু তার এই ‘বিষাক্ত’ প্রচারণার উল্টো ফল পেয়েছেন জ্যাক গোল্ডস্মিথ। নির্বাচনে হারের জন্য জ্যাকের ওই ‘কদর্য’প্রচারণাকেই দায়ী করা হচ্ছে।
কারণ এটা প্রমাণিত যে, আক্রমণাত্মক কদর্য প্রচারণা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য সহায়ক হলেও পৃথিবীর সব জায়গায় এটি সাফল্য বয়ে আনবে না। যদিও ব্রিটেনে অনেকেই বিশ্বাস করেন মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণা শুধু গ্রহণযোগ্যই নয়, নির্বাচনে জেতারও নিশ্চিত চাবিকাঠি। কিন্তু অসহিষ্ণুতা নির্বাচনে জয়লাভের জন্য সব সময় কার্যকর নাও হতে পারে।
আর এর জন্য খুব বেশিদূরে যেতে হবে না। গত বছরের কানাডা নির্বাচনের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মিলে। তৎকালীন কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার তার নির্বাচনী প্রচারণায় কঠোর মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। অন্যদিকে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী জাস্টিন ট্রুডো মুসলিমদেরকে নিজের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিলেন।
আর এর পরের ফলাফল সবার জানা। নির্বাচনে হার্পার শুধু প্রধানমন্ত্রীত্বই হারাননি, রাজনীতি থেকেও তার লজ্জাজনক বিদায় ঘটেছে।
এর কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়। কানাডায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও মুসলিম ভোটব্যাংক যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে অধিকাংশ মুসলিমই রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন এবং পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে ভোট দেয়ার ব্যাপারেও খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন না।
কিন্তু হার্পারের মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য মুসলিমদের ভোটদানে উৎসাহিত করেছে। তারা মনে করেছে, হার্পারের অসুস্থ চিন্তাভাবনা থেকে মুসলিমদের রক্ষার একটাই উপায় তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেয়া।
এ চিন্তা থেকেই কানাডার মুসলিমরা এবারের নির্বাচনে ট্রুডোর পক্ষে রেকর্ড পরিমাণ ভোট প্রদান করেছেন। ফলে নির্বাচনে হার্পারকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে প্রথমবারের মত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ট্রুডো।
ধারণা করা হচ্ছে, একই ঘটনা ঘটেছে লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে। জ্যাক তার মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণা দিয়ে সাদিক খানের যতটা না ক্ষতি সাধন করতে পেরেছেন তার চেয়ে বেশি তার উপকার করেছেন। ফলশ্রুতিতে, লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে সাদিকের অর্জিত ভোট যুক্তরাজ্যে একক ভোটলাভের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যার রেকর্ড গড়েছে।
আর এমনটাই ঘটতে পারে বিশ্বের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন নির্বাচনে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায় শুধুমাত্র একজন ‘ঘৃণ্য’ রাজনীতিক নন, তাকে প্রতিহত করার জন্য মুসলিমরা আরো বেশি রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠছেন। যদিও আমেরিকায় মুসলিম ভোটাররা সংখ্যায় অনেক কম কিন্তু ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা ও ওহাইয়োর মতো দোদূল্যমান স্টেটগুলোতে মুসলিম ভোট গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে।
এদিকে ট্রাম্প যতই মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠছেন তার ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন ও বার্নি স্যান্ডার্স ততই মুসলিম ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি করছেন। অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ভোট পেতে স্যান্ডাসের সমস্যা হলেও মুসলিমদের ভোট সহজেই নিজের ঝুলিতে পুরছেন ভারমন্ট সিনেটর। ফলে ডেমোক্র্যাট নমিনেশন যেই জিতুক প্রকৃতপক্ষে লাভবান হচ্ছে ডেমোক্র্যাট পার্টি।
অন্যদিকে, মুসলিম, মেক্সিকান ও নারীদের নিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে ট্রাম্প নিজের ও রিপাবলিকান দলের কতটুকু ক্ষতি বা উপকার করলেন তা জানা যাবে আগামী নবেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর।
আর গতকাল মুসলিম সাদিক খানের লন্ডন বিজয় সারাবিশ্বের মুসলিম-বিদ্বেষীদের সতর্কবার্তা জানিয়ে দেয়ার পাশাপাশি মুসলিমদেরও করেছে আত্মসচেতন। ব্রিটিশ মুসলিমদের নিজের দেশ ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোনো বার্তা হতে পারে না যে, ‘তুমি কে তা দ্বারা নয় বরং তুমি কি করো তা দিয়েই তোমার মূল্যায়ন হবে’।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যারা মুসলিমদের ইউরোপের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিবোধের বিশ্বাস নিয়ে সন্দিহান তারা নিজেরাই এই চেতনা ধারণে ব্যর্থ। একই দোষে মার্কিন রিপাবলিকান দলের প্রার্থীও অভিযুক্ত।
ভবিষ্যতের পৃথিবী কোনদিকে যাবে তা এখনো নিশ্চিত করে বলা না গেলেও আমরা আশা করতে পারি মুসলিম সাদিক খানের লন্ডন বিজয়ের বার্তা মার্কিন নির্বাচনী পক্ষগুলোকে মুসলিম ইস্যুতে আরো প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে অনুপ্রাণিত করবে।
বাস চালকের ছেলে থেকে লন্ডনের মেয়র : ঐতিহাসিক জয় পাওয়া সাদিকের শুরুর জীবনটা মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। লন্ডন অভিবাসী এক পাকিস্তানী নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। বাস চালক বাবা আমানুল্লাহ ও দর্জি মা সেহেরুন খানের আট সন্তানের মধ্যে পঞ্চম ছিলেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই ওই শিশুটির মধ্যে ছিল কঠিন সব বাধা পেরিয়ে নিজের জন্য এবং নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ – এমন বিষয়গুলোর জন্য সাফল্য ছিনিয়ে আনার দৃঢ় সংকল্প। এই দৃঢ়চিত্তই তাকে এনে দিয়েছে লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে বিজয়, যেখানে তার অর্জিত ভোট যুক্তরাজ্যে একক ভোটলাভের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যার রেকর্ড গড়েছে।
‘বাস চালকের ছেলে’ – কথাটি অসংখ্যবার ব্যবহার হয়েছে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে। এমনকি তার নিজের নির্বাচনী প্রচারণা ও বক্তৃতায়ও বহুল ব্যবহৃত একটি বুলি এটি।
সাদিক খান প্রায়ই বলতেন, কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে তার প্রাথমিক ধারণা এসেছে ট্রেড ইউনিয়ন থেকে। তার বাবা আমানুল্লাহ টানা ২৫ বছর বাস চালক থাকা অবস্থায় একটি ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। এজন্য তিনি ঠিকঠাক বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পেতেন। তবে ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ করা মা সেহরুন খান ঠিকমতো পারিশ্রমিক পেতেন না।
ছয় ভাই, এক বোন এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের আর্লসফিল্ডের হেনরি প্রিন্স এস্টেটে তিন বেডরুমের ছোট একটি বাড়িতে থাকতেন সাদিক খান। ২০ বছর বয়স পর্যন্ত একটি সিঙ্গেল খাট নিজের ভাইয়ের সাথে শেয়ার করে ঘুমাতেন সাদিক।
স্থানীয় আর্নেস্ট বেভিন কলেজে লেখাপড়া করেন তিনি। সেখানেই তিনি প্রথম রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে লেবার পার্টিতে যোগ দেন সাদিক।
রাজনীতিতে অংশ নেয়ার পেছনে সাদিক কৃতিত্ব দেন তার সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নাজ বোখারিকে। যুক্তরাজ্যের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক এই নাজ বোখারিই সাদিককে প্রথম উপলব্ধি করিয়েছিলেন, ‘গায়ের রঙ বা পারিবারিক প্রেক্ষাপট তোমার জীবনকে গড়ে তোলার পথে বাধা নয়।’
প্রথমে দাঁতের ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও এক শিক্ষকের পরামর্শে সেই ইচ্ছা বাদ দিয়ে আইন নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন সাদিক। ওই শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সারাক্ষণ তর্ক করো’।
সাদিক খান কখনো তার মুসলিম ধর্মবিশ্বাসকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি। বরং এমপি হিসেবে দেয়া প্রথম বক্তব্যে তার বাবার শেখানো মোহাম্মদ (সা.)-এর হাদিস নিয়েও কথা বলেন।
গত বছর যখন লেবার পার্টির বাঘা বাঘা রাজনীতিকরা নিজ দল থেকে লন্ডনের মেয়র পদে নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য লড়ছেন, সাদিক খান তখন সেদিক দিয়ে একজন চুনোপুঁটিই বলা যায়। মেয়র পদের ধারে কাছেও তাকে কেউ ভাবছে না। বেশিরভাগের দৃষ্টি ছিল টনি ব্লেয়ার আমলের ঝানু রাজনীতিক ব্যারোনেস জোয়েলের দিকে।
কিন্তু সাদিক খান শুধু ব্যক্তি জীবনেই নন, কর্মজীবনেও বার বার সেই পেছন থেকেই সামনে উঠে এসেছেন। মেয়র নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম নেই। সবার অসমর্থিত এক প্রার্থী থেকে হয়ে উঠলেন লন্ডনের মেয়র।