একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের অকালবিদায়
মীর মনজুর মাহমুদ: ১১ মে সকাল ৮টার একটু আগে বা পরে মাগুরা শহরের পারনান্দুলিয়ায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় যে মানুষটি তার মহান প্রভুর কাছে পাড়ি জমালেন, তিনি তিন কন্যা, এক পুত্রসন্তান এবং স্ত্রী শুধু নয়, দলমত নির্বিশেষে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। অকালে বিদায় নেয়া অধ্যাপক ড. আবু নাঈম মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর ছিলেন দেশের এক বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রিয় ‘শাইখ’, দ্বীনের মহান শিক্ষক। ঘটনার দিন বিকেলে তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট্রের আঙিনায় (যা তার বাড়ির আঙিনাও) হাজির হয়ে দেখলাম, সেখানে লোকে লোকারণ্য। তাদের কেউ ফুপিয়ে কাঁদছেন, কারো নীরবে অশ্রু ঝরছে, আবার অনেকেই বলছেন এ কী হলো, আমরা এখন কার কাছে যাবো? আর সবাই অধীর আগ্রহে তাকে শেষ দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষেরা আসছেন নামাজে জানাজায় অংশ নিতে। বর্তমান সময়ে একজন মানুষের জন্য এমনটি সচরাচর চোখে পড়ে না। জ্ঞানচর্চা এবং ইসলামের দাওয়াহ কাজে নিবেদিত এই মানুষটির জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ সালে ঝিনাইদহ জেলার এক নিভৃত গ্রামে। একজন সরলপ্রাণ স্কুলশিক্ষকের একমাত্র পুত্রসন্তান তিনি। ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে তিনি কামিল (হাদিস, ১৯৭৯) এবং বিশ্বখ্যাত ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সউদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ থেকে অনার্স, মাস্টার্স এবং পিএইচডি অর্জন করেন। তার একমাত্র পুত্র উসামা জাহাঙ্গীর সেখানেই স্নাতক শ্রেণীতে পড়ালেখা করছেন। ড. জাহাঙ্গীর ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়াতে আল-হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে তার ইংরেজি, বাংলা ও আরবি ভাষায় প্রায় ৩০টি মৌলিক গ্রন্থ এবং ৪০টির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ দেশে-বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে। অত্যন্ত মেধাবী মানুষটি কুরআনে হাফেজও ছিলেন।
প্রফেসর জাহাঙ্গীর সুন্নাহর পুনরুজ্জীবনে আমৃত্যু খিদমাতকে জীবনের মিশন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ লক্ষ্য নির্ধারণ করা ছিল যুগের চাহিদা, তবে বড় ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিরন্তর শ্রমসাধ্য তার ভাষায় যা ছিল উম্মাহর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি পিস টিভি (বাংলা), সাবেক ইসলামিক টিভি, এনটিভিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব মিডিয়াতেই বক্তব্য রাখতেন। সম্প্রতি আস-সুন্নাহ ট্রাস্টের অধীনে একটি মিডিয়া স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেছেন যেখান থেকে দ্বীনের দাওয়াহর কাজ করার একান্ত বাসনা তিনি পোষণ করতেন। আসন্ন রমজানের জন্য কিছু অনুষ্ঠান রেকর্ড করেছেন এবং বাকিগুলোর কাজ চলছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে দৌড়েছেন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দ্বীনের কথা বলতে, মানুষকে জান্নাতের পথে আহ্বান করতে। দারুস সালাম কওমি মাদরাসা, ঢাকা, পাকশী কওমি মাদরাসায় (পাবনা) বুখারি শরিফের দারস দিতে ছুটে যেতেন তিনি। সারা দেশে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম থেকে শুরু করে শিক্ষামূলক নানা অনুষ্ঠানে ছোটাছুটি করা দ্বীনের এ মহান খাদেম চিরতরে নীরব হয়ে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মনে হয়, তার জীবনের অল্প সময়ের ইখলাসপূর্ণ কাজকে আল্লাহ যথেষ্ট বিবেচনা করে দুনিয়া থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে এটি তার জন্য যথেষ্ট হলেও উম্মাহর সদস্যরা তার খিদমাত থেকে বঞ্চিত হলো।
নিরহঙ্কার, সদালাপী সব্যসাচী মানুষটি দুনিয়া থেকে নিয়ে গেছেন অনেক বেশি। তা হলো উম্মাহর জন্য এই জ্ঞানসাধকের নিরলস পরিশ্রমের পাওনা, দ্বীনের পথে আহ্বানকারী হিসেবে পেরেশানির মহান পুরস্কার, হাজারো মানুষের ভালোবাসা, সর্বোপরি আল্লাহর মহান সন্তুষ্টি। আর আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট, মাদরাসা, মসজিদ, স্কুলসহ মানবতার সেবায় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি নিজের জীবনের অঙ্গ বানিয়ে নিয়েছিলেন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে অপরিহার্য মনে করতেন। জ্ঞানের সেবা এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সদকায়ে জারিয়ার অনন্ত ধারা তার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আমরা যারা এ মানুষটিকে ভালোবাসি তাদের উচিত, তার রেখে যাওয়া কাজগুলোকে এগিয়ে নেয়া।
ড. জাহাঙ্গীর দলমত নির্বিশেষে এ দেশের মুসলমানদের ঐক্য এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন; সে জন্য সচেষ্টও থাকতেন; দ্বীনের বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদকে সব সময় পরিহার করতেন; ভিন্নমতের বিষয়গুলোকে জ্ঞান দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন; কাউকে খাটো করে কথা বলা পছন্দ করতেন না; কুরআন-সুন্নাহর সঠিক কথাটি যথাযথভাবে লেখনী, বক্তব্য এবং দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আরাম-আয়েশকে কখনোই প্রশয় দেননি। তিনি ছাত্রজীবনে একনিষ্ঠভাবে পড়ালেখা এবং কর্মজীবনে সারাক্ষণ দ্বীনের প্রচার-প্রসার, জ্ঞান-গবেষণা, লেখালেখি, দাওয়াহ-সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যস্ত থাকতেন। জাতীয় প্রয়োজনেই তার জীবন-কর্মের ওপরে সবিস্তার গবেষণা হওয়া জরুরি।
আল্লাহ তার সব কাজকে কবুল করুন। আসুন, আমরা তাকে সঠিক অর্থে ভালোবাসতে চেষ্টা করি। তার জ্ঞানচর্চা ও দাওয়াতের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করি। তাহলেই আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে আমাদের জীবনকে পরিচালিত করা সহজ হবে।