বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা
বাংলাদেশে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি হয়েছে ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।
শুধু জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসেই ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।আর খেলাপি হওয়ার পর আদায়ের সম্ভাবনা না থাকায় এ পর্যন্ত ৪১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে ৪১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৪৮ কোটি টাকা। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও খেলাপি ও অবলোপনে রয়েছে একই কাতারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশের ৫৬টি ব্যাংকের বর্তমানে (মার্চ শেষে) বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৯০১ কোটি টাকা, যা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৫ লাখ ৮৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়েছে মাত্র ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
গত বছরের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়ায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের স্থিতি কমে ৫১ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে, যা ছিল ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০১৪ সাল শেষে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। সে সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক ও বিডিবিএল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা, যা এ খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। খেলাপি ঋণে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা, যা এ খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বেসরকারি ৩৯টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, যা এ খাতের বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৮২২ কোটি টাকা, যা এ খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব, প্রকাশনার তথ্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের যে তথ্য দেওয়া হয়, তাতে শুধু নিয়মিত খেলাপি ঋণকেই খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়। অবলোপন করা ঋণকে আড়ালেই রাখা হয় সব সময়। মন্দ মানে শ্রেণীকৃত পুরোনো খেলাপি ঋণ ব্যাংকের স্থিতিপত্র (ব্যালান্স শিট) থেকে বাদ দেওয়াকে ‘ঋণ অবলোপন’ বলা হয়। আর ঋণ দেওয়ার পর আদায় না হলে তা খেলাপি হয়ে পড়ে। যার বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর ওই সময় পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণ ছিল আরও ১৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ছিল ৩৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। এই হিসাবে গত প্রায় ৮ বছরে প্রকৃত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার প্রায় ১৬৪ শতাংশ। এর বাইরে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আরও ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এই সুবিধা পেয়েছে মূলত বড় খেলাপিরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণ দেয়ার সময় ভালো করে যাচাই ও মূল্যায়ন করেনি ব্যাংকগুলো। হল-মার্কের মতো বড় বড় ঋণ জালিয়াতির বিষয়গুলো নিয়ে সেই অর্থে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। এ কারণে দেশে ঋণখেলাপিদের মধ্যে উত্সাহের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে হয় না, এমন একটি ধারণা সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের প্রভাব দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর পড়েছে। যার কারণে দেশে দিন দিন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকগুলোর ওপর এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিপুল পরিমাণ এ খেলাপি ঋণ দেশের জন্য অশনিসংকেত। তবে খেলাপি ঋণ যে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, তা স্বাভাবিক। কারণ, গত কয়েক বছরে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা কখনোই আদায় হবে না। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান-এমডিরা মিলে দুর্নীতি করেছেন। বেসরকারি ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিং করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাও যুগোপযোগী নয়। আরো কঠোর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।