ফিলিস্তিনে ইসরাইলী দখলদারিত্বের ৪৯ বছর
বিশ্ব মানচিত্রে এক রক্তাক্ত জনপদ ফিলিস্তিন। ১৯৪৭ সালে ভূখণ্ড হারিয়ে এক অরক্ষিত জনপদে পরিণত হয় দেশটি। স্বাধীন ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র চাপিয়ে দেয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে এ অঞ্চলে। একাধিক যুদ্ধেরও শিকার হয়েছেন এই ভূখণ্ডের মানুষ। ১৯৬৭ সালের ৪ জুন ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুসালেম ও গাজা উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং মিসরের সিনাই উপত্যকার অংশবিশেষ দখল করে নেয় ইসরাইল। এরই মধ্যে পার হয়েছে সেই দখলদারিত্বের ৪৯ বছর। এত বছর পর এখনও প্রায় অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মানুষ। ইসরাইলী আগ্রাসন আর বর্বরতার শিকার হচ্ছেন মুক্তিকামী ফিলিস্তিনীরা। এ বিষয়টি নিয়ে সোমবার শিরোনাম করেছে ব্রুনাইভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ব্রুনাই টাইমস।
১৯৭৮ সালে অবশ্য এক শান্তি চুক্তির আওতায় সিনাই উপত্যকার দখল ছেড়ে দেয় ইসরাইল। ২০০৫ সালে একতরফাভাবে গাজা উপত্যকার ওপর থেকেও ইসরাইলী দখলদারিত্বের অবসান ঘটে। কিন্তু পুরো ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর ইসরাইলী বর্বরতার অবসান ঘটেনি। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে প্রতিবেশী চার আরব দেশ- মিসর, সিরিয়া, জর্দান ও ইরাক একযোগে ইসরাইল আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। বিজয়ী ইসরাইল ফিলিস্তিনের ৭৭ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়।
১৯৯৩ সালে সম্পাদিত অসলো প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনী মুক্তি সংস্থার মধ্যে যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনী স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়। ততদিনে অবশ্য সেই অঞ্চলের একটা বড় অংশ ইসরাইলের অবৈধ বসতির কবলে অথবা সরাসরি সামরিক নিয়ন্ত্রণে। নামেই স্বায়ত্তশাসন কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে চৌপ্রহর ইসরাইলী প্রহরা, উঁচু দেয়াল, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে ইসরাইলী অনুমতি। কিন্তু সেই প্রশাসনও দুই টুকরো হয়ে গেল ২০০৬ সালের নির্বাচনের পর। পশ্চিমতীর গেল ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে, গাজা গেল ইসলামিক ব্রাদারহুডের মিত্র হিসেবে পরিচিত হামাসের।
হামাস ও ফাতাহর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে নয়, ইসরাইলের প্রতি সম্পর্কের প্রশ্নেও। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সরকার আপসের পথ বেছে নিয়েছে। অনেকেই অভিযোগ করে, তাদের মূল লক্ষ্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নয়, ফাতাহর চলতি নেতৃত্বকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। অন্যদিকে হামাস সব ধরনের আপসের বিরোধী।
ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইলের ফিলিস্তিন ছিল উসমানিয়া খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল বৃটেনবিরোধী। তখন যুদ্ধ জয়ে ফিলিস্তিনীদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন, যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। যেহেতু আরবরা ছিল ইহুদিদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই তারা ধরে নেয়। কিন্তু এর মাঝে যে মহা ধোঁকাটি লুকিয়ে ছিল, তা তারা বুঝতে পারেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। ফলে আনন্দিত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চান কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান। উত্তর ছিল; অর্থ নয় আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে প্যালেস্টাইন। ফলে প্যালেস্টাইন ভূখ-টি ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় বৃটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর বৃটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এই সময়টিই প্যালেস্টাইনকে আরব শূন্য করার জন্য ভালোভাবে কাজে লাগায় ইহুদি বলয় দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি।
বৃটিশরা একদিকে ইহুদিদের জন্য খুলে দেয় প্যালেস্টাইনের দরজা; অন্যদিকে বৃটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা প্যালেস্টিনিয়ানদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে অনেক প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ প্যালেস্টিনিয়ানদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। পাশাপাশি ইহুদিদের বসতি স্থাপন ও আরবদের উচ্ছেদকরণ চলতে থাকে খুব দ্রুত। এর ফলে ২০ লাখ বসতির মধ্যে বহিরাগত ইহুদির সংখ্যা দাঁড়ালো ৫ লাখ ৪০ হাজার। এ সময়ই ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসংঘে ভোটগ্রহণ হয়। এতে ৩৩টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে, ১৩টি রাষ্ট্র বিরুদ্ধে এবং ১০টি ভোটদানে বিরত থাকে। প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেল ভূমির ৫৭ শতাংশ। আর ফিলিস্তিনীরা পান ৪৩ শতাংশ। তবে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত; যাতে ভবিষ্যতে ইহুদিরা সীমানা বাড়াতে পারে। ফলে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত হলেও উপেক্ষিত থেকে যায় ফিলিস্তিন। জাতিসংঘের মাধ্যমে পাস হয়ে যায় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। প্রহসনের নাটকে জিতে গিয়ে ইহুদিরা হয়ে ওঠে আরো হিংস্র। তারা হত্যা সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিজ ভূমি থেকে ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদ করতে থাকে। চলতে থাকে বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, জোর করে জমি দখল, নারী নির্যাতন আর খুনের উৎসব। ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনী বাধ্য জন দেশত্যাগ করতে। এর এক পর্যায়ে ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা ১ মিনিটে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদিরা। ১০ মিনিটের ভেতর ইহুদি রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। –দ্য ব্রুনাই টাইমস