তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ, নিহত ১৯৪
বানচাল হয়ে গেছে তুরস্কের অভ্যুত্থান চেষ্টা। ব্যর্থ এ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৯৪ জন। নিহতদের মধ্যে ১০৪ জন অভ্যুত্থান চেষ্টাকারী। এ ছাড়া নিহত হয়েছেন ৯০ জন। এর মধ্যে ৪৭ জনই বেসামরিক ব্যক্তি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫৬৩ জনকে। সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সেনা প্রধান উমিত দুন্দার।
শুক্রবার রাতে অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে দলে দলে মানুষ নেমে আসতে থাকে রাজপথে। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রিসেফ তায়িপ এরদোগান দেশবাসীকে রাজপথে নেমে আসার উদাত্ত আহ্বান জানান। রাতের আধারেই দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ মিলে হাজার হাজার মানুষ নেমে পড়ে রাস্তায়। তারা সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সব ভয়, ভীতি উপেক্ষা করে তারা অবস্থান নেয় ট্যাঙ্কের সামনে। ইস্তাম্বুলে কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরের বাইরে একটি ট্যাঙ্কের সামনে শুয়ে পড়ে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন একজন। বিভিন্ন রাস্তায় ট্যাঙ্কের ওপর উঠে তার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেখা যায় সাধারণ মানুষকে।
সেই সঙ্গে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভ্যুত্থান চেষ্টার বিরুদ্ধে বিবৃতি আসতে থাকে। তারা সবাই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের পক্ষে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানায়। দৃশ্যত, কোন দেশ বা কোন সংস্থাই সেনা বাহিনীর একাংশের এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় সমর্থন দেয় নি। ফলে জনতার প্রতিরোধ ও স্বীকৃতি না পেয়ে অভ্যুত্থানকারীরা আত্মসমর্পণ করতে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় দেখা মেলে পরিত্যক্ত ট্যাঙ্ক। মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে অভ্যুত্থানকারীদের হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণের দৃশ্য। কিন্তু ততক্ষণে কমপক্ষে ৯০টি প্রাণ ঝরে গেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তায়িপ এরদোগান এ সময় ছিলেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় শহর মারমারিসে অবকাশ যাপনে। তিনি খবর পেয়ে দ্রুত ফিরে যান ইস্তাম্বুলে কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে। স্থানীয় সময় তখন ভোর প্রায় সাড়ে চারটা। সেখানেই তিনি কড়া নিরাপত্তায় সংবাদ সম্মেলন করেন।
বলেন, যারা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছেন তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা করছেন। তাদেরকে কঠোর পরিণাম ভোগ করতে হবে। তখনও রাজধানী ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা সহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে তীব্র সংঘর্ষ চলছিল। অভ্যুত্থানকারীরা দাবি করে, দেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা টেলিভিশন স্টেশন দখলে নিয়েছে। ট্যাংক মোতায়েন করেছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। ইস্তাম্বুলে কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে বাইরে মোতায়েন করা হয় ট্যাংক।
প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম এনটিভিকে বলেছিলেন, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ওদিকে বিমানবন্দরে বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, তিনি জনগণের পাশেই থাকবেন এবং ইস্তাম্বুল থেকে কোথাও যাবেন না। এরদোগান বলেন, আমি অবকাশ যাপনে যাওয়ার পরপরই আমাকে বলা হয়েছে আমি যেসব স্থানে অবস্থান করতাম সেখানে বোমা হামলা করা হয়েছে। আমি মনে করি তারা ভেবেছিল আমি ওইসব স্থানেই ছিলাম। শনিবার সকালে তিনি বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমাণ কয়েক হাজার সমর্থকের উদ্দেশে ভাষণ দেন।
সেখানে বলেছেন, অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারীরা জনগণের অস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে তাক করেছে। যে প্রেসিডেন্টকে শতকরা ৫২ ভাগ মানুষ ক্ষমতায় এনেছে সেই প্রেসিডেন্টই দেশের চার্জে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে আমরা যদি প্রতিরোধ গড়ে তুলি তাহলে তারা সফল হতে পারবে না। তিনি যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন ইস্তাম্বুলের বোসফোরাসে বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্যকে আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায়। তারা তাদের ট্যাংক ফেলে দু’হাত উঁচু করে এগিয়ে যান।
প্রাথমিক খবরে বলা হয়েছিল, সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। টেলিভিশন স্টেশনও তাদের নিয়ন্ত্রণে। একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছিল আঙ্কারা। মানুষের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র উত্তেজনা। অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। তাকসিম স্কোয়ার, পার্লামেন্ট ভবনে তীব্র বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। রাতভর সংঘর্ষ হয় ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারায়। এতে কমপক্ষে ৬০ জন নিহত হয়েছেনবলা হয়েছে নিহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক লোকজন। ইস্তাম্বুলের সঙ্গে দেশের অন্য অংশের সড়ক যোগাযোগের সেতুগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এবং আঙ্কারার আকাশে নিচু দিয়ে বিমান উড়ছিল।
তখন সেনাবাহিনী একটি বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, এখন থেকে একটি ‘পিস কাউন্সিল’ দেশ পরিচালনা করবে। দেশে কারফিউ এবং মার্শাল’ জারি করা হয়েছে। এর সঙ্গে কারা জড়িত তা পরিষ্কার হওয়া যায় নি। এ ঘটনাকে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা বলে বর্ণনা করেছেন রিসেপ তায়িপ এরদোগান। রাতভর যে ভয়াবহতা চলে তা ফুটে ওঠে টেলিভিশনের পর্দায়।
তাতে দেখা যায়, আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে সেনা সদস্যরো টহল দিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে জনগণের সঙ্গে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। অমিত সাহস নিয়ে তাদের বন্দুক, কামানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে মানুষ। তুরস্কের একটি টেলিভিশন বলেছে, রাজধানী আঙ্কারায় অভ্যুত্থান চেষ্টার পক্ষের একটি হেলিকপ্টার গুলি করে ভূপাতিত করেছে সরকারি ফাইটার বিমান।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইয়ালদ্রিম জানিয়েছিলেন, তুরস্কে সেনাবাহিনীর একটি অংশ বেআইনি অভিযান শুরু করেছে। তিনি বলেছেন, কোন অনুমতি ছাড়াই সেনাবাহিনীর সদস্যরা ওই অভিযান শুরু করেছে। তবে এটা কোন অভ্যুত্থান নয়। সরকারে কোন পরিবর্তন হয়নি বলেও তিনি জানান। তখন ইস্তাম্বুলের পুলিশ সদর দপ্তর এলাকাতেও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। কারফিউ ঘোষণা করা হলেও, এরদোগানের একদল সমর্থক ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কোয়ারে জড়ো হন। সেখানেও সংঘর্ষ হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, সবকিছু দেখে এটা একটি পরিকল্পিত অভ্যুত্থান বলেই মনে হচ্ছে। কারণ তারা সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়েছে। খুব সহজে এর শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না । এনটিভি টেলিভিশনকে টেলিফোনে ইয়ালদ্রিম বলছেন, কোন একটি চেষ্টার সম্ভাবনার বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে এ ধরণের কোন চেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না।