বিএসএফ এর গুলিতে বাংলাদেশি হত্যা থামছে না
নাছির উদ্দিন শোয়েব: সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধে কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখছেনা ভারত। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ, হত্যাকান্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনাসহ নানা প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা। প্রতিমাসেই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিরিহ বাংলাদেশি নাগরিক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। বৃহস্পতিবার রাতেও রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হয়েছেন এক বাংলাদেশি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৬ মাসে সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে ১৬ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়েছেন। ২০১৫ সালে সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে ৪৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৫ জন। অধিকারের হিসাবে, ২০১৩ সালে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ছিল ২৯ জন। ২০১২ সালে ৩৮ জন আর ২০১১ সালে ৩১ জন। গত বছর মারা যাওয়া ৪৫ জনের মধ্যে ৩১ জন গুলিতে আর ১৪জন শারীরিক নির্যাতনে নিহত হয়।
অধিকার বলছে, দুই দেশের মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেফতার ও হস্তান্তরের সমঝোতা এবং চুক্তি থাকলেও, বিএসএফ সেটি লঙ্ঘন করে সীমান্তে বাংলাদেশীদের দেখামাত্রই গুলি করছে। অধিকারের মতে, বিএসএফ তাদের ‘দেখামাত্র গুলি’ নীতি থেকে একবিন্দুও সরে আসেনি। গুলি করা ছাড়াও কখনো কখনো অপহরণ করে নেয়া হচ্ছে, যাদের ওপর অমানসিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, এসব হত্যার প্রতিবাদে মাঝেমধ্যে পতাকা বৈঠক ডাকে বিজিবি। সব সময় নিয়ম মাফিক বৈঠক হয়। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয় না। এমনকি হত্যার পর সব সময় লাশও ফেরত দেয় না বিএসএফ। নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা ও অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা সীমান্ত এলাকার মানুষের কাছে। তবে এসব হত্যাকান্ডে তেমন উদ্বিগ্ন নয় বাংলাদেশ সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, সীমান্ত হত্যা দুদেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না।
চলতি বছরের মে মাসে ঢাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর মধ্যে মহাপরিচালক পর্যায়ে যে সীমান্ত সম্মেলন হয় সেখানেও নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। পিলখানায় বিজিবি সদর দফতরের সম্মেলন কক্ষে বিজিবি প্রধান ও বিএসএফ প্রধান যৌথ আলোচনার দলিল স্বাক্ষর ও সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়। বিজিবি প্রধান বলেছিলেন, এখন থেকে সীমান্তে হত্যাকান্ডসহ যে কোনো ধরনের ঘটনায় তদন্ত প্রয়োজন হলে যৌথভাবে হবে। আগে একপক্ষ এক ধরনের বক্তব্য দিত। আরেক পক্ষ আরেক রকম বক্তব্য দিত। বিজিবি ও বিএসএফ এর বক্তব্যে বৈপরিত্য ছিল। কিন্তু এখন থেকে আর সে রকম কিছু হবে না। যৌথভাবে তদন্ত শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিজিবি প্রধান আরও বলেন, যে কোনো ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতের সাংবাদিকরাও থাকবেন। তারা তাদের পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করবেন। সঠিক বিষয়টি তুলে ধরবেন। আমরা সব সময়ই সীমান্ত হত্যাকে জিরোতে নামিয়ে আনার নীতিতে সচেষ্ট। এ ধরনের ঘটনা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। আশা করছি এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
এদিকে গত ১৪ মে জীবননগর উপজেলার নতুনপাড়া সীমান্তে স্কুলছাত্র শিহাব উদ্দিন সজলকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সাতজন বিএসএফ সদস্যকে ‘সাসপেন্ড’ করা হয়৷ ভারতের কৃষ্ণনগর ১১৩ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডান্ট মাহেন্দ্র কুমার বানপুর হালদারপাড়া কোম্পানি কমান্ডার ইন্সেপেক্টর অনুভব আত্রাইয়াসহ ওই সাত বিএসএফ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্তের এ আদেশ দেন৷ এ ঘটনায় বিএসএফ-এর মহাপরিচালক কে কে শর্মাও দুঃখ প্রকাশ করেন বলে জানা যায়৷
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রেকর্ড অনুযায়ী ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট (২০১০) পর্যন্ত ৯৯৮ বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৪জন। একই সময় বিএসএফের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয় ৯২৩ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ৯৩৩ জন, নিখোঁজ হয়েছেন ১৮৬ জন ও পুশইনের শিকার হয়েছেন ২৩৫ জনের বেশি। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৫ নারী।
এর আগে বিএসএফের হত্যার শিকার হয় ২০০৯ সালে ৯৬, ২০০৮ সালে ৬২, ২০০৭ সালে ১২০, ২০০৬ সালে ১৪৬, ২০০৫ সালে ১০৪, ২০০৩ সালে ৪৩, ২০০২ সালে ১০৫, ২০০১ সালে ৯৪ এবং ২০০০ সালে ৩৯ বাংলাদেশী নাগরিক।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারসহ পর্যবেক্ষকমহল বলছে, বাংলাদেশী নাগরিকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে হত্যা করা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন। বিএসএফের হত্যাযজ্ঞ বন্ধে ভারত সরকারের সঙ্গে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে বিএসএফ কর্তৃক হত্যাকান্ডের সরেজমিন অনুসন্ধান ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রন্ত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে ভারত সরকারকে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কুড়িগ্রামসহ সবক’টি সীমান্তে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বিএসএফ। সীমান্তবর্তী এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে মানুষ বিএসএফের আগ্রাসনের শিকার হননি। তাদের আগ্রাসী তত্পরতায় সীমান্তের মানুষ এখন নিরাপত্তাহীন। তাদের সময় কাটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে।