‘মানুষ কেন মানুষ মারে?’
আবু এন এম ওয়াহিদ: বেশ কয়েক বছর আগের কথা, ‘মানুষ কেন মানুষ মারে?’ এই শিরোনামে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক পরলোকগত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। লেখাটা পড়ে আমি আমার ইংল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু মাহবুবুর রহমানকে ফোন করি। টেলিফোনে এ নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তারিত আলাপ হয়। সুনীল বাবুর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই নিবন্ধের অবতারণা। তবে এখানে কিছু কিছু বিষয়ের সূত্র মাহবুবের কাছ থেকে পাওয়া, আর তাই তার প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রচনাটা শুরু করছি। দার্শনিক ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুনীল বাবু যথার্থই প্রশ্নটা তুলেছেন। লেখাটা পড়ে তাৎক্ষণিক আমার মনে হয়েছে, হঠাৎ সুনীল বাবুর মনে এই পুরনো প্রশ্নটা নতুন করে কেন জেগে উঠল, আর উঠলই যখন তখন তিনি কেন বিষয়টার আরো গভীরে গেলেন না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সংক্ষেপে যা লিখেছিলেন তার মর্মার্থ দাঁড়ায় এ রকম অন্য প্রজাতির জন্তু-জানোয়াররা নিজেদের মধ্যে মারামারি করলেও তারা একজন আরেকজনকে কখনো জানে মারে না। আমরা জানি কাকের গোশত কাক খায় না, বাঘ বাঘকে খুন করে না, হরিণ হরিণের গোশত মুখে দেয় না, এমনকি একটা পিঁপড়াও আরেকটা পিঁপড়াকে বধ করে না। আহার নিয়ে ক্ষুধার্থ দুই কুকুর কাড়াকাড়ি করে, কামড়াকামড়িও করে, অবশেষে যার গায়ে জোর বেশি সেই খাবারের দখল নেয়, দুর্বল কুকুর লেজ গুটিয়ে পালায়। এখানেই তাদের মধ্যকার সঙ্ঘাতের স্থায়ী মীমাংসা হয়ে যায়। একটি আরেকটিকে হত্যা করে না বা করার প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া বিপরীত লিঙ্গের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও পশুকুলে অহরহ ঝগড়াঝাটি হতে দেখা যায়, কিন্তু কোনো সময়ই তা খুনখারাবি পর্যন্ত গড়ায় না। এখানেও দৈহিক শক্তিবলে একটা জিতে অন্যটা হেরে জঙ্গলে পালায়। ওই প্রবন্ধে লেখক আরো বলেছিলেন, একই ধরনের দ্বন্দ্বে পুরুষ মানুষ পশুর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র হতে পারে। বাইবেল থেকে সুনীল বাবু মানবজীবনের সূচনালগ্নে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের উদাহরণ টেনে এনেছিলেন। কে না জানে, হাবিল-কাবিলের কথা ইসলামেও আছে।
এবার সুনীলবাবুর বক্তব্যের পরিধিকে বাড়িয়ে বিষয়টার আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক কী আছে। পেটের খিদে ও যৌন প্রতিযোগিতায় প্রাণিকুলে স্বজাতির মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়, সঙ্ঘাত বাধে, কিন্তু মানুষের মতো একটা আরেকটাকে হত্যা করে না। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, যে বিষয়েই ঝগড়া হোক না কেন, এক পশুর প্রতি স্বজাতি আরেক পশুর একটা ন্যূনতম মমত্ববোধ বা দরদ থাকে যার জন্য তাদের মারামারিতে একটা প্রাকৃতিক সীমারেখা টানা হয়ে যায় এবং তারা সচেতনভাবে কোনো সময়ই সে রেখা অতিক্রম করে না। এটা যদি ঠিক হয়, তাহলে পশুকুল অবচেতন বা অবুঝ নয়। আর তা যদি না হয় তাহলে দ্বিতীয়টা ঠিক, অর্থাৎ তারা স্বভাবজাতভাবেই মানুষের চেয়ে কম হিংস্র। কারণ তাদের লড়াইয়ের শেষ পরিণতি কখনো মানুষের মতো এত বীভৎস, এত মারাত্মক, এত ধ্বংসাত্মক ও আত্মঘাতী হয় না। যেভাবেই দেখি না কেন বিষয়টা সভ্য মানবকুলের জন্য যে সম্মানসূচক নয় তা বলাই বাহুল্য!
এ ছাড়া মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াইয়ের ক্ষেত্রটা পশুকুলের চেয়ে আরো অনেক বেশি বিস্তৃত ও প্রসারিত। মানুষে মানুষে সঙ্ঘাত শুধু বিত্তবৈভব ও নারীর ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই হয় না, হয় আরো অনেক কারণে। যেমন সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য প্রতিপক্ষের সাথে চলছে মানুষের নিরন্তর লড়াই। এ লড়াইয়ে অনেক সময় একজন আরেকজনকে বধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার উৎস রাজনীতি। আর তাই রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ঘটে অনেক ষড়যন্ত্র ও খুনখারাবি। এ ছাড়া মানুষ যদি মনে করে কারো কারণে তার মানসম্মান অথবা সুনাম বর্তমানে নষ্ট হচ্ছে কিংবা ভবিষ্যতে হতে পারে, তবে সে তাকেও হত্যা করতে উদ্যত হতে পারে। মানুষের মধ্যে ভাড়াটে খুনিও থাকে। টাকার বিনিময়ে একজনের নির্দেশে ওই জাতীয় খুুনিরা সহজেই আরেকজনকে খতম করে ফেলতে পারে। তবে এরও চূড়ান্ত লক্ষ্যের মধ্যে অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, মানসম্মান ও নারীই প্রধান। মানুষ স্রেফ রাগের বশবর্তী হয়েও মানুষকে মেরে ফেলতে প্রবৃত্ত হয়। তবে রাগেরও মূল কারণ হতে পারে টাকা-পয়সা, জমিজমা কিংবা এ জাতীয় অনুষঙ্গ। অনেক সময় মানুষ মদগাঁজা খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে সামান্য কারণে প্রতিপক্ষের প্রাণ হরণ করতে পারে। অনিচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা বশতও মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। মিল কারখানা ও রাস্তাঘাটে যন্ত্রযান চালাতে গিয়েও একজন আরেকজনকে মেরে ফেলতে পারে। আরেকটা ঘটনা ঘটতে পারে মনুষ্যকুলে, পশুকুলে যার কোনো আশঙ্কা নেই। কিছু কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত লোক উদ্দেশ্যহীনভাবে স্রেফ পাশবিক উল্লাসে অকারণেও মানুষ মারতে পারে।
পশুর সাথে পশুর লড়াইয়ের মীমাংসা হয় কেবল দৈহিক শক্তির ভিত্তিতে। অর্থাৎ যে দুর্বল সে সবলের কাছে হেরে পালিয়ে যায়। নতুন করে লড়াইয়ের জন্য ফের ঘুরে দাঁড়ায় না। কিন্তু মানুষের মধ্যকার সঙ্ঘাতে জয়-পরাজয়ের ফয়সালা শুধু গায়ের জোরেই হয় না। এখানে আরো বিবেচ্য বিষয় আছে। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী। সে শরীরে দুর্বল হলে পালিয়ে যাওয়ার পরও নতুন বুদ্ধি এঁটে সবলকে হারানোর জন্য নতুন উদ্যমে নতুন ফন্দি নিয়ে আবার আক্রমণ রচনা করতে পারে। পশুর বেলা বুদ্ধিবৃত্তিক পুনরাক্রমণের কোনো অবকাশ থাকে না। এখানে আরেকটা ব্যাপার থাকতে পারে। মানুষের স্মৃতিশক্তি অনেক তীক্ষ, তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী। শক্তিমান প্রতিপক্ষের কাছে দুর্বল মানুষটা প্রথমবার হেরে গিয়ে পশুর মতো পালিয়ে গেলেও কিন্তু সে পরাজয়ের কথা, বেদনার কথা, অপমানের কথা সহজে ভুলে না। আর ভুলে না বলেই সে নতুন করে লড়াই পরিকল্পনা নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। যেহেতু দুর্বল একাজ করতে পারে তাই সবল তাকে আগেই খতম করারও কোশেশ করে এবং অনেক সময় সফলও হয়।
আরেকটা ব্যাপার আছে বাইবেল এবং কুরআনে যার যোগসূত্র পাওয়া যায়। মানুষের পেছনে ক্রমাগত কাজ করে যায় শয়তান বা ইবলিস। শয়তানের ধর্মই হচ্ছে মানুষকে খারাপ কাজে কুমন্ত্রণা দেয়া ও ভালো কাজ থেকে দূরে রাখা। খুনখারাবি একটি জঘন্য অপরাধ। এটা শয়তানের খুব প্রিয় কাজ। সে এমন কাজে সর্বদা মানুষকে ওসওয়াসা দিতে থাকে, কোনো কোনো সময় সফলও হয়। শয়তান যখন বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয়ে বেরিয়ে আসে তখন সে আল্লাহর কাছে এই শক্তি চেয়ে নিয়েছে যাতে সেসব সময় আদম সন্তানকে খারাপ কাজে কুমন্ত্রণা দিতে পারে, প্রভাবিত করতে পারে। জন্তু-জানোয়ারের পেছনে লাগার জন্য শয়তান এমন বর আল্লাহর কাছে চায়ওনি, পায়ওনি।
পশুর পাশবিকতার সঙ্গে মানুষের হিংস্রতার আরেকটা বড় পার্থক্য আছে। মনুষ্যসন্তান পশুকুলের চেয়ে অনেক বেশি সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করে। যেহেতু মানুষ বৈষয়িক ও স্বার্থপর, তাই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যখন তখন স্বার্থের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো সময় এ নিয়ে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বিধ্বংসী যুদ্ধ বেধে যাওয়াও অসম্ভব নয়। যুদ্ধে নিজ নিজ দেশের সীমানা রক্ষা করা যার যার সেনাবাহিনীর পবিত্র দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। এ জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এক দেশের সেনাবাহিনী আরেক দেশের সৈন্যদের এমনকি বেসামরিক জনগণকেও হত্যা করতে পারে। এতে দেখা যায় মানুষ যেমন বদমতলবে মানুষ মারতে পারে তেমনি আবার সৎ ও মহৎ কারণেও স্বজাতির প্রাণসংহার করতে কসুর করে না। পশুদের মধ্যে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
পবিত্র কুরআনের সূত্র ধরে আরেকটা কথা বলা যায়। আল্লাহ পশুকে এমন স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে তারা সবসময়ই পশুর মতো আচরণ করে। পক্ষান্তরে মানুষকে তিনি বানিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ অবয়বে। কিন্তু সময় সময় সে আবার পশুর মতোও হয়ে যেতে পারে। আবার কখনো বা পশুর চেয়েও অধম হতে পারে তার আচার ব্যবহার। আর এসব বাস্তবতার মধ্যেই উত্তর পাওয়া যেতে পারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উত্থাপিত এ কঠিন ও জটিল প্রশ্নের।
লেখক: অধ্যাপক, টেনেশি স্টেইট ইউনিভার্সিটি; এডিটর-জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ