ভারতে নারী অবমাননার ভয়াবহ রূপ
আইন ও পুলিশ প্রশাসনের পরোয়া না করে দিল্লি তথা গোটা ভারতে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা নগ্ন করে তুলছে ভারতের ভাবমূর্তিকে। প্রতিকার নিয়ে চিন্তিত গোটা সমাজ।
দিল্লি ও ভারতের অন্যান্য শহরে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা কমছে তো না-ই, বরং বেড়েই চলেছে। প্রতি ২০ মিনিটে একটি ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটছে। উদ্বেগের বিষয়, ইদানীং আবার বিদেশিনীরাও এর শিকার হচ্ছেন।
গত ৭ই মে শনিবারের ঘটনা। দিল্লির কাছে ২৫ বছরের এক বেলজিয়ান তরুণীর শ্লীলতাহানি করে ওলা কোম্পানির এক ট্যাক্সি চালক। পুলিশ অবশ্য ট্যাক্সি চালককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। বছর দেড়েক আগে এক জার্মান তরুণীকে যৌন হেনস্থা করে দিল্লির এক অটোরিকশা চালক। তারই মাস দুয়েক আগে নিউ দিল্লি রেলস্টেশনের কাছে ৫২ বছরের এক ডেনিশ মহিলাকে গণধর্ষণ করে জনা সাতেক ব্যক্তি। ঐ সময়েই শ্লীলতাহানির অভিজ্ঞতা হয় এক মার্কিন এবং এক উগান্ডান মহিলার। এই রকম অনেক আছে। এ তো শুধু হিমশৈলের চূড়ামাত্রা।
প্রথম প্রথম মনে করা হতো, ভারতে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানি নিবারণে চলতি আইন যথেষ্ট কড়া নয়। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হয় না। আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। নারীবাদী সংগঠনগুলির বক্তব্য, যেহেতু চলতি ‘অ্যান্টি-রেপ’ আইনে স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই, তাই বিচারকদের নিজস্ব বিচারবোধের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। অর্থাৎ বিচারক যদি মনে করেন ধর্ষকের অপরাধ ততটা গুরুতর নয়, যতটা ধর্ষিতা বলছে, সেক্ষেত্রে অপরাধীর লঘু শাস্তি হয়। কিংবা ধর্ষিতা কুমারী না বিবাহিতা, মহিলার চরিত্র ত্রুটিমুক্ত কিনা এসবও বিচার্য হয়। সেক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ, প্রলম্বিত ও জটিল বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত না হলে সাক্ষ্য প্রমাণ দুর্বল হয়ে পড়ে। দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণকা-ের পর এই সংক্রান্ত আইন কঠোর করতে ভার্মা কমিশনের সুপারিশ মেনে তা সংশোধন করা হয়। অপরাধী সাব্যস্ত হলে আসামীর হয় যাবজ্জীবন জেল বা বিরল ঘটনার ক্ষেত্রে ফাঁসি হতে পারে। তাতেও সংখ্যাটা কমেনি, বরং বাড়ছে। শুধু কি তাই? ফাঁসির দড়ি নিয়েও দড়ি টানাটানি। ভারত নিজে জাতিসংঘে ফাঁসির বিরোধিতা করে এসেছে। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলিও ফাঁসিকে বলেছে চরম নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক। মহিলাদের নিরাপত্তা বাড়াবার পন্থা নয়। আসলে সমস্যার শিকড় আরও গভীরে যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুর্নীতিগ্রস্ত পচাগলা এই সমাজ ব্যবস্থা। শুধু কঠোর আইনই যথেষ্ট নয়, এর সঠিক বাস্তবায়নও একান্ত জরুরি। দ্রুত বিচারের জন্য ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট তারই অঙ্গ।
এরই জের টেনে দিল্লির নারীবাদী জাগরি সংগঠনের মুখপাত্র ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘আইন কানুন যা আছে তা আছে, তবে আসল কথা পুরুষদের মাইন্ড-সেট বা মানসিকতায় আনতে হবে পরিবর্তন। নারীদের যে একটা আলাদা ব্যক্তি পরিচয় আছে, সেটাকে সম্মান দিতে হবে। মহিলা বলেই তাঁকে অন্য চোখে দেখতে হবে, এ কেমন কথা? এখানে সরকারের চেয়ে বড় ভূমিকা পুরুষ নাগরিক সমাজের।” বেলজিয়ান তরুণীর শ্লীলতাহানি প্রসঙ্গে জাগরির বক্তব্য, ‘‘এটা দেশি বা বিদেশি মহিলার প্রশ্ন নয়, সমগ্র বিশ্বের নারী সমাজের।” অতি সম্প্রতি কেরালা রাজ্যে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দোষী ব্যক্তির শাস্তির দাবিতে আগামীকাল দিল্লিতে বের হবে প্রতিবাদ মিছিল।
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন।
দরকার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন
ভারতে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা ‘নগ্ন’ করে তুলছে দেশের ভাবমূর্তিকে। একদিকে ‘দুর্বল’ আইন অন্যদিকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ধর্ষিতা নারীর মানসিক অবস্থাকে আরও ভেঙ্গে দিচ্ছে।
সম্প্রতি ভারতে ২১ বছর বয়সি এক কলেজছাত্রীকে দ্বিতীয়বারের মতো ধর্ষণ করেছে পুরনো অপরাধীরা। তিন বছর আগে তাদের দ্বারাই গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক দলিত নারী। অথচ এই তিন বছরে ঐ পাঁচ অপরাধীর কেউ নিজেদের শোধরানোর চেষ্টা করেনি, একটু অনুশোচনাও হয়নি তাদের। বরং জামিন পাওয়ার পর থেকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল তারা।
আর তিন বছর পর সেই পাঁচ জনই আবার ‘বদলা’ নিয়েছে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। মেয়েটির ‘অপরাধ’ সে আদালতে সেই উচ্চবর্ণের পুরুষদের বিচার দাবি করেছিল। প্রথমে তারা মেয়েটিকে কলেজের সামনে থেকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। রাজি না হওয়ায় আবারও গণধর্ষণ।
এ কেবল একটি ঘটনা মাত্র। ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে ঘটছে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির ঘটনা। রাজধানী দিল্লিসহ অন্যান্য শহরেও এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে।
ভারতের ধর্ষণবিরোধী আইনে স্পষ্ট নির্দেশনা নেই, তাই বিচারকদের নিজস্ব বিচারবোধের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের ‘ন্যায়বিচার’ থেকে বঞ্চিতও হতে হয়। অর্থাৎ বিচারক যদি মনে করেন ধর্ষকের অপরাধ ততটা গুরুতর নয়, যতটা ধর্ষিতা বলছে, সেক্ষেত্রে অপরাধীর লঘু শাস্তি হয়। কিংবা ধর্ষিতা কুমারী না বিবাহিতা, মহিলার চরিত্র ত্রুটিমুক্ত কিনা এসবও বিচার্য হয়। তাই অপরাধী অনেক সময় বেকসুর খালাসও পেয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, ভারতের আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত না হলে সাক্ষ্য-প্রমাণ দুর্বল হয়ে পড়ে। দিল্লিতে নির্ভয়া গণধর্ষণকান্ডের পর এই সংক্রান্ত আইন কঠোর করতে ভার্মা কমিশনের সুপারিশ মেনে তা সংশোধন করা হয়। এখন দোষী সাব্যস্ত হলে আসামীর হয় যাবজ্জীবন জেল বা বিরল ঘটনার ক্ষেত্রে ফাঁসিও হতে পারে।
এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিকৃত মানসিকতার পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতা আর দেশের বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি তো রয়েছেই। ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ প্রথমে চেষ্টা করে, অভিযোগ না নিয়ে লোকলজ্জার ভয় দেখিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে টাকা-পয়সা দিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে। অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিয়েও ‘ফয়সালা’ করা হয়। -ডয়চে ভেলে