বিরামহীন গৃহযুদ্ধ অন্তহীন ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে সিরিয়া

Syriaচলে গেল আলি। ওমরানের ছোট ভাই। বয়স দশ। সিরিয়ার যুদ্ধে হত শিশুর তালিকায় যুক্ত হল আর একটি নাম। যে নামের তালিকা পড়তেই নাকি লেগে যাবে ১৯ ঘণ্টা। যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ। বিশ্বশক্তির নানা স্বার্থ। আর তার যুপকাষ্ঠে বলি আলান-ওমরানরা। ওমরানের রক্তমাখা মুখ।  সৈকতে মুখ থুবড়ে থাকা আলানের দেহ। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কোনও অন্ত নেই।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে শেষ পর্যন্ত এই অবস্থায় পৌঁছবে তা সুদূর কল্পনাতেও ছিল না। ‘আরব বসন্ত’-এ অনুপ্রাণিত হয়ে যারা আসাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছিলেন তারা কি ভেবেছিলেন এই পরিণতির কথা? শিয়া সংখ্যালঘু (আলওয়াতি) বাশার সরকারের শাসন, স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল সেই জনগোষ্ঠী প্রধানত সুন্নি। অতএব শিয়া-সুন্নির ঐতিহাসিক বিভাজন থেকে রক্তপাত শুরু হতে সময় লাগেনি। আর তা তৈরি করেছে সংঘর্ষের এক বিপুল প্রেক্ষাপট। আসাদ-বিরোধী শক্তিকে সমর্থন দিতে আরব লিগ সক্রিয় হতেই কালবিলম্ব না করে নেমে পড়ে ইরানও।
আর এই পরিস্থিতি আমেরিকার পক্ষেও চুপ করে থাকা সম্ভব ছিল না। সিরিয়ার সঙ্গে মার্কিন ‘সুসম্পর্কে’র কারণে স্বাভাবিক ভাবেই আসাদ-বিরোধী শক্তির দিকেই মার্কিন সমর্থন ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির আমূল বদল করে আসাদ-বিরোধী যুদ্ধে মগ্ন সিরিয়ার মঞ্চে আবির্ভূত হয় ইসলামিক স্টেট (আইএস)। শুধু আসাদকে সরানো নয় সিরিয়া, ইরাক, ইরান জুড়ে কথিত এক কঠোর ইসলামিক অনুশাসনে আবদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে আসেন আবু বকর আল-বাগদাদি। ২০১৪-এর মাঝামাঝি থেকে সিরিয়ার ও ইরাকের বিপুল অংশ জুড়ে সেই স্বপ্ন সফলও হতে থাকে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আর শুধু পশ্চিম এশিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে আটকে থাকে না। আসাদ বিরোধী আমেরিকাকে এ বার আইএস-এর ত্রাসের সঙ্গে লড়াই নামতে হয়। এক দিকে, আসাদ বিরোধী নিরপেক্ষ শক্তিকে সমর্থন (অর্থ ও অস্ত্র জুগিয়ে)। অন্য দিকে, আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জোট তৈরি, টলমল ইরাককে রক্ষা করা। আমেরিকা যখন এই দ্বিমুখী সমস্যা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত তখন মঞ্চে আবির্ভাব ভøাদিমির পুতিনের। ইরান ও আসাদের পায়ের মাটিকে শক্ত করার পাশাপাশি ন্যাটোর প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসেবে রাশিয়ার পেশি আস্ফালনের সুযোগ ছাড়তে রাজি নন পুতিন। তাই আফগানিস্তানের পরে প্রথম কোনও মুসলিম দেশের সরকারকে রক্ষা করতে হাজির হয় রাশিয়ার সেনা।
এই বহুমুখী লড়াই-এ লেভান্ত (সিরিয়া ও ইরাক) জুড়ে অবিশ্রান্ত রক্ত ঝড়ে চলেছে। নানা সংস্থার হিসেবে পার্থক্য থাকলেও মৃতের সংখ্যা চার লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। গৃহহারা প্রায় ৭৬ লক্ষ। আর দেশ ছেড়েছেন ৪৮ লক্ষ নাগরিক। জর্ডন, লেবানন, তুরস্ক ছাড়িয়ে শরনার্থীর অভিঘাতে ইউরোপের নাভিশ্বাস।
আইএস পশ্চিম এশিয়া ছেড়ে ইউরোপের অন্দরে ডালপালা বিস্তার করেছে। প্যারিস, ব্রাসেলস, মিউনিখ আইএসের কাছে হামলা চালানো আজ জলভাত। পূর্ব এশিয়াও সন্ত্রস্ত। একটি দেশের সমস্যার এই বিপুল বিশ্বজনীন অভিঘাত এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি।
কূটনীতির অন্তহীন কূটকচালিরও পরেও সিরিয়ার কোনও সমাধান সূত্রের দেখা মিলছে না। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন-সহ বেশ কিছু দেশ আইএস-এর উপরে লাগাতার হামলা চালাচ্ছে। একই ধরনের হামলা চালাচ্ছে রাশিয়াও। কিন্তু তার লক্ষ্য আইএস-এর পাশাপাশি আসাদ বিরোধী শক্তিও। ফলে আলেপ্পোর মতো ঐতিহাসিক শহর আজ ধ্বংসস্তূপ। আর সেই স্তূপের ভিতরে বন্দী ওমরানের মতো শত শত শিশু আর তাদের পরিবার। প্রায় চারশো বার চিকিৎসা কেন্দ্রের উপরে হামলা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসক মিলিয়ে হত প্রায় ৭০০ জন।
বিমানহানা থেকে বাঁচতে গাড়ির টায়ার জ্বালিয়ে কালো ধোঁয়া তৈরি করা হচ্ছে। আর সেই কাজটুকুই একমাত্র খেলা এই আটকে থাকা শিশুগুলির। কয়েক দিন আগে ইরান তার বিমানঘাঁটি রাশিয়ার ব্যবহারের জন্য খুলে দিয়েছে। এতে আরও কম সময়ে আলেপ্পোর মতো আসাদ-বিরোধী কিন্তু মার্কিন সমর্থিত অঞ্চলগুলিতে পৌঁছে যাবে রাশিয়ার বোমারু বিমান। ফলে ভবিষ্যৎ নিকষ অন্ধকার।
ভিয়েনার ভিয়ানে শুধু আশ্বাসবাণী আর রাষ্ট্রশক্তির স্বার্থ জারিত হচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জসহ নানা আন্তর্জাতিক সংগঠন, হাজারো মানবাধিকার সংগঠনের আর্তি উত্তর মিলছে না। আকাশ থেকে অবিরাম বোমাবর্ষণ, কুন্দদের সাহসী লড়াই, ইরাকি সেনার মনোবল ফিরে পাওয়ায় আজ আইএস কোণঠাসা। কিন্তু বোমাও তো শুধু জঙ্গি মরে না এই বিপুল ‘কোলল্যাটরাই ড্যামেজ’-এর দায়িত্ব কার। উত্তর মেলে না। -আনন্দবাজার

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button