লাব্বাইক ধবনিতে প্রকম্পিত আরাফাতের ময়দান

Hajjআজ পবিত্র হজ। লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বায়েক ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুল্‌ক লা শারিকা লাক্- ‘আমি উপস্থিত, হে আল্লাহ আমি উপস্থিত, তোমার কোনো অংশীদার নাই, সকল প্রশংসা ও নেয়ামত শুধু তোমারই, সকল রাজত্বও তোমার, তোমার কোনো অংশীদার নাই’ -ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে আজ আরাফাত ময়দানে সমবেত হয়ে হজ পালন করবেন প্রায় ১৫ লক্ষাধিক মুসলমান।
হজযাত্রীদের এহরাম বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এটা হজের মৌলিক আহকামগুলোর (অপরিহার্য পালনীয়) একটি। তবে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে গতকাল শনিবার থেকে। হাজীরা সউদী আরবের সময় অনুযায়ী ৭ জিলহজ শনিবার মাগরিব সালাত আদায়ের পর মিনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। গতকাল দিনভর মিনায় অবস্থানের পর রাতে যান মানব জাতির আদি পিতা আদম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মা হাওয়া আলাইহাস সালামের মহামিলনের স্মৃতি বিজড়িত আরাফাতের ময়দানে।
হজের প্রশিক্ষক মহানবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল-হাজ আরাফাহ অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানই হজ। যে ৯ যিলহজ আরাফাতে অবস্থান করল তার হজ হয়ে গেল। সুন্নাতি তরিকায় ৯ যিলহজ সূর্যোদয়ের পর আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করার কথা থাকলেও যানজটের বিড়ম্বনা এড়াতে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই হজযাত্রীদের ১৪ কিলোমিটার দূরবর্তী আরাফাতের ময়দানে স্থানান্তরের কাজ শুরু করেন দক্ষিণ এশীয় মুতাওয়িফ সংস্থার নিয়োজিত মুয়াল্লেমগণ। আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ফরজ। আরাফাত ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামেরা থেকে দুপুরে হজের খুৎবা দেয়া হবে। এখানে খুৎবার পর এক আযানে দুই একামাতে যোহর ও আসর কসর (দুই রাকআত করে) আদায় করবেন হজযাত্রীরা। মহানবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঐতিহাসিক বিদায় হজের স্মৃতি বিজড়িত আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করে হাজীরা আল্লাহর যিক্র ও তসবীহ তাহলিল আর দুই হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে জীবনের সব গুনাহ-খাতার জন্য ক্ষমা চাইবেন। এছাড়াও দেশ, জাতি ও মুসলিম জাহানের শান্তি ও অগ্রগতির জন্য আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করবেন।
আরাফাতে অবস্থানের মাধ্যমে হজ কবুল হলেই হজ পালনকারী মাসুম অর্থাৎ গুনাহমুক্ত হয়ে যাবেন। আজ সূর্যাস্তের পর হাজীরা ৮ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করবেন। মুজদালিফায় এসে একই আযানে মাগরিব এবং ইশা এক সাথে আদায় করে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করবেন এবং মুজাদালিফা থেকে জামারায় নিক্ষেপের জন্য পাথর সংগ্রহ করবেন। এরপর পরদিন বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পূরণের লক্ষ্যে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে রাত যাপন করবেন। মুজদালিফায় রাত্রি যাপনের পর আগামীকাল সকালে সূর্যোদয়ের পর জামারায় পাথর নিক্ষেপের জন্য রওয়ানা হবেন হাজীরা। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে যাবার পূর্বে জামারাতুল আকাবায় (বড় জামরায়) ৭টি পাথর নিক্ষেপ করবেন। জামরাতুল আকাবায় পাথর নিক্ষেপের পর হাজীরা পশু কুরবানী করবেন।
তবে সউদী হজ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক আযাহি সংস্থার মাধ্যমে কুরবানী করতে হয়। এ সংস্থা দীর্ঘদিন থেকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে হাজীদের কুরবানীর ব্যবস্থা করে আসছে। হাজীরা নির্ধারিত বুথে কুরবানীর টাকা জমা দিয়ে টিকেট সংগ্রহের মাধ্যমে এই কুরবানী করেন। বুথ থেকে টিকেট সংগ্রহের সময় দেয়া কুরবানীর সময় পার হবার পর হাজীগণ মাথা মুন্ডন করে ইহরাম খুলে স্বাভাবিক কাপড় পরিধান করবেন। একে তাহাল্লুলে আসগর বলা হয়। তাহাল্লুলে আসগরের সময় স্ত্রীসঙ্গ ব্যতীত সবকিছু হালাল হয় আর তাহাল্লুলে আকবর-এর পর সবকিছু হালাল হয়। তাহাল্লুলে আসগরের পর হাজীগণ পবিত্র কাবা শরীফে গিয়ে তাওয়াফে ইফাযা (ফরয তাওয়াফ) সম্পন্ন করবেন এবং সায়ী করবেন। এর মাধ্যমে তাহাল্লুলে আকবর হয়ে যাবে।
এরপর মিনায় ফিরে এসে ১১ ও ১২ জিলহজ সেখানে অবস্থান করে ছোট, মধ্যম ও বড় জামরায় পাথর নিক্ষেপ করে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করে মক্কার বাসস্থানে ফিরে আসবেন। এরপর দেশে ফিরে আসার পূর্বক্ষণে কাবা শরীফে গিয়ে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।
এদিকে নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এ বছর প্রায় হাজার খানেক নতুন পর্যবেক্ষণ ক্যামেরা লাগানো হয়েছে পবিত্র হারাম শরীফ এবং জামারাতে। এসব ক্যামেরা অন্যান্য বছরের চেয়ে গভীর ভাবে বিভিন্ন স্থান পর্যবেক্ষণ করবে। এ বছর প্রথম বারের মতো হজযাত্রীদের বিশেষ ধরনের ইলেক্ট্রনিক ব্রেসলেট প্রদান করা হয়েছে যা তাদের অবস্থান ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে। পানি নিরোধক এবং জিপিএস-এর সাথে সংযুক্ত এই ব্রেসলেট হজযাত্রীদের সালাতের সময় এবং বিভিন্ন পালনাদি সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন ভাষায় নির্দেশনা প্রদান করবে।
এদিকে মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের সময় দুর্ঘটনা এড়াতে হাজীদের ভাগ ভাগ করে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে সউদী হজ কর্তৃপক্ষ। গত বছর মিনায় পাথর নিক্ষেপের সময় পদদলিত হয়ে ৭৫০ জন হাজীর মৃত্যু হয়। এরপরই হজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের উদ্যোগ নেয় সউদী কর্তৃপক্ষ।
সরকারি বার্তা সংস্থা সউদী গেজেট জানিয়েছে, অবৈধ হজযাত্রীদের আটকে বাহিতা ও হাদা এলাকায় ১ হাজার ২০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে হাজীদের নিরাপত্তায় দ্রুত তিন হাজার উদ্ধার ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র স্থানান্তরে ১৭ হাজার কর্মী মোতায়েন করেছে বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ। হজের পাঁচদিন মক্কা ও পবিত্র স্থানগুলো পরিষ্কারের জন্য ২৬ হাজার কর্মীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সউদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হাজীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য মক্কায় পর্যাপ্ত জনবল, ওষুধ ও যন্ত্রপাতিসহ আটটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া মিনা, আরফাতের ময়দান ও মুজদালিফায় ২৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। চলতি বছর মাতাফের (পবিত্র কাবার চারপাশে তাওয়াফের স্থান) স্থানও সম্প্রসারিত করেছে সউদী কর্তৃপক্ষ।
মক্কা শরিফের রক্ষণাবেক্ষণ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এবার ঘণ্টায় ৩০ হাজার হাজী একসঙ্গে তাওয়াফ করতে পারবে। এর আগে এখানে ১৯ হাজার হাজী একসঙ্গে তাওয়াফ করতে পারত। এছাড়াও আরাফাত ও মুজদালিফায় হাজীদের পিপাসা নিবারণের জন্য ১৫ লাখ গ্যালন জমজমের পানি প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button