হজের খুতবায় বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের আহ্বান

Sudaisযথাযথ মর্যাদার সাথে রবিবার পবিত্র হজ পালিত হয়েছে। হজের সবচেয়ে দৃশ্যমান রুকন বা উকুফে আরাফা আদায় করেছেন হাজিরা। অর্থাৎ তারা মক্কা মুয়াজ্জমার অনতিদূরে  ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান  করেছেন। তারপর মুজদালিফায় গিয়ে রাত্রিযাপন করেছেন।
সোমবার তারা মিনায় জমারায় পাথর নিক্ষেপ ও  কুরবানি করার পর মাথা মুণ্ডাবেন বা চুল ছাঁটবেন এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবেন। রবিবার  ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়াননিমাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকা লাক’ ধ্বনিতে সারা দিন মুখরিত ছিল আরাফাতের ময়দান।
শুক্রবার পবিত্র মসজিদুল হারামে জুমার নামাজ আদায়ের পর অনেকেইে রাতে মিনায় পৌঁছেন হজ করতে যাওয়া মুসলমানরা। বাকিরা যান শনিবার ফজরের নামাজ আদায়ের পর। শনিবার রাতে  মিনা থেকে প্রায় ৯  কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন তারা। বাকিরা যান রবিবার সকালে। সৌদি আরবের স্থানীয় সময় অনুযায়ী ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে দ্বিপ্রহরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করেন হাজীরা।
আরাফাত থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় গিয়ে রাত্রিযাপন করেন। সেখানে মিনায় জামারাতে  নিক্ষেপের জন্য তাঁরা পাথর সংগ্রহ করেন।  রবিবার ১০ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে মুজদালিফা থেকে আবার মিনায় ফেরেন তাঁরা। এখানে বড় শয়তানকে পাথর মেরে, কোরবানি করে মাথা মুণ্ডন করবে। পরে কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন তাঁরা। এই তাওয়াফকে বলা হয় তাওয়াফে জিয়ারত যা হজের তিনটি রুকনের একটি।  পরে মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ সেখানে অবস্থান করবেন তাঁরা। সেখানে প্রতিদিন তিন শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন মুসলমানরা।
এ বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০ লাখ মুসলমান মক্কায় হজ করতে গেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে হজ করতে গেছেন এক লাখ এক হাজার ৭৫৮ জন।দীর্ঘ ৩৫ বছর পর এবারই প্রথম মক্কার গ্র্যান্ড  মুফতি আবদুল আজিজ আলে শায়খের অসুস্থতার কারণে তার স্থানে মুফতি সালিহ বিন হুমাইদ হজের খুতবা প্রদান করেন এবং মসজিদে নামিরায় জোহর ও আসরের নামাজে  ইমামতি করেন।
আরাফাত ময়দানে উপস্থিত কয়েক লাখ হাজিদের উদ্দেশে খুতবা প্রদান শুরু হয়েছে। স্থানীয় দুপুর সোয়া ১২টায় খুতবা শুরু হয়।  এ সময়ে সৌদির আরবের সামরিক-বেসামরিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও আমন্ত্রিত বিশিষ্টজনরা মসজিদে উপস্থিত ছিলেন।
হজের খুতবার শুরুতে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা, মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করে গোটা বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়।
খুতবায় ধর্মীয় উগ্রতা ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান নতুন খতিব ড. সালেহ বিন হুমাইদ।
খুতবাতে তিনি বলেন, ‘মুসলমানরা ভাই-ভাই। আমাদের সেভাবে চলতে হবে। ইসলাম মানবতার ধর্ম, সহানুভূতির ধর্ম। ইসলাম গ্রন্থিত হয়েছে ন্যায় বিচার দ্বারা, সততা দ্বারা ও ভালো ব্যবহার দ্বারা। এটা আমাদের মানতে হবে। আপনারা এটা মানবেন, আপনারা নিরাপদ ভূমিতে যেভাবে চলছেন হজ পরবর্তী জীবনে সেভাবেই চলবেন’।
খুতবায় আরো বলা হয়, মুসলমানরা এক। একজনের থেকে আরেকজনকে আলাদা করার সুযোগ নেই পরস্পরের প্রতি দয়া ও ভালবাসা প্রদর্শন করতে হবে। পরস্পরের মঙ্গল কামনা করতে হবে।নির্যতিত ফিলিস্তিন, ইরাক, ইয়ামেন মুসলমানদের জন্য দোয়া করেন এবং মুক্তি কামনা করা হয় ।
তাছাড়া খুতবায় হজ, কুরবানি, হলক, কসর, মিনায় কংকর নিক্ষেপ, তাওয়াফে জিয়ারাতসহ হজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়সহ ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহর আগামী দিনের করণীয় কি হবে, সে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়।
হজ উপলক্ষে এবার মক্কায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিনায় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের সময় যেন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সেজন্য ভাগ ভাগ করে মুসলমানদের সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে সৌদি হজ কর্তৃপক্ষ। গত বছর মিনায় পাথর নিক্ষেপের সময় পদদলিত হয়ে ৭১৭ জনের মৃত্যু হয়।
এ বছর হজ করতে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিতের জন্য ইলেকট্রনিক ব্রেসলেট সরবরাহ করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি ব্রেসলেটে বারকোড রয়েছে এবং এটি অ্যাপসের মাধ্যমে স্মার্টফোনের সঙ্গে সংযুক্ত। এই ব্রেসলেটে হাজিদের ব্যক্তিগত এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য রয়েছে। এটি তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি জরুরি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সুবিধা দিচ্ছে।
মক্কায় দ্রুত ভিড় অপসারণ এবং যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। হজ পালন করতে যাওয়া ব্যক্তিদের পথ চলা ও দিক নির্দেশনার জন্য সাড়ে চার হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। হজের অনুমতি না থাকা কোনো ব্যক্তি যেন মক্কায় প্রবেশ করতে না পারে এজন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অবৈধ ব্যক্তিদের আটক করতে বাহিতা ও হাদা এলাকায় এক  হাজার ২০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার অভিযানের জন্য ১৭ হাজার কর্মী মোতায়েন করেছে বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ। হজের পাঁচ দিন মক্কা ও পবিত্র স্থানগুলো পরিষ্কারের জন্য ২৬ হাজার কর্মীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে,  স্বাস্থ্যসেবার জন্য মক্কায় পর্যাপ্ত জনবল, ওষুধ ও যন্ত্রপাতিসহ আটটি হাসপাতাল চালু আছে। এ ছাড়া মিনা, আরফাতের ময়দান ও মুজদালিফায় ২৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
চলতি বছর মাতাফের (পবিত্র কাবার চারপার্শ্বে তাওয়াফের স্থান) স্থানও সম্প্রসারিত করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। মক্কার রক্ষণাবেক্ষণ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এবার ঘণ্টায় ৩০ হাজার মানুষ একসঙ্গে তাওয়াফ করতে পারবে। এর আগে এখানে ১৯ হাজার ব্যক্তি একসঙ্গে তাওয়াফ করতে পারত।
সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষ আরো জানিয়েছে, এবার মাতাফ ও হারামের দ্বিতীয় তলায় প্রতিঘণ্টায় এক লাখ সাত হাজার হাজির স্থান সংকুলান হবে। আর আরাফাহ ও মুজদালিফায় হাজিদের পিপাসা নিবারণের জন্য ১৫ লাখ গ্যালন জমজমের পানি প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button