নদী ভাঙনে ক্ষয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
আখতার হামিদ খান: নদী ভাঙনের কবলে পড়ে প্রতি বছর প্রায় বাংলাদেশে ২৫ হাজার একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সহায়-সম্বল হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ লোক নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। সে সঙ্গে ২ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকা বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। বর্তমানে প্রতিবছর নদী ভাঙনে গৃহহীন উদ্বাস্তু লোকের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ হারে বাড়ছে। এতে বছরে ৩শ’ থেকে ৫শ’ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (আইএফআরসিএস) এর দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান বব ম্যাকরো গত ২০১৫ সাল নদী ভাঙনকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, নদী ভাঙন এ দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে যে কোন দুর্যোগের চেয়ে বেশি মাত্রায় ধ্বংস করছে, কিন্তু এ নিয়ে খুব কম সংখ্যক লোকই মাথা ঘামায়। তার ভাষায় এটি একটি, “Slow, Slient Disaster”.
বছর ধরে নীরবে চলে: বাংলাদেশের মোট আয়তনের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই প্রধান তিনটি নদ-নদী অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। প্রধান তিন নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ছাড়াও নদী বিধৌত বাংলাদেশের ছোট বড় নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৩০০টি। এসব নদ-নদীর তটরেখা যার দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্রায় ২৪ হাজার ১৪ কিলোমিটার। এরমধ্যে কমপক্ষে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার তটরেখা নদী ভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তাই এ দেশের নদী ভাঙন একটি অতি প্রাচীন ও ভয়াবহ সমস্যা। পুরো বর্ষাকাল জুড়েই চলতে থাকে ভাঙনের তা-বলীলা। বর্ষা শেষে ভাঙনের প্রকোপ কিছুটা কমলেও সারা বছর জুড়ে তা কমবেশি মাত্রায় চলতে থাকে। নদী ভাঙনের জন্য প্রধানত নদীর ক্ষয়ক্রিয়াই দায়ী। নদীর ¯্রােতের বেগ যত বেশি হবে এবং যত বেশি কৌণিকভাবে আঘাত করবে, তত বেশি করে নদীর কূল ভাঙবে। তাছাড়া, প্রবল ঢেউ সৃষ্টি করে। ঢেউয়ের আঘাতে নদীর পাড়ের ভিতরের দিকের নরম কাদামাটি ক্ষয় হয়ে ওপরের মাটিসহ ধসে পড়ে। আর এভাবেই নদী ভেঙে নিয়ে যায় মানুষের বসতভিটা, মাথা গোঁজার ঠাঁই, চাষের জমি, গাছ-পালা, দোকানপাট, মসজিদ-মন্দির, স্কুল-কলেজ আর পূর্ব পুরুষের স্মৃতি।
উপেক্ষায় মানুষ মরে: নদী ভাঙন এদেশের একটি বড় ধরনের দুর্যোগ হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। এমনকি ১৯৯৩ সালের পূর্বে নদী ভাঙন সমস্যা সরকারিভাবে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবেও চিহ্নিত ছিল না। ১৯৯৩ সালের জুন মাসে নদী ভাঙন সমস্যাকে জাতীয় দুর্যোগ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এ ব্যাপারে সঠিক কোন পরিসংখ্যান সরকারি বা বেসরকারি কোন সংস্থায় নেই। ১৯৯২ সালের ১৫ জুন, দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে,‘১৯৭২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উনিশ বছরে দেশে নদী ভাঙনের সংখ্যা ৮৪৮টি। এ সময়ে ছোট-বড় ৭৭টি নদীর কূল ভেঙেছে। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশীপ সেন্টার (বিডিপিসি) কর্তৃক ১৯৯২ সাল থেকে ২০৯৪ সাল পর্যন্ত এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫১টি জেলায় নদী নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার ২শ’ ৭০ একক জমি। জরিপে আরও বলা যায়, নদী ভাঙনে উদ্বাস্তু গৃহহীন ভাসমান মানুষের সংখ্যা প্রতি বছর ২ লাখ ৫০ হাজার করে বাড়ছে। এ বিপুলসংখ্যক মানুষ বাঁধ, রাস্তা, পরিত্যক্ত জমি প্রভৃতি স্থানে ভাসমান এবং মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এদের মধ্যে বৃহদাংশ হচ্ছে শহরমুখী। বিশিষ্ট ভূগোলবিদ প্রফেসর কে. মউদুদ ইলাহীর মতে, প্রতিবছর নদী ভাঙন এলাকা থেকে ২০-৩০ শতাংশ বাস্তুহারা জনগোষ্ঠী নিকটবর্তী শহরে এবং বড় শহরে অভিগমন করে থাকে। ঢাকা শহরের বিপুল সংখ্যক বস্তিবাসীর প্রায় ২৫ শতাংশ নদী ভাঙনজনিত কারণে রাজধানী শহরে ছুটে এসেছে (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ দুর্যোগ প্রতিবেদন ২০১৪। ফলে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে ব্যাপক হারে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। ঢাকা শহরের রিকশাওয়ালাদের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে যে, এই রিকশাওয়ালাদের শতকরা দশভাগ নদী ভাঙন কবলিত হয়ে এই পেশা বেছে নিয়েছে। এদের এক বড় অংশ আবার হিজলা, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, চিলমারী, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি নদী ভাঙন প্রকট এলাকা থেকে এসেছে।
নদী ভাঙনে বছরে কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ওই ক্ষতির আনুমানিক অর্থ মূল্য কত তা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষকের প্রস্তুতকৃত তথ্যে বেশ অনেকখানি পার্থক্য দেখা যায়। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের তৈরি করা পরিসংখ্যানটি নীচে দেয়া হল-
পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সূত্রমতে, মোট ৫৮টি জেলার ৭৭টি নদীতে ২১০টি থানার ৮৫টি শহর ও বন্দরসহ মোট ২৪৩টি স্থানে ভাঙন প্রবণতা রয়েছে। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, টাঙ্গাইল, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রংপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, ভোলা, চট্টগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং জামালপুর জেলায় ভাঙনের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, কুশিয়ারা, তিস্তা-খোয়াই, সুরমা, মনু, সাঙ্গু, গোমতী প্রভৃতি নদ-নদীতে ভাঙনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
খেয়ালি নদীর ভাঙনের খেলা: বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিশ্বব্যাংক, ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, বাংলাদেশে ‘খেয়ালি’ নদীগুলোর ভাঙনে প্রতিবছর প্রায় ২৫ হাজার একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। আর ভাঙনের বিপরীত ক্রিয়ায় চর জাগে মাত্র আড়াই হাজার একর জমি নিয়ে। অর্থাৎ প্রতিবছর নদী ভাঙনের মাধ্যমে যে বিশাল ভূ-ভাগ প্রকৃতি আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তার মাত্র ১০ ভাগ সে ফেরত দেয় নতুন চার জাগিয়ে। গত ৩০ বছরে এভাবেই নদীর করালগ্রাসে সহায়-সম্পদ হারাতে হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে। যাদের প্রায় তিনভাগের এক ভাগই ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদ-নদী হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা। এছাড়াও পদ্মা নদীর উজানে বেশকিছু অঞ্চল এবং মেঘনার ৫টি স্থান হচ্ছে ভাঙনপ্রবণ এলাকা। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-মেঘনা অববাহিকায় নদী ভাঙনের অন্যতম কারণ নদীগুলোর বিশেষ প্রকৃতি। মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নদীর তলদেশ দিয়ে ভাঙন। নদীর এ ধরনের বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। এজন্যই বাংলাদেশের এসব নদীকে ‘খেয়ালি’ বা “Unpredictable” নামে ডাকা হয়। তীর ভাঙনের তীব্রতার কারণে ব্রহ্মপুত্র নদ প্রতিবছর গড়ে ১২৫ মিটার করে চওড়া হচ্ছে। আর ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মূল প্রবাহ গড় ১৭০ বছরে প্রায় সাড়ে চার কিঃমিঃ পশ্চিম দিকে সরে এসেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী দুই দশকের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্রতিবছর গড়ে ৫০ মিটার করে পশ্চিম সরে যাচ্ছে (১)। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার এই পশ্চিমে সরে যাওয়ার প্রবণতার কারণে সিরাজগঞ্জ শহর মারাত্মক ভাঙনের মুখে রয়েছে। যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের সময় নদী শাসন খাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করা হলেও ‘নাচুনে নদী’ নামে খ্যাত যমুনার ভাঙনকে সম্পূর্ণ বশে আনা এখনও সম্ভব হয়নি। যমুনা সেতু করতে এ যাবৎ এক হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করা হলেও নদী ভাঙন থামেনি।
গত বছরের হিসাব : পত্র-পত্রিকা থেকে সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে নদী ভঙনে প্রায় ৫ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত, কমপক্ষে ৩০ হাজার পরিবার এবং দেড় লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে। গেল বছর বর্ষার আগে থেকেই ভাঙন শুরু হয়। সে কারণেই গত বছর (২০১৪) নদী ভাঙনে কমপক্ষে তিন লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। নদী
(২০০৮-২০১৪) সাল পর্যন্ত নদী ভাঙনে ক্ষতির পরিসংখ্যান
সময় আর্থিক ক্ষতি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা
২০০৬ ৫৮০৯ মিলিয়ন টাকা ৭১৬৮ একর ১০১০৩৬৩৫ জন
২০০৮ ৩৩০১২ মিঃ টাকা ৭৭৫৬ একর ১৭৩০৯০ জন
২০১০ ২২০১ মিঃ টাকা ৪১৫১৯ একর ৩২১০০০ জন
২০১২ ১০৫৩৫ মিঃ টাকা ২২৭৭৫৫ একর ৮৯৯২৭৫ জন
২০১৪ ৩২৮৬ মিঃ টাকা ২১৯৩১০ একর ৪১৫৮৭০ জন
উৎস: বিবিএস- ২০১৫
বিশেষজ্ঞদের মতে, গতবছর দেশের প্রায় সব নদ-নদীতেই কমবেশি ভাঙনপ্রবণতা দেখা গেছে। পত্র-পত্রিকা অনুযায়ী গেল বছর দেশের কমপক্ষে ৪৭টি জেলার ১২২টি উপজেলা ভাঙন কবলিত হয়েছে। আর দেশের প্রায় ৭০টি নদ-নদী কমপক্ষে ২১৫টি পয়েন্টে ভাঙন ঘটিয়েছে।
যমুনা নাচে ধ্বংসের তালে : ২০১৪ জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জ জেলায় ৫টি উপজেলায় যমুনা নদীর ভাঙনে কমপক্ষে ৫ হাজার পরিবারের বাড়িঘর বিলীন হয়েছে। সদর উপজেলার শৈলাবাড়িতে ভাঙন ঠেকাতে তৈরি করা গ্রোয়েনের ২০০ ফুট আর এনায়েতপুরের স্পারের ১০০ ফুট যমুনায় হারিয়ে গেছে। ভাঙন ঠেকাতে তৈরি করা ১২টি স্পারের মধ্যে ৫টিই সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে (সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ০৬/৮/২০১৫)। যমুনার ভাঙনে শুভযাত্রা গ্রাম হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে (সূত্র দৈনিক জনকণ্ঠ ১৪/০৭/২০১৫)। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে নির্মাণাধীন স্পারটির প্রায় ৫০০ ফুট যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়েছে (সূত্র দৈনিক জনকণ্ঠ ০৮/৭/২০১৫)।
গেল বছর ব্রহ্মপুত্র-যমুনা কমপক্ষে ৩৪টি পয়েন্টে ভাঙন ঘটিয়েছে। আর তিস্তা নদী গত বছর ভাঙন ঘটিয়েছে কমপক্ষে ১৭টি স্থানে। গত বছরের বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই তিস্তা নদীতে প্রবল ভাঙন শুরু হয়। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম সাতনাই। ইউনিয়নের জিরো পয়েন্ট থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত ৮০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ তিস্তা নদীর দু’পাশেই ভাঙন চলেছে সমানে। এই ভাঙনের কবলে পড়ে গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে নীলফামারী ও রংপুর জেলার ৫টি থানার কমপক্ষে ৫ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়।
কীর্তিনাশা ছোবল মারে: বাংলাদেশের আর একটি প্রধান নদী পদ্মা যা ভাঙনপ্রবণতার জন্য ‘কীর্তিনাশা’ নামে খ্যাত। গত দু’শ বছরে নদী প্রায় ১৬ কিঃ মিঃ পূর্ব দিকে সরে এসে চাঁদপুরের উত্তরে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এতে স্থলভাগের প্রায় ৯শ’ বর্গ কিলোমিটার এলাকার পরিবর্তন ঘটেছে। গোয়ালন্দ ও চাঁদপুরের মধ্যে নদীপথের বিস্তৃতি ঘটেছে (২)। অবশ্য চাঁদপুরের পশ্চিম তীরে পলি জমা হচ্ছে এবং পূর্ব তীর ভাঙছে। এর ফলে চাঁদপুর সংলগ্ন নদীপথ সঙ্কুচিত হয়েছে এবং চাঁদপুর শহর ক্রমাগত ভেঙ্গে চলেছে পদ্মার উজানে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মিত হলে পদ্মা নদীতে পানি প্রবাহ কমে যায় এবং সেই সাথে কমে তার ভাঙনপ্রবণতা। কিন্তু তারপরও ‘কীর্তিনাশা’ পদ্মা এখনও ভাঙনে সিদ্ধহস্ত। ২০১৫ সালে পদ্মা নদী কমপক্ষে ২৩টি পয়েন্টে ভাঙন ঘটিয়েছে। গত বছর (২০১৪) পদ্মা মাত্র ৩ দিনে ফরিদপুর সদর উপজেলার গেন্দুমোল্লার হাটসহ ৭ কিঃ মিঃ এলাকা ও ১০/১২ টি গ্রাম গ্রাস করে নিয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, উপজেলার ৩৫টি গ্রাম, রাজবাড়ী জেলার সদর উপজেলার সিজানপুর ইউনিয়নের সহস্রাধিক একর ফসলি জমি ও ৫ শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর মাত্র এক সপ্তাহের ভাঙনে পদ্মায় বিলীন হয়েছে (তথ্যসূত্র ঃ যুগান্তর, ৬ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ঃ ১৮ অক্টোবর সংখ্যা)। পদ্মা-যমুনার ভাঙনে পাবনার ৪টি উপজেলায় ২০টি গ্রাম বিলীন হয়েছে (সূত্র ঃ জনকণ্ঠ, ১২/৭/২০১৫)। ঢাকা জেলার দোহার ও নবাবগঞ্জে পদ্মা ভাঙছে তাঁতীদের সহায়-সম্বল। পদ্মার ভাঙনে পাল্টে যাচ্ছে শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার মানচিত্র। প্রায় দেড় হাজার পরিবারের বাড়িঘর, বাজার, লঞ্চঘাট, স্কুল গতবছর হারিয়ে গেছে পদ্মার অথৈ পানিতে (সূত্র ঃ যুগান্তর ০৬/৯/১৫)। গত অক্টোবর মাসের ভাঙনে কুষ্টিয়ার তালবাড়িয়া গ্রামসহ মিরপুর উপজেলায় ১০ হাজার একর আবাদি জমি বিলীন হয়েছে পদ্মায় (সূত্র ঃ জনকণ্ঠ, ১৪/১০/১৫)। চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে প্রায় ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পদ্মানদীর বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্প গত ৩১ অক্টোবর ২০১৫ এ উদ্বোধনের মাত্র এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই তিন কিঃ মিঃ জুড়ে আবারও তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। মাত্র দুই সপ্তাহে নদী গর্ভে ৫০০ বিঘা আবাদি জমি পদ্মায় তলিয়ে গেছে। এ প্রকল্প নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে (ভোরের কাগজ- ২০/১১/২০১৫)।
মঙ্গার দেশে ভাঙনের মেলা: উত্তরাঞ্চলে নদী ভাঙন প্রতিবছর প্রলয়ংকরী রূপ নিয়ে থাকে, গত বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার অতি পরিচিত ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার প্রায় এক হাজার ঘর-বাড়ি ও শ’শ’ একর জমি তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়েছে। ভারতের মেফলিগঞ্জের হলদিবাড়ির বেলতলিতে তিস্তা নদীর উজানে স্পার তৈরি করায় বাংলাদেশ অংশে ভাঙন তীব্র হয়েছে বলে এলাকাবাসী মনে করেন (সূত্র ঃ সংবাদ, ২৭/৬/২০১৫)। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার, চাড়ালকাটা, বুড়ি তিস্তা, ঘাঘট নদীর ভাঙনে কুড়িগ্রামের উলিপুর, নাগেশ্বরী, চিলমারী, রৌমারী ও সদর উপজেলা, রংপুরের গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলা, নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলা, লালমনিরহাটের আদিতমারী ও হাতিবান্ধা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ভাঙন কবলিত হয়েছে। এই সব জেলার কয়েক হাজার পরিবার ঘর দুয়ার, ফসল, জমি হারিয়ে ছিন্নমূলে পরিণত হয়েছে (সূত্র ঃ সংবাদ, ২৭/৭/২০১৫)। বড়াল, ইছামতি, বাঙালি ও ফুলজোড় নদীর ভাঙনে বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার বিস্তীর্ণ আবাদি জমি, ঘর-বাড়ি ও গাছপালা বিলীন হয়েছে (সংবাদ ঃ ২৭/৭/১৫)। গত বছর কয়েক দফা বন্যা আর নদী ভাঙনের তীব্রতার এ অঞ্চলের মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে।
মেঘনার কূলে বসতের জ্বালা: মেঘনা অববাহিকায় নদীগুলোও ভাঙনে পিছিয়ে নেই। গেল বছর মেঘনা প্রায় ২১টি পয়েন্টে ভাঙন ঘটিয়েছে। স্বয়ং মেঘনা মিলে যাচ্ছে রামগতি। লক্ষ্মীপুরের এই উপজেলায় ১৬ হাজার পরিবার বাড়িঘর হারিয়েছে গত কয়েক বছরের মেঘনার ভাঙনে (সূত্র ঃ জনকণ্ঠ, ৩০/৭/১৫)। মেঘনার ভাঙনে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার হাজার হাজার একর জমি ও ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। সর্বস্ব হারিয়েছে প্রায় ৫ হাজার পরিবার (সূত্র ঃ দৈনিক যুগান্তর ০৪/৯/১৫)। মেঘনার ভাঙনে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাঁদপুর জেলা। পদ্মা-মেঘনার মিলিত স্রোতধারা ক্রমাগত পূর্বদিকে সরে যাওয়ায় গত ৫০ বছরে নদী ভাঙনে চাঁদপুর শহর সংলগ্ন ১৫/১৬ মাইল এলাকার বিভিন্ন স্থাপনাসহ দেশের ২য় বৃহত্তম চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের আওতাধীন প্রায় ৫০ বর্গ কিঃ মিঃ এলাকা মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়েছে। তীব্র ভাঙনের মুখে হাইমচর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৮০ শতাংশ বিলীন হয়েছে। গত বছরও মতলব উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচরের জালিয়ার চর পর্যন্ত ৭৫ কিঃ মিঃ দীর্ঘ নদী তীর জুড়ে মেঘনার ভাঙন অব্যাহত ছিল। ২০১৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মাত্র ৬ ঘণ্টায় মেঘনা-ডাকাতিয়ার ভাঙনে চাঁদপুর শহরের তিন হাজার বর্গমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ক্ষতি হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে মেঘনার ভাঙনে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের মূলহেড, মাছঘাট ও হরিসভা এলাকার বিস্তীর্ণ অংশ বিলীন হয়েছে (সূত্র দৈনিক জনকণ্ঠ, ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। এছাড়াও এ অববাহিকায় মেঘনার শাখা রহমতখালি, ডাকাতিয়া, ধনাগোদা ও সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই প্রভৃতি নদীও ব্যাপক ভাঙনপ্রবণ। সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় তীর ভাঙছে সুরমা-কুশিয়ারা। গত বছর রহমতখালি নদী লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার প্রায় ৫ কিঃ মিঃ এলাকাব্যাপী তীব্র ভাঙন ঘটায় (সূত্র জনকণ্ঠ, ৩০/৪/১৪)। পুরনো ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে শেরপুর, সদরে দেড় কিঃ মিঃ ফিডার রোড ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বিলীন হয় (সূত্র সংবাদ ১১/১০/২০১৫)।
দক্ষিণে ধায় ভাঙনের ভেলা: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে ভাঙনের তীব্রতা এ বছর প্রবলভাবেই অনুভূত হয়েছে। গত ৪ বছরে মধুমতি মাগুরার মুহাম্মদপুর উপজেলার ২০টিরও বেশি গ্রাম এবং প্রায় ১০ হাজার একর জমি গ্রাস করে নিয়েছে। গত জুলাই-আগস্ট (২০১৫) মাসেই ২৫টি বাড়ি মধুমতিতেই বিলীন হয়েছে (সূত্র: দৈনিক পূর্বাঞ্চল ০৮/০৮/১৫)। মাসেই ২৫টি বাড়ি মধুমতিতে বিলীন হয়েছে (সূত্র: দৈনিক পূর্বাঞ্চল ০৮/০৫/১৫)। গড়াই নদীর ভাঙনে মাগুরার গঙ্গারামপুর গ্রামে এক হাজারেরও বেশি একর ফসলী জমি নদীতে হারিয়ে গেছে। গৃহহীন হয়েছে ১০০টি পরিবার (সূত্র: প্রথম আলো ৩১/৮/২০১৫)। যশোরের কেশবপুর উপজেলায় শ্রীনদীর ভাঙনে প্রায় এক কিঃমিঃ এলাকা বিলীন হয়েছে (সূত্র: দৈনিক জন্মভূমি- ০৭/০১/১৫)। নবগঙ্গার ভাঙনে নড়াইলের কালিয়া উপজেলা শহর রক্ষা বাঁধের ব্লক বিলীন হয়ে যাচ্ছে (সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ২৪/৫/২০১৫)। সাতক্ষীরার আশাশুনিতে খোলপেটুয়া নদীর ভাঙনে এক কিঃ মিঃ বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছে (সূত্র ভোরের কাগজ, ০৪/৫/১৫)। শ্যামনগর ওয়াপদার বেড়িবাঁধের এক কিঃমিঃ বিলীন হয়েছে কপোতাক্ষ নদের ভাঙনে (সূত্র: দৈনিক পূর্বাঞ্চল-২৮/৮/১৫)। নড়াইলের লোহাগড়ায় ভাঙছে মধুমতির তীর, বিলীন হয়েছে পুরনো হাইস্কুল। (সূত্র: দৈনিক পূর্বাঞ্চল ৬/৭/১৫)। সাতক্ষীরার দেবহাটা থানায় ইছামতির ভাঙনে ওয়াপদার রিং বাঁধ বিলীন হয়েছে (সূত্র: দৈনিক পূর্বাঞ্চল ১৩/৬/১৫)। খুলনা জেলার ৭টি নদীর ভাঙনে ২টি গ্রাম, শ’ শ’ একর জমি, বাড়িঘর, গাছপালা বিলীন হয়ে যাচেছ। কাজিবাছা ও শোলমারী নদীর ভাঙনে কচুবুনিয়া গ্রামটি বিলীন হয়ে গেছে। জলমা ইউনিয়নে ভাঙন মারাত্মক রূপ নিয়েছে। পাইকগাছা ও করলা উপজেলার বহু ঘরবাড়ি, জমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে কপোতাক্ষের ভাঙনে। ভদ্রানদীর ভাঙনে ডুমুরিয়া উপজেলার শোলগাতিয়া বাজার এলাকার প্রায় ২০০ গজ নদীতে বিলীন হয়েছে। রূপসা উপজেলায় আঠারবেকী নদী গ্রাস করে নিচ্ছে সামন্তসেনা ও ফতেপুর গ্রামের জমি, গাছপালা, মসজিদ ও ঘরবাড়ি। রূপসার দেয়াড়া, রাজাপুর এলাকার বহু জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে যাচ্ছে ভৈরব নদীর ভাঙনে। আত্রাই নদী গ্রাস করে নিচ্ছে দীঘলিয়া উপজেলার গাজীর হাট বাজারের বহু দোকান (সূত্র দৈনিক যুগান্তর, ০৬/০৮/১৫)। এছাড়াও ফুলতলা উপজেলার পয়গ্রাম কসবার ঐতিহ্যবাহী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি বুড়ি ভৈরবের ভাঙনের মুখে পড়েছে (সূত্র: দৈনিক পূর্বাঞ্চল ০৭/৮/১৫)।
পুরনো হিসাব উল্টে ফ্যালে: নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, নদী অঞ্চল বরিশালে নদী ভাঙন কম। আর এখানকার ভাঙনের বৈশিষ্ট্যও ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মত নয় বলে তারা মনে করেন। তারপরও গত বছর বরিশালে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য নদী ভাঙনের সংবাদ পাওয়া গেছে। বরিশালের দোয়ারিকা ফেরিঘাটের ভাটিতে সন্ধ্যানদীতে ভাঙন চলছে পুরোদমে। কীর্তনখোলা নদীর ভাঙনে বরিশাল নদী বন্দর ও চর কাউয়া এলাকা বিপন্ন, ভোলা জেলা শহর মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙনের মুখে রয়েছে (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক ০৬/৬/১৫)। পিরোজপুর জেলায় কালিগঙ্গার ভাঙনে হুলারহাট, কাউখালি, চরখালি, পাড়েরহাট, ইন্দ্রেরহাট, তুষখালি, তেলিখালিসহ কমপক্ষে ১০টি নৌ-বন্দর বিপন্ন এবং ওদনকাঠি ও নরখালি প্রায় ২০০ পরিবারের বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। স্বরূপকাঠিতে সন্ধ্যানদী ইন্দ্রেরহাট বন্দরের অর্ধশতাধিক দোকান গ্রাস করেছে। কচা নদীর ভাঙনে পাড়ের হাট বন্দর, টগরা, ইন্দুরকানি বিপদগ্রস্ত। ভা-ারিয়ায় বলেশ্বর নদীর ভাঙনে তেলিখালি, তুষখালি সংলগ্ন বন্দর এলাকা বিপন্ন। বলেশ্বর নদ একাই কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে ভাঙছে। মধুমতির ভাঙনে শ্রীরামকাঠি নৌ-বন্দর ও মালিখালি গ্রাম হুমকির মুখে (সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ০৭/০২/২০১৫)। মঠবাড়িয়া উপজেলায় বলেশ্বর নদীর ভাঙনে তুষখালি বাজারের ১/৩ অংশ বিলীন হয়ে গেছে। বিষখালি নদীল ভাঙনে মিরুখালি, দাউদখালি ও টিকি কাটা ইউনিয়ন বিলীন হওয়ার পথে। এই উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার দোকানপাট, তিন হাজার একর আবাদি জমি বলেশ্বর ও বিশখালি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে (সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ০২/৯/১৫)। হালদা নদীর ভাঙনে বরগুনার বামনা উপজেলার ৫০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ বেড়িবাঁধের প্রায় ৫২টি স্থানে ভাঙন চলছে (সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ১৪/৭/১৫)।
বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে উত্তাল আগুনমুখা, রামনাবাদ, বুড়া গৌরাঙ্গ নদ মিলে গলাচিপা উপজেলাকে পোল্ডার-বেড়িবাঁধসহ রাক্ষসের মত গিলে খাচ্ছে (সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ০২/৯/১৫)। গত বছর এমনকি খাগড়াছড়ি জেলায় ফেনী, চেঙ্গি, মাইনী, মানিকছড়ি নদীর কূলে ভাঙন চলছে। ফেনী নদীর ভাঙনে অনেক বসতবাড়ি ও হাজার হাজার এক ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে (সূত্র: প্রথম আলো ০৫/১০/১৫)।
বান আর ভাঙনের থাবা: ১৯৯৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার পর নদী ভাঙন মারাত্মক রূপ নেয়। গত বছর (২০১৪) দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে দফায় বন্যার কারণে প্রবল বন্যার আশঙ্কা থাকলেও মারাত্মক রূপ নেয়নি। কিন্তু তারপরও এবছর নদী ভাঙনের পরিমাণ বেড়েছে। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, শরিয়তপুর কুষ্টিয়া, নড়াইল, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলায় গত বছর নদী ভাঙন প্রবল রূপে দেখা দেয়। এর মধ্যে কমপক্ষে ছয় দফা বন্যায় সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম জেলা, পাবনার বেড়া উপজেলা এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দি সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গেল বছর বান ও ভাঙনে কমপক্ষে পঁচিশ লাখ লোক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকা থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে। নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, কুড়িগ্রামের নুনখাওয়া থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭৬ কিঃ মিঃ নদী পথের দু’তীরে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মা ও মেঘনার ভাঙনে ৩০০ কিঃ মিঃ বাঁধ, ৪২টি সেতু কালভার্ট, স্লুইস গেটসহ শত শত গ্রাম নদীতে বিলীন হয়েছে। বিধ্বস্ত বাঁধগুলোর মধ্যে ৪০ কিঃ মিঃ বাঁধ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়েছে। আর এই ভাঙনে কমপক্ষে তিন লাখ লোক ছিন্নমূলে পরিণত হয়েছে (সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ১৮/৭ ও ২০/৭/২০১৪ সংখ্যা)।
ক্ষয়ে যাওয়া আমার সোনার বাংলা: প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই দেশে বন্যাকে দূর্যোগ হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেয়া হলেও, কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের কাছে নদী ভাঙন হচ্ছে এক নম্বর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যা বারো মাস ধরে নানা গতিতে চলে- আর রেখে যায় দীর্ঘমেয়াদী ছাপ। গত ৪৩ বছরে এ দেশের প্রায় দুই হাজার বর্গ কিঃ মিঃ এলাকা নদী ভাঙনে ক্ষয়ে গেছে। তারপরও এই ভাঙন মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি ও উদ্যোগ নিতান্তই অপ্রতুল। এমনকি ১৯৯৩ সালের আগে নদী ভাঙনকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবেও বিবেচনা করা হত না। গত ৩০ বছরে নদী ভাঙন রোধ ও শহর রক্ষায় মাত্র চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। আবার সেচ প্রকল্প, উপকূলীয় বাঁধ, বেড়িবাঁধ ও স্লুইস গেটসহ এই ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতি আর অপচয়ের কারণে এই ব্যয় প্রয়োজন না মিটিয়ে বরং গলার বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে আজ নদী ও নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় জনগণের মতামতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যথায় বারো মাস জুড়ে চলা এই নদী ভাঙনে ক্রমাগত ক্ষয়ে যেতে থাকবে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড, পাল্টে যেতে থাকবে নদীদের মানচিত্র।