ইসলামী পরিবার : জীবন ও সংসারের শান্তির নীড়
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: পরিবার হচ্ছে মানব সমাজের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জিন্দেগীর বহু শরয়ী বিধানের বিচরণক্ষেত্র হচ্ছে পারিবারিক জিন্দেগী। সঠিক ইসলামী পরিবার গঠনের উপরই মূলত নির্ভর করে আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জিন্দেগীর কামিয়াবীর সিংহভাগ। পারিবারিক জিন্দেগীর বীজ বপন হয়ে বিয়ে-শাদীর মাধ্যমে একজন নারী ও একজন পুরুষ যখন তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করে। সাধারণত একটি বর্ধিত পরিবারের একটি শাখা বা প্রশাখা হিসেবে এর উৎপত্তি ঘটলেও সময়ের ব্যবধানে এবং পর্যায়ক্রমে এ দাম্পত্য জীবন একটি আলাদা অস্তিত্ব অর্জন করে। নিজেই মূল হিসেবে আবির্ভূত হয়ে আবার শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি করে। হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে মানব সন্তানের বিকাশ ও বিস্তৃতির এটাই হচ্ছে চিরন্তন প্রাকৃতিক উপায়। “ফিত্তারুতাল্লাহেল্লাতি ফাতারান্নাসা আলাইহা”-এটাই আল্লাহর প্রকৃতিগত বিধান, যার উপর তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন-(সূরা আররূম : ৩০)। পরিবারের মুল ভিত্তি দাম্পত্য জীবনকে যদি ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গঠন করা যায়, তাহলে সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে বিস্তৃত বর্ধিত পরিবারকেও ইসলামের আলোকে গঠন করা সহজ হবে। আর যদি দাম্পত্য জীবনে গলদ ঢুকে যায় এবং ইসলামী আদর্শের কমতি হয়ে যায়, তাহলে বর্ধিত পরিবারের ইসলামীকরণ কঠিন হয়ে যাবে।
আদর্শ পরিবার গঠনের পরিকল্পনা কখন থেকে এবং কিভাবে নিতে হবে? বিয়ে শাদীর পূর্বেই অর্থাৎ পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের সময়েই আদর্শ পরিবার গঠনের প্রথম এবং অন্যতম প্রধান কাজটি করতে হয়। স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করার ক্ষেত্রে দ্বীনদারীর বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানের জন্য হাদীস শরীফে তাগিদ প্রদান হয়েছে। সৌন্দর্য, বংশ বা সামাজিক মর্যাদা অথবা সম্পদ এসব মানুষের কাছে আপাতত আকর্ষণীয় মনে হলেও দ্বীনদারী বাদ দিয়ে শুধু এগুলোর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিলে আদর্শ পরিবার গঠনের প্রধান উপাদানেই ভেজাল ঢুকে গেলো। পাত্রী নির্বাচনের সময় শুধু আপনার স্ত্রীই নির্বাচন করছেন না, আপনার সন্তানের ‘মা’-ও নির্বাচন করছেন একই সাথে। কাজেই গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে- আপনার সন্তানদের জন্য কেমন মা নির্বাচন করতে যাচ্ছেন। শুধু পাত্রী নির্বাচন নয়, পাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দ্বীনদারীকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। এজন্য সাহাবায়ে ক্বেরাম পাত্র/পাত্রী নির্বাচনের সময় তাঁদের দ্বীনী জ্ঞান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। কতগুলো সূরা মুখস্থ আছে, জিজ্ঞেস করতেন। আমাদের সমাজে আজকাল লেখাপড়ায় কি ডিগ্রী আছে খবর নেয়া হয়। উচ্চ ডিগ্রীকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। বৈষয়িক ডিগ্রীটাই বড় কথা! ইসলামী জ্ঞান, আমল ও চরিত্রের বিষয়টি একেবারেই গৌণ। যা হোক, আমাদের মূল আলোচনা হচ্ছে, কিভাবে পরিবারের মাঝে সন্তান-সন্ততিদেরকে সঠিক ইসলামী তারবিয়াত প্রদান করার উপযোগী পরিবেশে তৈরী করা যায়। স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব, কর্তব্য অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করবো।
১. ঘর ও পরিবারে ইসলামী পরিবেশ বিরাজমান থাকলে সন্তান-সন্ততির জন্য সেটা হচ্ছে একটা বাস্তব ও অনুকরণীয় তারবিয়াত। কাজেই স্বামী, স্ত্রী উভয়ের জন্য রয়েছে এক্ষেত্রে কিছু আদাব। সেগুলো রক্ষা করলে সে ঘর ও পরিবারে আল্লাহর রহমত বেশি করে আসবে। অশান্তি ও পেরেশানী থেকে আল্লাহপাক হেফাজত করবেন।
স্বামীর করণীয় আদবসমূহ: বাহির হতে বাড়িতে প্রবেশের সময় এমন কিছু যিকর ও দোয়া পড়া উচিত যাতে শয়তান কোন জায়গা না পায়। জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বলতে শুনেছেন, “তোমাদের কেউ ঘর বাড়িতে প্রবেশ করার সময় এবং খাওয়া শুরু করার সময় যদি (সংশ্লিষ্ট দোয়াসমূহ পড়ে) আল্লাহর যিক্র করে, শয়তান তার সঙ্গী-সাথীদের বলে, তোমাদের আজ থাকার জায়গাও নেই। খাবারের ব্যবস্থাও নেই। আর যদি প্রবেশের সময় দোয়া না পড়ে, শয়তান বলে: তোমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। খাওয়ার শুরুতে দোয়া না পড়ে শয়তান বলে: তোমাদের থাকা খাওয়া উভয়েরই ব্যবস্থা হয়ে গেছে”।-(মুসলিম)
ঘরে ঢুকেই সালাম করা এবং সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলা। বিনা খরচে সওয়াব হাসিলের এগুলোই সুযোগ। স্ত্রী বা পরিবারের যে-ই থাকুক হাসিমুখে সাক্ষাতটি এনে দেবে আপনাকে অনেকগুলো সওয়াব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “লা তাহকিরান্না মিনাল মা’রুফে শাইয়ান ওয়ালাও আন তালক্বা আখাকা বি ওয়াজহিন ত্বালেক”- অর্থাৎ কোন নেক আলমকেই তুচ্ছ মনে করো না, এমনকি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাত করার ব্যারটিকেও-(মুসলিম) আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন, “যখন তোমরা ঘরে বাড়িতে প্রবেশ করো, তোমরা একে অপরকে সালাম প্রদান করো। সালাম হচ্ছে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য একটি পবিত্র ও বরকতময় শুভেচ্ছা”- (সূরা নূর: ৬১) দুঃখের বিষয় হলো, অনেক সময় দেখা যায় যে, লোকটি বাইরে লোকজনের সাথে হাঁসি-খুশি, ভদ্র ও অমায়িক ব্যবহার করছেন, ঘরে ফিরছেন বদ মেজাজী স্বভাব নিয়ে, স্ত্রী-পরিবার তার রাগান্বিত চেহারার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যান। কোন কিছু জিজ্ঞেস করা মাত্রই তেলে- বেগুনে জ্বলে উঠেন। একটা মানসিক সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়ে গেলো তিনি বাড়ি আসার সাথে সাথেই। ছেলেমেয়েরা ভয়ে যার যার কক্ষে আশ্রয় নিলো, পিতার মুখোমুখি যেন না হওয়া লাগে। অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রী-পরিবারের সাথে উত্তম ব্যবহার করে”-(ইবনে মাজাহ)। রাসূলুল্লাহ (সা:) বাহির থেকে ঘরে এলে সালাম কালাম এর পরই মিস্ওয়াক করে নিতেন। কারণ, দীর্ঘক্ষণ বাইরে থাকলে ও খাওয়া দাওয়া না করলে মানুষের মুখে দুর্গন্ধ পয়দা হওয়ার আশংকা থাকে। এ সতর্কতা ও খেয়াল এজন্য যে, পরিবার-পরিজন যেন তার কাছ থেকে আনন্দ ও খুশি ছাড়া কোন ধরনের কষ্ট না পান। এমন কি মুখের সামান্য দুর্গন্ধও যেন তাদেরকে কষ্ট না দেয়।
বলুন তো ভাই, স্ত্রী-পরিবারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আল্লাহর কাছ থেকে অফুরন্ত সওয়াব হাসিল করতে আপনার কত টাকা খরচ হবে? যে মহিলাটি আপনার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করছে, ঘুরে ঢুকে তার সাথে বদমেজাজ না দেখিয়ে মায়া, মমতা, সোহাগভরা দু’টো কথা বলতে আপনাকে কতো পরিশ্রম করতে হবে?
এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বলতে শুনলেন; কেউ যদি তার স্ত্রীর মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দেয়, এটা তার জন্য সাদকার সওয়াব নিয়ে আসে। সাহাবী ঘরে এসে খাবার না পেয়ে এক গ্লাস পানি তাঁর স্ত্রীকে এগিয়ে দিলেন। স্ত্রী বললেন, কি ব্যাপার, এতো খেদমত শুরু হলো কেনো? সাহাবী বললেন, রাসূল (সাঃ) এর কাছ থেকে হাদীসটি শুনে আমল করছি।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) কে আদর করে কখনো ডাকতেন ‘আয়েশ’ সংক্ষিপ্ত করে, আবার কখনো ডাকতেন ‘হোমাইরা’ যার অর্থ লাল বা লালচে। তাই স্ত্রীকে একটি সুন্দর নামে ডাকা, তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করা বা তার ভালোবাসার কথাটুকুন আবেগ সহকারে প্রকাশ করা এমনকি এ বিষয়ে অতিরজ্ঞিত বা বানিয়ে যা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আরো মধুর ও আবেগময় করে, তা শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর নয়। আসমা বিন্তে ইয়াজিত (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: ‘তিন জায়গা ছাড়া মিথ্যা বলা জায়েয নেই। স্বামী-স্ত্রীর মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রে, যুদ্ধের ময়দানে দুশমনকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং দু’ব্যক্তি বা দু’দলের মধ্যে শত্রুতা দূর করে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠানর জন্য’-(তিরমিযী, আহমদ) হাদীসটির বিস্তারিত ব্যাখ্যার সুযোগ এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। ইমাম নববী শরহ মুসলিম, ইমাম ইবনে হাযম আল মুহাল্লায় এবং আল খাত্তাবী প্রমুখ মুহাদ্দিসীন ও ফোকাহা স্ত্রীর মনোরঞ্জন ও দাম্পত্য জীবনকে মধুময় করার স্বার্থে অতিরঞ্জিত মহব্বত প্রকাশকে বৈধ বলেছেন। তবে এর উদ্দেশ্য প্রতারণা বা ঠকানো এবং স্ত্রীর সাথে মিথ্যা বলার লাইসেন্স নয়। সমাজের অনেকেরই দেখা যায় স্ত্রীর সাথে এমন মধুর সম্পর্ক স্থাপনের গরয ও সময় তাদের নেই। প্রয়োজনে দৈহিক সম্পর্কটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। বরং তার উল্টো, কথায় কথায় তার অন্তর থেকে হোক বা ঠাট্টাচ্ছলে হোক বলে বসে স্ত্রী তার পছন্দ হয়নি। তার প্রতি সে তেমন আকর্ষণ অনুভব করে না। উপরন্তু অন্যান্য মহিলার সৌন্দর্য চর্চা করতে বা তার সৌন্দর্য পিপাসা নিবৃত্ত করতে তিনি আরেকটি বিয়ের কথা জোরেশোরে বিবেচনা করছেন। অথচ বাস্তবে হয়তো বা দ্বিতীয় বিয়ে করাটা কোন দিনই হবে না। কিন্তু এই অবাস্তব মুখ চুলকানিটুকু থামাতে না পেরে অযথা দাম্পত্য জীবনে চিড় ধরানোর কাজটুকু করে যাচ্ছেন এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব পয়দা হচ্ছে।
২. পারিবারিক সম্পর্ককে মধুময় করার জন্য স্ত্রীরও রয়েছে অনেকগুলো আদাব। স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ না করে দেখুন সেগুলো আমল করে স্বামীকেও টানতে পারবেন আপনার কাছে, তার সাথে সাথে আল্লাহ্র কাছ থেকেও পাবেন অফুরন্ত সওয়াব। বাইরে থেকে আপনার স্বামী ঘরে এলে একটু মুচকি হেসে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে কি আপনার অনেক কষ্ট হবে? তার গায়ের কোর্টটি খুলে রাখতে একটু সাহায্য করলে কি আপনার ব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে? হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজ হাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চুলগুলো চিরুনী দিয়ে আঁচড়িয়ে দিতেন।
স্বামী ঘরে এলে বলুন না আলহামদুলিল্লাহ! আপনি এসেছেন। আপনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলে চাতকের মতো চেয়ে থাকি আবার কখন আসবেন। যাওয়ার সময় একটু বলেই দিন তাড়াতাড়ি আসতে হবে কিন্তু! তবে খেয়াল রাখতে হবে, জরুরী প্রয়োজন এবং দ্বীনী দায়িত্ব পালন থেকে যেন স্বামীকে বিরত না রাখেন। সাধ্যমতো চেষ্টা করুন, স্বামীর রুচি অনুযায়ী কাপড়-চোপড় পরিধান করতে, সেজে-গুজে চলতে, যাতে স্বামী আপনার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। মন থেকে বিভিন্ন প্রকার দুশ্চিন্তা দূর করে দিন। যে কোন অবস্থায় স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন। সংসারের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে স্বামীর প্রতি অসন্তোষ ও অভিযোগ দায়ের করা থেকে বিরত থাকুন রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে দোয়া শিখিয়েছেন: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযান- অর্থাৎ হে আল্লাহ্! আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী থেকে পানাহ্ চাই-(বুখারী)।
স্বামী-স্ত্রী উভয়ের করণীয় আদব: উভয়েই ইল্ম, শরীয়তের আমল পালন করতে এবং গুনাহ থেকে দূরে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করুন। দ্বীনী দায়িত্ব পালনে একে-অপরকে সাহায্য করুন। একে-অপরের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজন বা অন্যান্যদের কাছে অপরের দোষ-ত্রুটি আলোচনা না করে ভালো দিকগুলো আলোচনা করুন।
নিজেদের মধ্যে কখনো ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেলে তা দূর করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ক্রোধের মাথায় সমাধান না করে পরবর্তীতে স্বাভাবিক পরিবেশে সমাধানের অপেক্ষা করুন। একে-অপরকে মাফ করে দিন। ধৈর্য ও সবরের প্রতিযোগিতা করুন। সন্তান-সন্ততির সামনে একে-অপরের সমালোচনা কঠোরভাবে এড়িয়ে চলুন। এতে উভয়েই সন্তানদের কাছে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচা যাবে এবং সন্তানদেরকে আদব শিখানোর যোগ্যতা হারাতে হবে না। নিয়মিত পারিবারিক বৈঠক করুন। স্বামীর উচিত সংসারের এমনকি নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছুই স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে কাজ করা। স্ত্রীরও উচিত স্বামীর অনুমতি নিয়েই যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা। একে-অপরের পিতামাত ও আত্মীয়-স্বজনকে সম্মান ও যত্নের ব্যাপারে উদাসীন না হয়ে আন্তরিক হওয়ার চেষ্টা করা।
সন্তান-সন্ততির প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য: আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ্ তোমাদেরকে অছিয়ত করছেন, তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে’- (নিসা: ১১)। রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে-ইমাম (নেতা/শাসক) তার অধীনস্থ জনগণের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, সে ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের কর্তা, তার কর্তৃত্বের ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। মহিলা হচ্ছেন তার স্বামীর গৃহের কর্তৃত্বকারিণী। তাকেও তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে।’- (বুখারী)।
কাজেই সন্তান-সন্ততি মা-বাবার প্রতি আল্লাহ্র এক বিরাট আমানত। এ আমানত সংরক্ষণ করা পিতা-মাতার একটা জরুরী ফরয কাজ। সন্তান-সন্ততির প্রতি পিতা মাতার অধিকারগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়: ব্যক্তিগত অধিকার ও নৈতিক অধিকার। ব্যক্তিগত অধিকারের আওতায় আছে।
১. তাদের জন্য একজন ভালো মা নির্বাচন করা। ইতোপূর্বে স্ত্রী নির্বাচন করার প্রসঙ্গে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
২. সুন্দর নাম রাখা। রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে নিজ নিজ নাম ও পিতার নামে ডাকা হবে। কাজেই সুন্দর করে নাম রাখার চেষ্টা করো’- (আবু দাউদ)। এমন অসুন্দর বা অর্থহীন নাম না রাখা উচিত যাতে করে সন্তানদের জন্য দুনিয়া বা আখেরাতে লজ্জার কারণ না হয়ে যায়।
৩. সন্তান জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ থেকে তাকে বঞ্চিত না করা। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন, ‘মায়ের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সন্তানদেরকে পুরো দু’বছর দুধ পান করানো’- (আল-বাকারা: ১৩৩)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘শিশুর জন্য মায়ের দুধের ন্যায় আর কোন দুধ এতো বরকতপূর্ণ হতে পারে না’- (আবু দাউদ)।
৪. হালাল রুজি-রোজগার থেকে শিশুকে প্রতিপালন করা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, “যে মাংস হারাম মাল থেকে প্রতিপালিত হয়েছে তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। জাহান্নাতই তার জন্য উপযুক্ত’-(মুসনাদে আল-বারী)।
৫. সাধ্যানুযায়ী তার মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা। একটি উত্তম পারিবারিক পরিবেশে তার লালন-পালন করা। সম্ভব হলে প্রত্যেক সন্তানকেই বড় হয়ে আসলেই আলাদা বিছানায় শুতে দেয়া। দশ বছর হয়ে গেলেই তাদেরকে আলাদা বিছানায় দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। বিছানা আলাদা করা সম্ভব জনা হলে কমপক্ষে লেপ বা কম্বল আলাদা করে দিতে হবে অবশ্যই্ ছেলে এবং মেয়েদের রুম অবশ্যই পৃথক হওয়া দরকার।
বয়স বাড়ার সাথে সাথেই পর্যায়ক্রমে সন্তানদের মনে পর্দা-পুশিদা সম্পর্কে ধারণা দেয়া। লজ্জা শরম ঈমানের অঙ্গ। তাদের লজ্জা উঠে যায় এমন কোন দৃশ্য পিতামাতা তাদের সামনে সৃষ্টি করা উচিত নয়। টেলিভিশনের অশ্লীল প্রোগ্রামগুলো সম্পর্কে তাদের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করা উচিত। এর বিষবাষ্প থেকে তাদেরকে যতো দূরে রাখা যায় ততোই মঙ্গল। সতর ঢাকার মতো ভালো পোশাকে, বিশেষ করে মেয়েদেরকে বড় হওয়ার অনেক আগে থেকেই অভ্যস্ত করানো উচিত। বেপর্দা, নগ্নতা, বেহায়াপনার ব্যাপারে তাদের মনে কচি বয়স থেকে ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে।
সন্তানদের সবাইকে সমান চোখে দেখা এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য না করা। সাহাবী নোমান বিন বাশীর (রাঃ)কে তাঁর পিতা রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাছে নিয়ে এসে বললেন, আমার এ ছেলেটিকে আমার একটি ক্রীতদাস দান করে দিয়েছি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমার সন্তানদের সবাইকে কি এমন করে দান করেছো? তিনি বললেন, জ্বি না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আল্লাহ্কে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ করো-(বুখারী)। কোন কোন পরিবারে ছেলেমেয়েদের মধ্যে পার্থক্য করতে দেখা যায়। বিশেষ করে একাধিক কন্যা সন্তানের মোকাবিলায় যদি মাত্র একটি পুত্রসন্তান থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই।
নৈতিক অধিকারসমূহ: ১. বাল্য বয়স থেকেই সন্তানদেরকে সঠিক আদাব ও তারবিয়াত প্রদানের প্রচেষ্টা চালানো পিতামাতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘উত্তম আদাব তারবিয়াত প্রদানের চেয়ে বড় আর কিছু নেই যা মাতাপিতা সন্তানের জন্য করতে পারে’- (তিরমিযী)। তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদেরকে সম্মানিত করো। তাদেরকে সুন্দর আদাবসমূহ শিখিয়ে দাও’- (ইব্নে মাজাহ্)। সুন্দর আদাব তারবিয়াতের মাধ্যমেই তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর আশা করা যায়। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও (তাহ্রীম: ৬)। সন্তান-সন্ততির আদাব তারবিয়াত কেমন হওয়া উচিত হযরত লোকমান হাকীম-এর সন্তানদের প্রতি দশটি অছিয়ত তার উত্তম নমুনা হিসেবে আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের জন্য পবিত্র কুরআনে তুলে ধরেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন, “লোকমান তার সন্তানকে নসীহত করতে গিয়ে বললেন- হে বৎস, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার সাথে সদাচারণের জন্য জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভধারণ করেছে। দু’বছর পর তার দুধ ছাড়ানো হয়। নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে; আমার প্রতি ও তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকো। আমারই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে তোমাদেরকে। আর তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরিক করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মানবেনা বটে, তবে দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করে যাবে। আর যারা আমার প্রতি অভিমুখী তাদের পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমরা আমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। তখন আমি তোমাদেরকে সবিস্তার জ্ঞাত করবো, যা তোমরা করে যাচ্ছিলে।
হে বৎস, কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি থাকে প্রস্তর গহীনে, অথবা আকাশগুলো বা ভূগর্ভের কোথাও আল্লাহ্ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সকল গুপ্ত ভেদ সম্পর্কে অবগত ও সবকিছুর খবর রাখেন।
হে বৎস, নামায কায়েম করো। সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করো এবং বিপদাপদে সবর করো। নিশ্চয়ই এটা হচ্ছে অত্যন্ত মহৎ কর্ম। আর অহংকার বলে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীর বুকে গর্ব ভরে পদাচরণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। তোমার পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো এবং তোমার কন্ঠস্বরকে নীচু করো। নিঃসন্দেহে সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট আওয়াজ হচ্ছে গাধার স্বর-(সূরা লোকমান : ১৩)।
উপরোল্লিখিত আয়াতগুলোতে সন্তানের তারবিয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী জ্ঞানের যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে : ১. ঈমানী জ্ঞান অর্থাৎ সঠিক ইসলামী আক্বীদা, ২. পিতা মাতার হক ৩. নামায তথা শরীয়তের আহকামসমূহ এবং মাসায়েল, ৪. আমর বিল মারুফ নাহী আনিল মুনকার, ৫. চারিত্রিক গুণাবলী ইত্যাদি।
প্রয়োজনীয় ইসলামী জ্ঞান প্রদানের জন্য কুরআন, হাদীস, ফিক্বহ, সীরাতুন্নবী, সাহাবা কাহিনী ইত্যাদি পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠদানের জন্য কোন মাদরাসা বা শিক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দিলেই পিতামাতার শিক্ষাদানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আনুষ্ঠানিক পাঠদান কর্মসুচীর বাইরেও দৈনন্দিন উঠাবসা সাহচর্যের সুযোগে সময় সুযোগ অনুযায়ী সন্তানদের হৃদয়ে ইসলামী আদর্শকে মজবুত করে গ্রোথিত করতে হবে। যেমন- চাচাতো ভাই বালক আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) কে একান্ত সান্নিধ্যে পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) উপদেশ দিয়ে বললেন, হে বালক আমি তোমাকে কয়েকটি জরুরী কথা শিখাতে চাই। আল্লাহর হেফাজত করো, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। আল্লাহর হেফাজত করলে তাঁকে তোমার প্রতি সদয় ও সাহায্যকারী। কিছু চাইতে হলে আল্লাহর কাছেই চাইবে। সাহায্য কামনা করলে আল্লাহর কাছেই করবে। জেনে রেখো, মানবগোষ্ঠীর সবাই যদি তোমার কোন কল্যাণ সাধনে একত্রিত হয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে লিখে দেয়া ফায়সালা ছাড়া তারা তোমার কোন কল্যাণই করতে পারবে না। আর সবাই যদি একত্রিত হয় তোমার কোন ক্ষতিসাধন করতে, আল্লাহর পক্ষ থেকে লিখে দেয়ার বাইরে তারা এতটুকুও ক্ষতি করতে পারবে না তোমার। কলমগুলো উঠিয়ে নেয়া হয়ে গেছে। কাগজের লিখাও শুকিয়ে গেছে।-(তিরমিযী) সময়মতো এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নসীহত বা উপদেশ ছোটদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।
সন্তানদেরকে সততা ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা দেয়া দরকার। আর সেজন্য মা-বাবাকে অবশ্যই মিথ্যা পরিহার করতে হবে। বাচ্চাদের সাথে খেলাচ্ছলে বা ঠাট্টাস্বরেও মিথ্যা বলা যাবে না। কারণ ঠাট্টা মশকারী করেও মিথ্যা বলা জায়েয নয়। বাচ্চাদের সাথে কিছু দেয়ার জন্য ওয়াদা করলে অবশ্যই তা রক্ষা করতে হবে। তাই যা রক্ষা করা সম্ভব এমন ওয়াদা করাই উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “কেউ যদি কোন বাচ্চাদের বলে- এসো নাও। তারপর বাচ্চা এলে তা দেয় না, এটাও একটা মিথ্যা বলা।” বাচ্চার দুষ্টুমি কমাতে বা ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে অনেক সময় মায়েরা অনেক মিথ্যা ভয় দেখান, হাদীসের দৃষ্টিতে এগুলোও মিথ্যার আওতায় পড়ে যায়। এগুলোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে শিশুর মনে মিথ্যা বলার অভ্যাস পড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা ভালো যে, যে কোন খারাপ কাজ থেকেই সন্তানদেরকে বিরত রাখতে হলে নিজেদেরকে অবশ্যই সে খারাপ কাজটা বর্জন করতে হবে। পিতামাতা অন্যদের সাথে মিথ্যা বলবে, আর সন্তান মিথ্যা বললে তাকে শাসন করবে আচ্ছা করে- এমনটি অনেকেই করে থাকেন। পিতা সন্তানদের সামনে যখন খুব করে ধুমপান করে, ছোটদের কাছে মনে হয় এমন কায়দা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লে কতোই না মজা লাগে। পিতা মাতার অজান্তে আস্তে করে একটা টান দিয়ে মজার কৌতুহল মেটাতে তার মনে ভীষণ আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনটি হতে দেখলে সন্তানকে বড় ধরনের শাস্তি দিতে অনেকেই বিলম্ব করেন না। কিন্তু পিতা কি লক্ষ্য করেছেন, আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ কি এ ব্যাপারে? “হে ঈমানদারগণ! তোমরা এমন কথা কেনো বলো যা তোমরা করো না? এটা আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই খারাপ যে, তোমরা এমন কথা বলো, যা তোমরা করোনা”-(ছফ : ২-৩)
সম্ভব হলে পিতা ছেলেকে সাথে করে মসজিদে নিয়ে যাবেন। জামাতে নামায পড়তে অভ্যস্ত করাবেন এবং ইসলামী আলোচনা, ইল্ম এর আসরে বসতে অভ্যস্ত করে তুলবেন। ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে নামাযে অভ্যস্ত করানো পিতামাতার একটি জরুরী দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন, “তোমাদের সন্তানদেরকে সাত বছর বয়স থেকেই নামাযের নির্দেশ দাও। দশ বছর বয়সে শাসন করে হলেও নামায পড়াতে হবে। আর তাদের বিছানা পৃথক করে দাও”-(আবু দাউদ)। ছোটকাল থেকেই রোযার অভ্যাস করানো উচিত। সাহাবায়ে কেরাম তাদের সন্তানদেরকে বালেগ হওয়ার আগেই রোযার অভ্যাস করাতেন। মসজিদে টুকটাক খেলনাও নিয়ে যেতেন বাচ্চাদের জন্য। আসরের পর বেশি ক্ষুধার্ত হয়ে গেলে, ওদের কষ্ট ভুলানোর জন্য খেলনা দিয়ে ব্যস্ত রাখতেন ইফতার পর্যন্ত-(বুখারী)। হারাম থেকে তাদেরকে সতর্ক করা দরকার। আবু হুরাইরা (রা:) বর্ণনা করেন, একবার আলী (রা:)-এর পুত্র হাসান (রা:) একটি সাদাকার খেজুর মুখে দিয়ে ফেললে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, কীখ! কীখ! অর্থাৎ মুখ থেকে ফেলে দেয়ার জন্য। অত:পর তিনি বললেন, “তুমি কি জানো না যে, আমরা সাদাকার মাল খেতে পারিনা!”-(বুখারী)।
তাদেরকে খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরার সুন্দর ইসলামী আদাবগুলো শিখানো উচিত। উমর বিন আবি সালামা (রা:) বর্ণনা করেন, আমার শৈশব কেটেছে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ঘরে। ছোট বয়সে সবার সাথে এক সঙ্গে বড় প্লেটে খেতে বসলে হাত প্লেটের সবখানে ঘোরাঘুরি করতো। রাসূল (সা:) আমাকে একদিন বললেন, “বৎস, বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া খাবে, ডান হাতে খাবে আর তোমার সম্মুখস্থ অংশ থেকে খাবে”-(বুখারী ও মুসলিম)। হুযাইফা (রা:) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা:) এর সাথে কোথাও একই প্লেটে খেতে বসলে খাবারে হাত লাগাতাম না যতক্ষণ না রাসূলুল্লাহ হাত লাগাতেন। একবার তাঁর সাথে আমরা খেতে বসেছি। হঠাৎ করে একটি ছোট্ট মেয়ে ছুটে এলো। মনে হলো যেনো কেউ তাকে ঠেলে দিয়েছে। খাবারে হাত ঢুকিয়ে দেবে ঠিক এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা:) তার হাত ধরে ফেললেন। তারপরই হঠাৎ করে চলে আসলো আরেকজন বেদুঈন। তাকেও মনে হলো কেউ ঠেলে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) তার হাতও ধরে ফেললেন। অত:পর তিনি বললেন, “খাবার শুরুর পূর্বে কেউ বিসমিল্লাহ না বললে সে খাবারে শয়তানের সুযোগ হয়ে যায়। সে উদ্দেশ্যে শয়তান মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিলো কিন্তু আমি তার হাত ধরে ফেলেছি। পরে এই বেদুঈনটিকে নিয়ে এলো, আমি তারও হাত ধরে ফেলেছি। যে আল্লাহর হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, মেয়েটির হাতের সাথে শয়তানের হাতও আমার হাতে ধরা আছে”-(মুসলিম)। একবার দু’ব্যক্তি রাসূল (সা:) এর কাছে এসেছিলেন কোন বিষয়ে আলাপ করতে। তাদের মধ্যে যিনি বয়সে ছোট, তিনি কথা শুরু করে দিলে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, “বড়জনকে বলতে দাও”-(বুখারী)। পিতামাতার উচিত এভাবে সন্তানদেরকে বড়দেরকে সম্মান করতে, ছোটদেরকে আদর-স্নেহ করতে, প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনের হক (অধিকার) ইত্যাদি আদাবগুলো শিখানো।
সন্তানদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ার জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করা অতীব জরুরী। আম্বিয়ায়ে কেরাম ও পূর্বকালের নেক্কার লোকেরা এমনই করে বলতেন, “হে প্রভূ! আমার সন্তান-সন্ততিদেরকে নেক্কার বানিয়ে দিন”-(আল আহকাফ:১৫) “রাব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াযিনা ওয়া জুররিইইয়াতিনা কুররাতা—” অর্থাৎ “হে প্রভূ! আমাদেরকে এমন স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততি দান করুন। যারা আমাদের চক্ষু শীতল করে দেবে”-(আল ফুরক্বান :৭৪) “হে প্রভূ! আমাকে নেক সন্তান-সন্ততি দান করুন, নিশ্চয়ই আপনি দোয়া শ্রবণ করতে খুব বেশি পছন্দ করেন”-(আল ইমরান)। “হে প্রভূ! আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে নামায কায়েমকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন”-(ইবরাহীম :৪০)।
শয়তান ও বদ নযর থেকে ছোট সন্তানদের হেফাযতের জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দোয়া করতে থাকা বড়ই কল্যাণকর। ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ (সা:) মাঝে মধ্যেই হাসান এবং হোসাইন (রা:)কে দোয়া পড়ে ফুঁ দিতেন। তিনি বলতেন, “তোমাদের আদি পিতা ইব্রাহিম (আ:), ইসমাঈল (আ:) এবং ইসহাক (আ:) এ দোয়াটি পড়ে ফুঁ দিতেন। “আউযুকুমা বি কালিমাতিল্লাহিততাম্মাহ্ মিন কুল্লি শায়তানিন ওয়া হাম্মাহ্ ওয়া মিন কুল্লি আইনিন্ লাম্মাহ্” অর্থঃ প্রত্যেক শয়তান ও বিষধর জীবজন্তু থেকে ও প্রত্যেক বদ নযরসম্পন্ন দৃষ্টি থেকে তোমাদের জন্য আশ্রয় চাচ্ছি আল্লাহর পরিপূর্ণ বাক্য দ্বারা”-(বুখারী)।
জাবের (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “যখন সন্ধ্যা ঘনীভূত হয়ে আসে তোমরা বাচ্চাদেরকে ঘরের ভেতর রেখো। কারণ ঐ সময়টিতে শয়তানগুলো ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা রাতের কিছু অংশ পার হয়ে গেলে তাদেরকে ছেড়ে দিতে পারো। অত:পর রাতে দরজাগুলো বন্ধ করে দেবে বিসমিল্লাহ পড়ে কেননা শয়তান কোন বন্ধ দরজা খুলতে পারে না। পান পাত্রটিও (পানির জগটিও) ঢেকে রেখো বিসমিল্লাহ পড়ে। সকল খাবারের পাত্রগুলোও ঢেকে রেখো বিসমিল্লাহ পড়ে। যে কোন কিছু দিয়ে হলেও অবশ্যই ঢেকে রেখো। আর তোমাদের বাতিগুলো নিভিয়ে দাও”-(বুখারী ও মুসলিম)। নিজেদের গৃহ ও পরিবারকে শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য উপরোক্ত হাদীসে অনেকগুলো আদাবের কথা বলা হয়েছে। যত্নের সাথে আমল করলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা আমাদের সন্তান-সন্ততি তথা গোটা পরিবারকে শয়তানের অনেক অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন।
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, ‘যারা ঈমানদার হয়েছে এবং তাদের সন্তানরাও ঈমানের অনুগামী হয়েছে, আমি তাদেরকে তাদের সন্তানদের সাথে মিলিত করে দেবো। আর তাদের আমলকে (সৎ কর্মকে) বিন্দুমাত্রও হ্রাস করবো না”-(তুর:২১)। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “আদম সন্তান যখন মৃত্যুবরণ করে তার সকল আমলের সমাপ্তি ঘটে যায় শুধুমাত্র তিনটি আমল ছাড়া। আর সেগুলো হচ্ছে: ১. সাদাকা জারিয়া, ২. এমন ইল্ম যা থেকে লোকেরা ফায়দা পেতে থাকে এবং ৩. নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করতে থাকে”-(মুসলিম ও নাসায়ী)। এর বিপরীতে মানুষ তার প্রতি আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত সন্তান সন্ততিকে গড়ে তোলার এ আমানতের খেয়ানত করলে কাল ক্বিয়ামতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। শুধু তাদের দোয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া নয়, তাদের পথ ভ্রষ্টতার দায় দায়িত্বের অনেকাংশও এসে পড়বে তার উপর। রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন, “একজন মানুষের এতটুকুন গুনাহই যথেষ্ট যে, সে তার উপর নির্ভরশীলদেরকে (সন্তানদেরকে) বরবাদ করে দেয়”-(আবু দাউদ) আল্লাহ পাক আমাদেরকে ইসলামীকরণ পরিবার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের আদবসমূহ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।