রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত সম্প্রদায়

Ruhingaরোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত সম্প্রদায়ের একটি। কেউ তাদের চায় না। তাই নিজের ভিটে মিয়ানমার বা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এদের অনেকেই বাস করছে ভারতে, শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে।
দিল্লীর কালিন্দি কুঞ্জে সেতুর উপর দিয়ে হাঁটতে গেলেই নীচে চোখে পড়বে কিছু তাঁবু। কোনোটি প্লাস্টিক, কোনোটি প্লাই উড, টায়ার বা কাপড় দিয়ে বানানো। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে এরা মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গা গোষ্ঠী। তারা একটি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে তাদের মারধোর করা হবে না, ধর্ষণ বা হত্যা করা হবে না।
কালিন্দি কুঞ্জে মোট ৩০৭ জন রোহিঙ্গার বাস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা জাকাত ফাউন্ডেশন তাদের জন্য এই আশ্রয় স্থলটি নির্মাণ করেছে। ১১ হাজার স্কয়ার ফিট এলাকায় তাদের তাঁবুগুলো গড়ে উঠেছে। তবে মাত্র এক বছরের জন্য তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়েছে এখানে। ঈদ উল-আজহার পর, ১০ দিনের মধ্যেই তাদের সরে যেতে বলা হয়েছে এখান থেকে। তবে এটাই প্রথমবার নয়। এর আগেও এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে হয়েছে তাদের। আসলে প্রায়ই এভাবে বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে হয় রোহিঙ্গাদের।
ইন্দোনেশিয়ার জুলক গ্রামে পৌঁছানোর পরই তাঁদের লাইনে দাঁড়াতে হলো। নাম, ঠিকানা সব লিখিয়ে তবেই নিস্তার।
মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে সে দেশে দশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম রয়েছে, যারা অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে সেখানে গেছে। এ কারণে তাদের অনেকেরই কোনো জাতীয়তা নেই, নেই কোনো পরিচয়-পত্র বা কাগজ-পত্র। এ সব দেশে তারা প্রায়ই দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে এবং এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলাফল উদ্বাস্তু। বেশ কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গারা জাতীয়তাহীনভাবে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। এদের বেশিরভাগই মানবপাচার, নিগ্রহ ও ধর্ষণের শিকার হয় এবং অমানবিক জীবনযাপনে বাধ্য করা হয় তাদের।
২০১২ সাল থেকে ১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম নৌকায় করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা। প্রশ্ন হলো, তাদের কি এতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়েছে এ সব দেশে? সে যাই হোক, এই দেশগুলোর মধ্যে ভারতকেই শরণার্থীদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ দেশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
৩৩ বছরের মোহাম্মদ ওসমানও মিয়ানমার থেকে ভারতে এসেছেন। দিল্লীতে আসার পথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে জঙ্গলে তিন দিন খাবার ও পানি ছাড়া কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। সেসব দিনের কথা বলতে গিয়ে ওসমানের চোখে আজও ভেসে ওঠে ভয়ংকর কিছু স্মৃতি। মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ নাকি চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষদের বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেত। এদের কেউই আর ফিরে আসেনি।
আফগান বা ইরাকি শরণার্থীদের মতো সুযোগ-সুবিধা রোহিঙ্গাদের দিতে পারছে না ভারত। কারণ ভারত চাইছে, মিয়ানমার সরকার এদের জন্য কিছু করুক। ভারতে বর্তমানে ৩৫,০০০ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। জাকাত ফাউন্ডেশন কালিন্দি কুঞ্জের ৪৭টি শিশুকে বিনা মূল্যে শিক্ষা দান করছে।
আটকে পড়া: গত ১০ মে চারটি নৌযানে করে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে প্রবেশ করে ৬০০ রোহিঙ্গা। একই সময়ে লাংকাওইতে প্রবেশ করে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা। সমুদ্র থেকে স্থলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের ঘিরে ফেলে। ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়া মানুষগুলো এখনো মুক্ত নয়।
অন্যদিকে ইসমাইল নামে এক তরুণ দিল্লীতে একটি বাসা খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে তিনি তাঁর ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে পারে। প্রাণ হারানোর আর কোনো ভয় নেই। তাই তিনি খুশি। তিনি আর মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান না।
তবে বার বার জায়গা বদলের কারণে বহু রোহিঙ্গারই স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে, হতে চলেছে ক্রমশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কালিন্দি কুঞ্জেও অন্তত ৪০ জন এ সব কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, যাদের ওষুধ কেনার বা ডাক্তার দেখানোর মতো সামর্থ্য নেই। তার ওপর এদের চাকরিও অনিশ্চিত। এই যেমন ওসমান শ্রমিকের কাজ করে মাসে ১০ থেকে ১৫ দিন। এতে দিনে তিনশ’ টাকা আয় হয় তাঁর।
রোহিঙ্গারা বরাবরই গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এসেছে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো, তারা কি কোনোদিন থিতু হতে পারবে? কোথায় তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য? এই প্রশ্নের উত্তর কি কেউ জানে? বৈধ পরিচয়-পত্র না থাকায়, সারাজীবনই হয়ত তাদের এমন যাযাবরের মতোই জীবনযাপন করতে হবে, হতে হবে দেশান্তর।
নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ: মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং নিরাপত্তাবাহিনীর সংঘর্ষে অন্তত ৩৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ জন নিরাপত্তাকর্মী। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেছে, বাংলাদেশ সীমান্তে পুলিশকে হত্যার জেরই হামলা কারণ। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অং সান সুচি জয়ী হওয়ার পর এই প্রথম রোহিঙ্গা ও নিরাপত্তাবাহিনীর মধ্যে এত বড় সংঘাতের ঘটনা ঘটল। ঘটনার সূত্রপাত গত রবিবার সকালে। নিরাপত্তাবাহিনী বলছে, সেদিন সশস্ত্র রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্তের তিনটি পুলিশ ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এতে মিয়ানমারের ৯ বর্ডার পুলিশ নিহত হয়, আহত হয় পাঁচ জন। এ সময় বেশ কিছু অস্ত্র এবং ১০ হাজার রাউন্ড গুলী নিয়ে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা।
এরপরই রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের শহর মাউঙ্গদাওয়ে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ। তিনশ’ মানুষের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। হামলাকারীরা পিস্তল, তলোয়ার এবং ছুরি নিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করা হয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, এই সংঘাতের ফলে গৃহহীন সাধারণ রোহিঙ্গারা হামলার শিকার হবে। বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র ‘গ্লোবাল নিউ লাইট’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি দাবি করেছেন, তাঁর সরকার সেখানে আইন প্রতিষ্ঠার জন্য হামলাকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য হচ্ছে।
তিনি জানিয়েছেন, কারা এই হামলা চালিয়েছে সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নয় কর্তৃপক্ষ। সেনাবাহিনীর সংবাদপত্র ‘মিয়াওয়াদি’ জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকালে কিয়েটিয়োপিন গ্রামে ১০ হামলাকারী নিহত হয়। তাদের অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে বুধবার সশস্ত্র হামলাকারীরা ২৫টি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এছাড়া তারা কিয়েটিয়োপিন গ্রামের বর্ডার পুলিশ কোয়ার্টারেও হামলা চালায়।
রোববার থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ নিরাপত্তাকর্মী সহ নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৯ জন। স্থানীয় এক ব্যক্তি সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানান, নিহত ২৬ জনের মধ্যে সাধারণ মানুষও ছিল, যাদের হাতে অস্ত্র ছিল না, কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখে ভয়ে পালানোর সময় তারা নিহত হয়। এছাড়া আরও চারজনকে আটক করে নিরাপত্তাবাহিনী। আটক ওই মুসলিম ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এসব এলাকায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে এবং মিয়ানমারের সরকারকে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
২০১২ সাল থেকে রোহিঙ্গা ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আজও অবস্থান করছে ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ। তাদের চলাফেরায় অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না তারা। -ডিডব্লিউ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button