দেওবন্দের মূলনীতির বাইরে কওমী সনদের স্বীকৃতি মানা হবে না
দেওবন্দের মূলনীতি ও কাঠামো অনুযায়ী কওমী সনদের স্বীকৃতি দিতে হবে অন্যথায় স্বীকৃতি মেনে নেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশের সভাপতি ও হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী। এ নীতির বাইরে গিয়ে কোন ষড়যন্ত্র হলে তার বিরুদ্ধে সকল আলেমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি আহবান জানান।
গতকাল সোমবার রাজধানীর মিরপুর আরজাবাদ মাদরাসা মাঠে ‘কওমী স্বীকৃতি’ বিষয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় কওমী উলামা মাশায়েখ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ আহবান জানান।
এ সম্মেলন থেকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ইং প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গঠিত ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ও কমিটির সকল কার্যক্রম বাতিল করার প্রস্তাবসহ ৮টি প্রস্তাব পাস করা হয়। সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন শাইখুল হাদীস মাওলানা আশরাফ আলী, আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, শায়খুল হাদীস মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবীগঞ্জী, মাওলানা মোহাম্মদ তৈয়ব জিরী, মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ ওয়াক্কাস, শায়খুল হাদীস মাওলানা নূর হোছাইন কাসেমী, মাওলানা জোনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা আনোয়ার শাহ, মাওলানা মোস্তফা আযাদ, মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ফরিদাবাদ, মাওলানা আবুল কালাম, মাওলানা আব্দুল হামীদ পীর সাহেব মধুপুর, মাওলানা মোবারক উল্লাহ বি-বাড়িয়া, মাওলানা আতাউল্লাহ হাফিজ্জী, মাওলানা হিফজুর রহমান, মাওলানা নূরুল ইসলাম খিলগাঁও, মাওলানা সাজেদুর রহমান, মাওলানা মাওলানা আবুল কালাম, মুফতী মীযানুর রহমান সাঈদ প্রমুখ।
আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী বলেন, এদেশে কওমী মাদরাসাসমূহ দেওবন্দের নীতি আদর্শ মতে পরিচালিত হয়, কওমী সনদের ইস্যুসহ যেকোনো বিষয়ে দেওবন্দের নীতি আদর্শের পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। ভারতে দারুল উলূম দেওবন্দ যেভাবে পরিচালিত হয়, সনদের মান নির্ধারণে দেওবন্দের নীতিমালা যেরকম, এদেশে কওমী মাদরাসা পরিচালনা করা এবং সনদের মান নির্ধারণ সেভাবেই হতে হবে। তিনি বলেন, অন্য কোনো পন্থা মানা হবে না। বাংলাদেশে কওমী মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি না থাকাটা নতুন সমস্যা নয়, এটা বৃটিশ আমল থেকে চলে আসছে, কিন্তু হঠাৎ করে বর্তমান ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার কওমী সনদের সরকারি স্বীকৃতি দিতে অতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। কোনো কোনো উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে যেন তেনভাবে এ স্বীকৃতি গ্রহণে অতি উৎসাহী অপতৎপরতা গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করছে। গত কয়েক বছরের সংবাদ ও ঘটনা পর্যালোচনা করলে এ ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কওমী স্বীকৃতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরদার ঐক্য গড়ে তোলার জন্য তিনি উলামায়ে কেরামদের প্রতি আহবান জানান।
আল্লামা আহমদ শফী বলেন, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসা দীন ও ইসলামের বহুমূখী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছে, যার ফলে ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে সারাপৃথিবীতে দারুল উলূম দেওবন্দ একটি বহুল পরিচিত প্রতিষ্ঠান, স¤্রাজ্যবাদী বৃটিশের হাত থেকে এ উপমহাদেশকে মুক্ত করার পিছনে দেওবন্দের অবদান অবিস্মরণীয়। এদেশের কওমী মাদরাসাসমূহ সেই দারুল উলূম দেওবন্দেরই অনুসারী, দেওবন্দের মতই এসব প্রতিষ্ঠান ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ঈমান-আমল, আখলাক ও নৈতিক চিন্তাধারা গঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে আসছে এবং কোরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী চরিত্রবান দেশপ্রেমিক সুনাগরিক তৈরি করা এবং ইসলাম মহান বাণী সর্বস্তরের জনসাধারণের নিকট পৌঁছে দেয়া-ই কওমী মাদরাসার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।
তিনি আরো বলেন, এদেশে কওমী মাদরাসার সাথে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আত্মার সম্পর্ক বিদ্যমান। এ মাদরাসাসমূহ সম্পূর্ণভাবে স্বায়ত্ত শাসিত। দেওবন্দের অষ্টক মূলনীতিই হলো এ প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্দেশিকা। এ মূলনীতির অন্যতম হলো- এসব প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা ও মৌলিকত্ব অক্ষুণœ রাখার স্বার্থে সরকারি সাহায্য গ্রহণ না করা ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকা। তবে এটা রাষ্ট্র বা সরকারের কর্তৃপক্ষ হওয়া নয় বরং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করে ও সংবিধানের আনুগত্য প্রদর্শনে (কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী না হলে) কওমী মাদরাসা কখনো পিছপা হয়নি।
আল্লামা আহমদ শফী আরো বলেন, গত দেড়শত বছর থেকে স্বাধীনভাবে চলে আসা কওমী মাদরাসাসমূহের শিক্ষা সনদের মান দেওয়ার লক্ষ্যে কওমী মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠন, বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারীসহ সরকার নানান পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব প্রক্রিয়ার পিছনে কারো কারো অতি মাত্রায় আগ্রহ সম্পর্কে আমরা কম-বেশি অবগত। কিন্তু এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাই কারো কারো অতি উৎসাহমূলক তৎপরতা দেখে কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা, স্বায়ত্ত শাসন অক্ষুণœ রাখার বিষয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমরা মনে করি যে, শত বছর ধরে চলে আসা কওমী মাদরাসার স্বকীয় নীতি আদর্শ, স্বাধীন শিক্ষাক্রম, পরিচালনা বিন্দু মাত্রও নষ্ট হবে না এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এমন নিশ্চয়তা পেলেই আমরা সরকার থেকে দাওরায়ে হাদীসের সনদের মান নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনায় বসতে পারি। অন্যথায় আমরা যেভাবে আছি সেভাবে থাকাই আমাদের জন্য নিরাপদ।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের বেশ কিছু ধারা কওমী মাদরাসা স্বাধীনভাবে চলার পরিপন্থী, তারপরেও আমাদেরই কারো কারো অতি উৎসাহে সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েই চলছে। সঙ্গত কারণেই আমাদের সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসকল বিষয়ে চূড়ান্ত অবস্থান নির্ণয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। আর এ প্রেক্ষিতেই আজকের জাতীয় কওমী উলামা মাশায়েখ সম্মেলন। তিনি সম্মেলনে আগত উলামা-মাশায়েখগণকে ধন্যবাদ দিয়ে আগামীতেও যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐক্যের ডাক আসলে সর্বাত্মক সাড়া দেওয়ার আহবান জানিয়ে দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় দোয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব সমূহের মধ্যে রয়েছে :
১. দারুল উলূম দেওবন্দের আদলে কওমী মাদরাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদকে ইসলামী স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্যে এম.এম-এর সমমান দিতে হবে এবং তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে হবে।
২. প্রস্তাবিত কওমী মাদরাসা শিক্ষনীতি-২০১২ এবং এর আলোকে তৈরিকৃত কওমী মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৩ এর খসড়া বাতিল করতে হবে।
৩.২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ইং প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গঠিত ৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ও কমিটির সকল কার্যক্রম বাতিল করতে হবে।
৪. যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার নামে কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা ও স্বতন্ত্রতা বিলুপ্ত হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে।
৫. দেশের ৯২ ভাগ মুসলমানের সন্তানেদেরকে ইসলামী বুনিয়াদী শিক্ষা দেয়া ফরজে আইন। আবহমান কাল থেকে এ ফরজে আইনের কাজটি আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যমান সকল নূরানী মক্তব, হাফেজিয়া কওমী মাদরানা। সে কারণেই এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনাকে সরকারি বাধ্যবাধকতার আওতামুক্ত রাখতে হবে।
৬. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং তদালোকে প্রণীত শিক্ষা আইন ২০১৬এর খসড়া অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
৭। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে চক্রান্তমূলকভাবে বাদ দেয়া ইসলামী ভাবধারার গল্প, রচনা ও কবিতাসমূহ পুনঃ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং হিন্দুত্ববাদী ও ইসলাম বিদ্বেষী কবিতা, গল্প ও রচনাবলী শিক্ষা সিলেবাস থেকে বাদ দিতে হবে।
৮. শিক্ষার সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষাকে (যা ফরজে আইন) বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৯. পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন পর্যালোচনা কার্যক্রমে দক্ষ ও বিজ্ঞ আলেমগণের পরামর্শ নিতে হবে।