সোভিয়েত সমাজতন্ত্র পতনের পর

কনক জ্যোতি: বিশ্বের দেশে দেশে এবং বাংলাদেশেও কমিউনিস্ট সমাজতন্ত্রীদের উল্লম্ফন দেখে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের ঘটনাগুলো মনে পড়ে। কঠিন লৌহ প্রাচীরে ঘেরা সমাজতন্ত্র কিভাবে তাসের ঘরের মতো ধসে গিয়েছিল, সেটা তো বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমরাও নিজ চোখে দেখেছিলাম। তারপর সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ নিয়ে বহু গ্রন্থ রচনা হয়েছে; গবেষণা চলেছে। এবার একটি ভিন্নধর্মী গ্রন্থ চোখে পড়ল। ‘সেকেন্ডহ্যান্ড টাইম’ নামের ৫৭০ পাতার এই বই অদ্ভুত এক অনুভূতি এনে দিয়েছে। সংশয়, বিষণ্নতা, জীবনের খুঁটিনাটি উল্লেখ করে সমাজতন্ত্রের পতনের বাস্তবসম্মত কার্যকারণ দেখিয়েছে বইটি। মানুষ কেন সমাজতন্ত্র থেকে স্বেচ্ছায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং কমিউনিস্টদের প্রত্যাখ্যান করেছে সেটা খুবই সত্যনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বইটিতে।
বইটির লেখক বেলারুসের ৬৮ বছরের লেখক স্বেতলানাকে দুনিয়া চিনেছে গতবছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কল্যাণে। তার আগে তাঁর বই স্বদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে, দেশ ছাড়তেও হয়েছিল তাকে। নোবেল পাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘রুশ শিল্পের জগৎটা আমার পছন্দের। স্তালিন বা পুতিনের জগৎ নয়।’ এই বইটি গল্প-উপন্যাস নয়। ১৯৯২ থেকে ২০১২ অবধি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রজন্মের সৈনিক, অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ীদের ইন্টারভিউ করেছিলেন স্বেতলানা। খুঁজতে চাইছিলেন ‘সোভোক’ কাকে বলে? উল্লেখ্য, সোভিয়েতের মানুষকে ঠাট্টা করে সোভোক বা ‘হোমো সোভিয়েটিকাস’ বলা হয়।
সোভিয়েত ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই সোভোকরা কেমন আছে, বইটিতে সেটাই অনুসন্ধান করা হয়েছে। মানুষ এখন স্বৈরতন্ত্রের ভয়ে কাঁপে না। আতঙ্কে দিন কাটায় না। এখন রাস্তায় দুর্ঘটনা দেখলে তারা মোবাইলে খচাত খচাত ছবি তোলে। এই বইয়ে এক মায়ের সাক্ষাৎকার আছে। মস্কোর মেট্রো স্টেশনে বিস্ফোরণে তাঁর মেয়ে আহত। লোকে রক্তে ভেসে-যাওয়া আহতদের বের করে মেঝেতে শুইয়ে দেয়, অ্যাম্বুল্যান্স আসে। তারই মধ্যে কিছু অফিসযাত্রী মোবাইলে ক্যামেরা তাক করে আহতদের ছবি তোলে ও সোশাল নেটওয়ার্কে হা-হুতাশ করে। সমাজতন্ত্র-পরবর্তী পরিস্থিতির এমনই ছবি তুলে ধরেছেন তিনি।
সোভোক আসলে দলবদলের মাস্টারপিস; কলকাতায় যেমন ঔপনিবেশিক-ব্রিটিশ আমলে সুবিধাবাধী মধ্যবিত্ত ছিল, বাবু-বাঙালি ছিল, সোভোকরা কিছুটা তেমনই। সমাজতন্ত্রের পতনের জন্য তলে তলে তারা তৈরিই ছিলেন। গোরবাচেভ আমলের শেষ দিক, কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা রোজ রাতের বেলায় রাস্তার ডাস্টবিনে তাদের মেম্বারশিপ কার্ড ফেলে দিয়ে যায়, সকালে ঝাড়ুদারদের এসব সরাতেও কোনো কুণ্ঠা হত না। এক নেতা সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘এখানকার সবচেয়ে ভাল স্কুলের হেডমাস্টারমশাই তার দু’বছর আগে ব্রেজনেভের ওপর চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পার্টি থেকে পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ব্রেজনেভ-ভক্ত সেই কমিউনিস্ট শিক্ষক একদিন আমাকে রাস্তায় দেখে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, “এই স্তালিনবাদী হারামজাদা, তোদের দিন শেষ, জানিস তো?” নেতা পরে কথায় কথায় স্বেতলানাকে আসল দুঃখ জানিয়েওছেন, “আমাকে স্তালিনবাদী বলল? আমার বাবাকে স্তালিনের আমলে সাইবেরিয়া পাঠানো হয়েছিল। বাবা স্তালিনকে ক্ষমা করলেও আমি কোনও দিন করিনি।” সমাজতন্ত্র সোভিয়েত সমাজকে বিভক্ত করেছিল বলেই বইটি দাবি করে।
স্তালিনকে ক্ষমা না করেও কমিউনিস্ট নেতা? সোভোক ট্রাজেডি এখানেই। স্বেতলানা ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে দেখছেন, অনেকের পিতা, পিতামহ কট্টর স্তালিনের আমলে কারাগারে ছিলেন। তাঁরা জানতেন, কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহকর্মী বা আত্মীয় তাঁদের নামে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে চুকলি কেটেছিলেন। ঘটনাটা নতুন নয়। ইতিহাসবিদ অরল্যান্ডো ফিগ্স বছর কয়েক আগে তাঁর ‘হুইস্পারার্স’ বইয়ে দেখিয়েছিলেন, স্তালিনের আমলে সোভিয়েত দেশে ‘হুইস্পার’ কথাটার দুটি অর্থ দাঁড়ায়ে গিয়েছিল। একটি ফিসফিসানি। অন্যটি পিছনে লাগানিভাঙানি বা চুকলি কাটা। অনেক সমাজেই এখন ছায়াশত্রু ঘুরছে। সন্দেহ ও বিভেদ ছড়াচ্ছে। জনতার মধ্যে শত্রু আর মিত্র নামক বিভক্তি বানাচ্ছে। স্বৈরতন্ত্রে এমন বিভাজনই স্বাভাবিক।
স্বেতলানার ওরাল বা কথ্য হিস্ট্রি এগিয়েছে আরও অনেক দূর। সাইবেরিয়া বা কারাগার থেকে যারা বেঁচে ফিরতেন, তারা আজীবন নীরব। তাঁরা জানতেন, কোন বন্ধুর সৌজন্যে দিনের পর দিন তাঁদের জেলে থাকতে হয়েছে, কিন্তু কখনও প্রকাশ করতেন না। উল্টে তার সঙ্গে আগের মতো আড্ডা ও ভদকা নামক মদ্যপান করতেন। নাগরিকগণ মনের ভিতরে ভিতরে নিঃশব্দে পড়ে পরিবর্তনের অপেক্ষা করত সে সময়। এই ছিল সমাজতন্ত্রের অধীনে মানুষের নিম্নতম ব্যক্তি-স্বাধীনতার ট্রাজেডি। দহনে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে গোটা জাতি। শিকার বা শিকারি কেউই রেহাই পায়নি।
অনেক উদাহরণ আছে বইটিতে। ইয়েলতসিনের আমলে মস্কো থেকে এক ভদ্রমহিলা কাজাখস্তান যাচ্ছেন। তাঁর বাবা সেখানে স্তালিনের শ্রমশিবিরে বন্দী ছিলেন, সেখানেই মারা যান। যাওয়ার পরে স্থানীয়রা বলেন, ‘শ্রম শিবির? সেই ইতিহাস মুছে গিয়েছে। ওই যে বড় শপিং মল, সনা বাথ দেখছেন, ওখানেই ছিল কাঁটাতার ঘেরা শ্রম শিবির নামক বন্দীশালা।’ ফেরার পথে মহিলাকে গাড়িতে লিফট দেয় এক যুবক। তার বাবা ওই শিবিরে প্রহরী ছিলেন। চাকরির খাতিরে বন্দীদের অনেককেই চাবুক মেরে লাল-সমাজতন্ত্রকে আরো লাল করে দিতে হত। ক্রুশ্চেভের আমল থেকে বারংবার বদলির আবেদন জানিয়েছেন, লাভ হয়নি। শুধু প্রহরীরা নন। বন্দীদের যে ট্রেনে চাপিয়ে মস্কো থেকে আনা হত, তার ড্রাইভার এবং গার্ডদের আজীবন জনমানবহীন স্তেপভূমিতেই থাকতে হয়েছে। রেহাই কেউ পাননি।
সোভোকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, একটি বিশেষ শব্দের মানে খুঁজতে গিয়ে সে বারংবার হয়রান হয়েছে। শব্দটি হলো, ফ্রিডম বা স্বাধীনতা! সোভিয়েত আমলে আলু খেয়ে পেট ভরাতে হত, এখনও! বরং তখন রেশনের লাইনে দাঁড়ালে সারা মাসে এক কেজি মাংসও পাওয়া যেত না। এখন, ইয়েলতসিনের আমলের সংস্কারের পর সেই টাকায় এক ছটাক গমও জোটে না। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর এক অফিসার তাই ফুটপাথে চাদর পেতে তাঁর পদকগুলি বিক্রি করেন। আমেরিকান টুরিস্টরা ওই সব জাঙ্ক ভাল দামে কেনে। একজন বলে, “আমাদের মা-বাবারা গোরবাচেভকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁরা স্বাধীনতা বলতে বুঝেছিলেন, মানবিক সাম্যবাদ। পরে আমরা স্বাধীনতা মানে বুঝলাম, বড়লোক হওয়া। হরেক রকম জিনিস আর সালামি কেনার টাকা। বড়লোক না হলে, তুরস্কে ছুটি কাটানোর সামর্থ্য না থাকলে সবাই তোমাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে।” আশি শতাংশ দেশবাসী দারিদ্র্যে ধুঁকছে, বাকিদের যেন যেমন-তেমনভাবে বড়লোক হতেই হবে। মানুষ এখন বলেন, “গণতন্ত্র বলবেন না। শুধু খনিজ তেল আর গ্যাস বেঁচে গণতন্ত্র আসে না। সুইস চকোলেটের মতো ওটা আমদানি করা যায় না। গণতন্ত্র একটা অভ্যাস, সেটা শাসকদের নেই।”
সমাজতন্ত্রের আগে সোভিয়েত রাশিয়ায় ছিল আরেক স্বৈরশাসন। জারতন্ত্র গত শতকের ইতিহাস। তার পরেও লেনিন, স্তালিন, ক্রুশ্চেভ, গোরবাচেভ, পুতিন অবধি পেরিয়ে কেনই বা আসে না গণতন্ত্র? কথা বলতে বলতে একজন বলছেন, “কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বপুরুষেরা আমাদের জন্য শুধু সেনাবাহিনী মার্কা কিছু স্লোগান রেখে গিয়েছিলেন। ‘পার্টির অনুগত সৈনিক’, ‘শস্য ফলানোর সংগ্রাম’। ছোটবেলায় স্কুলে ‘ইয়ং পায়োনিয়ার’ হওয়ার সময় শপথ নিতে হত, ‘মাতৃভূমিকে আমি সবচেয়ে ভালবাসি।’ তিন বছর বয়সে মুখস্থ করতে হত, ‘মাই ডার্লিং রাইফেল/ফ্লাই, হট বুলেট, ফ্লাই।’ মানুষকে দেশনেতারা মানুষ বানাতে চাননি। চেয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত করতে। বইয়ে আর একজনের আক্ষেপ, “আমরা জার্মানদের হারিয়েছিলাম। পরমাণু অস্ত্রসম্ভারে পশ্চিমী দুনিয়া আমাদের ভয় পেত।” অন্য একজন বলেন : “কিন্তু একটা ওয়াশিং মেশিন বা ভিসিআর দেখলে আমাদের বিস্ময়ের অবধি থাকত না। জীবনকে যুদ্ধ ও হিংসার আগুনে পুড়িয়েছিল সমাজতন্ত্র।”
জাতীয়তাবাদী, যুদ্ধবাজ এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিজেদের অস্ত্রাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়। আজারবাইজানের এক মেয়ে বলে, ‘স্কুলে শেখানো হয়েছিল সশস্ত্র সৈনিকদের ভালবাসতে। কিন্তু সোভিয়েতের পতনের পর যারা বোমা, পিস্তল নিয়ে বাড়িতে হামলা চালিয়ে বলল, মস্কোয় কেটে পড়! তারা তো দুগ্ধপোষ্য শিশু। কিছুদিন আগেও আমরা সোভিয়েত ছিলাম। আজ কেউ জর্জিয়ান, কেউ ইউক্রেনিয়ান!” শাসনের চরিত্রেই কি ছিল এই ধ্বংসের বীজ? কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তানের লোকেরা জানায়, আগে মস্কোয় তারা অতিথি হিসেবে গণ্য হত। এখন বেআইনি অভিবাসী শ্রমিক। যাকে কম টাকায় যথেচ্ছ খাটিয়ে নেওয়া যায়, প্রতিবাদে খুন হয়ে গেলেও পুলিশ খবর রাখে না। সোভোক আজও তাই একনায়ক খুঁজে বেড়ায়। বইয়ের অনেক চরিত্র মাঝে মাঝেই বলে ওঠে, “বুঝেছেন, স্তালিন থাকলে সব ঠাণ্ডা হয়ে যেত।”
স্বেতলানার বইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এখানেই। স্বেতলানা ভূমিকায় লিখছেন, ‘আমি সমাজতন্ত্র নিয়ে কাউকে প্রশ্ন করিনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম ওঁদের শৈশব, প্রেম, বার্ধক্য, ছোট ছোট হিংসা, ঈর্ষা নিয়ে। কীভাবে ওঁরা চুল বাঁধতেন, রান্না করতেন সে-সব নিয়ে।’ নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি অভ্যন্তরীণ সমাজতন্ত্রকে খুঁজতে চেয়েছি। কীভাবে সে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে।’ প্রভাব যে আসলে নেতিবাচক ছিল, সেটা জ্বলজ্বল করছে পতিত সমাজতন্ত্রেও মরা-পচা লাশের কঙ্কালে।
আসলেই দুর্ভাগা সে দেশ, যেখানে শুধু লৌহমানব/মানবী বা বীরেরই প্রয়োজন হয়। যেমন : সাবেক সোভিয়েতের লোকেরা ইন্টারভিউ দিতে দিতে রসিকতা করে, ‘রুশ ভাষায় সবচেয়ে ছোট্ট রসিকতাটা জানেন তো? পুতিন একজন গণতান্ত্রিক মানুষ।’ এক তরুণ বলে, ‘নতুন ঠাট্টাটা শুনেছেন? একজনের প্রশ্ন ছিল, কোথায় কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হওয়া যায়? উত্তর এলো, পাগলা গারদে।’ এই রসিকতা কি পদে পদে মনে পড়িয়ে দেয় না চেক লেখক মিলান কুন্দেরাকে, যিনি সমাজতন্ত্রের আঘাতে জর্জরিত এবং সমাজতন্ত্রের আড়ালে আসলে যে স্বৈর-অমানবিকতন্ত্র ছিল, সেটাকে উন্মোচন করতে পারঙ্গম। সমাজতন্ত্রে নিষ্পেষিত মানুষ ভেবেছিল, সাম্যবাদ সব ঠিক করে দেবে। কিন্তু সেটা ছিল এক বিরাট ধাপ্পা। আর এখন বলা হচ্ছে, বাজার-অর্থনীতি সব ঠিক করে দেবে। এটাও এক উগ্র-আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ তৈরি করছে। সমাজতন্ত্রের পতনের পর সাবেক কমিউনিস্টরা এখন এক বিভ্রান্ত রাজনৈতিক সত্তা। যারা নিজের অস্তিত্বকে পরজীবীতে পরিণত করেছে। নানা দল ও নেতাকে ভর করে একদলীয়করণের সুপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছে মানুষের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button