সৌদী সরকারের অর্থায়নে পাওয়ার প্ল্যান্ট ও কাগজ কারখানা

indদৈনিক ১ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সৌদি সরকারের অর্থায়নে চন্দ্রঘোনায় আরো একটি নতুন পেপার মিল স্থাপিত হতে যাচ্ছে। নতুন কাগজ কল স্থাপনে  দৈনিক ১ হাজার টন সমান বছরে ৩০ লাখ টন কাগজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সৌদি আরবের বিখ্যাত উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান আলরাজি গ্রুপ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে সম্মত হয়েছে। উৎপাদিত কাগজের শতকরা ৩৯% বাংলাদেশ এবং ৬১% সৌদি আল রাজি গ্রুপের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় বলে মিল সূত্রে জানা গেছে। সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামালের মাধ্যমে কাগজ উৎপাদন করা হবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিসিআইসি এবং আল রাজি গ্রুপের মধ্যে গত ২০ অক্টোবর একটি দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতা স্বাক্ষর হয়।
শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর উপস্থিতিতে বিসিআইসির পক্ষে সংস্থার সচিব হাসনাত আহম্মেদ চৌধুরী এবং সৌদি আরবের মেসার্স আল রাজি কোম্পানী ফর ইন্ড্রাষ্টি অ্যান্ড ট্রেড এর পক্ষে কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউসিফ আল রাজি স্বাক্ষর করেন। এসময় শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া এনডিসি, সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীসহ শিল্প মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
চলতি অর্থ বছরে ১-৩ মার্চ শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমু সৌদি আরব সফর কালে সেদেশের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ড. তাওফিগ ফাওজান আলআরাবিয়াহ এবং সৌদি বিনিয়োগকারীদের সাথে দীর্ঘ  বৈঠক করেন। এসময় কাগজ সহ উদীয়মান শিল্পখাতগুলোতে বিনিয়োগের সৌদি উদ্যোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীতে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪-৬ সৌদি আরব সফর কালে জেদ্দা চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত এক সভায় সৌদি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
এ প্রেক্ষিতে আল রাজি গ্রুপের পক্ষ থেকে বিসিআইসি আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড (কেপিএম) সংলগ্ন কারখানা নিজস্ব জমিতে ৩৬০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট সহ বার্ষিক ৩ লক্ষ টন কাগজ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একটি কাগজ কারখানা স্থাপন করা হবে। বিদ্যুৎ কারখানায় উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে।
সূত্র জানায়, পুরাতন কাগজ কলের পাশে নতুন কাগজকল স্থাপনের মাধ্যমে প্রাথমিক কাজ শুরু করা হবে। নতুন মিল স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত পুরাতন যন্ত্রপাতি দিয়ে কেপিএমের উৎপাদনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হবে। নতুন মিল স্থাপিত হওয়ার পর পুরাতন মিলটি সরিয়ে ফেলা হবে। নতুন কাগজ কল চালু হলে প্রায় ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
১৯৫১ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশের অধীনে ৬৭.৫৭ মিলিয়ন রুপি ব্যয়ে চন্দ্রঘোনায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময়ে  পূর্ব পাকিস্তানে ৩১টি হাতে  তৈরি কাগজের এন্টারপ্রাইজ এবং ১শহ ২২ জন শ্রমিক সহ একটি কার্বন কাগজ  তৈরির ইউনিট ছিল। এ সকল প্রতিষ্ঠানে কাজ করত ৫৫ জন পুরুষ, ৫১ জন মহিলা ও ১৬ জন শিশুশ্রমিক। কর্ণফুলি পেপার মিলটি শিল্প আইনের অধীনে নিবন্ধিত প্রথম কাগজশিল্প যা ত্রিশ হাজার শ্রমিক নিয়ে এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজ-কল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মিলটি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন, ইতালির সহযোগিতা ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় স্থাপিত হয়। বাৎসরিক ৩০ হাজার টন ধারণক্ষমতা নিয়ে ১৯৫৩ সালে মিলটিতে উৎপাদন শুরু হয়। মিলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্প কয়েক বছরের মধ্যে এর ধারণক্ষমতা হ্রাস পায়। পরবর্তী সময়ে মিলটি পাকিস্তানের দাউদ গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজের নিকট ভর্তুকি মূল্যে খুবই স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করা হয়। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের দাউদ গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজ মিলটির সুষম আধুনিকায়ন ও যৌক্তিক উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
চন্দ্রঘোনায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে কাঁচামাল প্রাপ্তির অপার সম্ভাবনা এবং কর্ণফুলী নদী পথে ভারী যন্ত্রপাতি কাঁচামাল পরিবহন সুবিধা থাকায় কর্ণফুলী কাগজ কল স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকা কর্ণফুলী কাগজ কলের অধিভুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করে। প্রকৃতিক উৎস থেকে কাঁচামাল প্রাপ্তি ও পরিবহন সহজ হওয়ায় কয়েক বছরের ব্যবধানে কাগজ কলটি লাভ করতে শুরু করে। এ মিলের লভাংশ দিয়ে কয়েক বছরের ব্যবধানে কর্ণফুলী রেয়ন এন্ড কেমিক্যালস লি: প্রতিষ্ঠা করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০০ সাল পর্যন্ত মিলটি পর্যায়ক্রমে লাভের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে।
২০০১ সাল থেকে কর্ণফুলী কাগজকল কর্তৃপক্ষের অনিয়ম, অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও দুর্বল প্রশাসনের কারণে ক্রমান্বয়ে লোকসানে পরিণত হয়। মিলে বর্তমানে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩শ কোটি টাকা বলে মিল সূত্রে জানা গেছে। কারখানায় আর্থিক ও কাঁচামাল সংকটের কারণে দিনে এনে দিনে খায় অবস্থা বিরাজ করছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে যে কোন সময় কর্ণফুলী পেপার মিলস লি: (কেপিএম) বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে এই লোকাসানী প্রতিষ্ঠানটি বিসিআইসির কালো তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হয়। সরকার শত চেষ্টা করেও মিল কর্তৃপক্ষ বিসিআইসির কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেলেও মিলটি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কোন সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে মেহনতি শ্রমিক কর্মচারীরা জানান।
২০১২ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ২শ শ্রমিক অবসরে গেলেও তাদের গ্র্যাজুয়িটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পায়নি বলে জানা গেছে। শুধুমাত্র কাঁচামাল সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো এফআরএম বিভাগের কাছে পাওনা রয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানী লিমিটেড মিলের নিকট প্রায় ৫০ কোটি পাওনা আছে। মিলের চুন, লবণ, কষ্টিক সোডা, ট্যালকম পাউডার, চুনা পাথর, ক্লোরিং গ্যাস সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রায় ৩০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সব মিলিয়ে মিলের অবস্থা খুবই করুণ।
কর্ণফুলী পেপার মিল লিমিটেড এর মহা ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রকৃতিক উৎস থেকে কাঁচামাল (বাঁশ-নরম কাঠ)  দিয়ে উৎপাদিত কাগজ মান খুবই উন্নত এবং টেকসই। তিনি আরো বলেন, নতুন কাগজ কল নির্মিত হলে দৈনিক গড়ে ১ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে বাৎসরিক ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদন করা সম্ভবনা রয়েছে। যদি উৎপাদনের স্বাভাবিক রাখা যায় তাহলে বছরে শত কোটি টাকা মিল লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে সৌদি সরকারের প্রতিষ্ঠান আলরাজি গ্রুপ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পার্বত্য এলাকায় প্রকৃতিক কাঁচামালের উৎসস্থল পরিদর্শন করেন।
বিভিন্ন কাঁচামাল সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মিল কর্তৃপক্ষ যথাসময় বিল পরিশোধ করতে পারলে কাঁচামালের সংকট হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। পার্বত্য এলাকায় কাগজ উৎপাদনের প্রধান সহায়ক বাঁশ এবং নরম কাঠের প্রচুর মজুদ রয়েছে বলে সৌদি আল রাজি গ্রুপকে অবহিত করেন।
গত ১৯ অক্টোবর সৌদি আল রাজি গ্রুপের একটি প্রতিনিধি দল কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড (কেপিএম) পরিদর্শন করেন। ২০ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার এবং সৌদি আল রাজি গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর হয়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button