বৈশ্বিক অগ্রগতি সূচকে ১১ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখলেও রাষ্ট্র হিসেবে সার্বিক অগ্রগতিতে গত এক বছরে ১১ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। সার্বিক অগ্রগতি অর্জনে বিশ্বের ১৪৯টি দেশের মধ্যে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১১৪। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৩।
এমন তথ্য উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান লিগাটাম ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘প্রসপারিটি ইনডেক্স র্যাঙ্কিংস ২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ব্যবসার পরিবেশ, সুশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মতো নয়টি বিষয়ে একটি দেশ গত এক বছরে কতটুকু উন্নতি অথবা অবনতি করলো, সে ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও সুশাসন, সামাজিক পুঁজি ও ব্যবসায় পরিবেশ সূচকে উন্নতি করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে সার্বিক ক্রমতালিকায় পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০০৭ সাল থেকে গত ৯ বছরে এ সূচকে বাংলাদেশ ২০ ধাপ উন্নতি করেছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি সূচকে চলতি বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৭। ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও যথেষ্ট সংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়ায় জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের জোগান হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। গ্রামাঞ্চলের স্বল্প দক্ষ নারীরা এ খাতে বেশি কাজ করেন। রফতানিতে তৈরি পোশাক খাতের ওপর অতিনির্ভরশীলতার সমালোচনাও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই এ খাত থেকে আসে। এটির বহুমুখীকরণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হবে।
ধর্মীয় উগ্রবাদ গত এক বছরে বাড়লেও নিরাপত্তা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ কোনো বড় ধরনের জাতিগত সংঘাত অথবা গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়েনি। রাতে একা চলাফেরায় ৮০ শতাংশ বাংলাদেশী নিজেদের নিরাপদ মনে করে। এটিও নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের ভালো করার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে ধর্মীয় উগ্রবাদ, রাজনৈতিক সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কিছু বিষয়ের কারণে নিরাপত্তা সূচকে গত সাত বছরে বাংলাদেশ ১৪ ধাপ পিছিয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে। এ সূচকে দেশটির অবস্থান ১৩৮। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাওয়ার কারণে এ সূচকে বাংলাদেশ খারাপ অবস্থায় আছে। আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে উর্বর জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, নদীর পানিতে দূষণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সুপেয় পানির সরবরাহ কমছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় নগর অঞ্চলে বায়ুদূষণ বাড়ছে এসব কারণে পরিবেশ রক্ষা সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে সুখী, নিরাপদ ও অগ্রসর দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে নিউজিল্যান্ড। এ বছরসহ টানা চারবার দেশটি ১ নম্বর স্থানে রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন দুই দিকেই সবচেয়ে ভালো করায় ১ নম্বর স্থান পেয়েছে নিউজিল্যান্ড। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ নরওয়ে। চার বছর ধরে দেশটি দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে। ইউরোপের আরেক দেশ ফিনল্যান্ড রয়েছে তালিকার তৃতীয় স্থানে। শিক্ষা সূচকে শীর্ষ স্থান পাওয়া সুইজারল্যান্ড রয়েছে ৪ নম্বরে। আর ৫ নম্বরে আছে কানাডা। শীর্ষ দশে থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ডেনমার্ক ও যুক্তরাজ্য। অর্থনীতির আকারে সবচেয়ে বড় দেশ যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে তালিকার ১৭ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা। দেশটি তালিকার ৫৬ নম্বরে রয়েছে। এ ছাড়া নেপাল ৯৪ ও ভারত ১০৪ নম্বর অবস্থানে রয়েছে।
ব্যবসায়িক পরিবেশ সূচকে ১ নম্বরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ ব্যবসা করার জন্য দেশটির পরিবেশ বিশ্বে সবচেয়ে ভালো। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৪। একটি দেশে ব্যবসা শুরু করতে গেলে উদ্যোক্তারা কেমন পরিবেশ পান, অবকাঠামো সুবিধা কেমন, নতুন উদ্ভাবনে প্রতিবন্ধকতা কতটা, শ্রমবাজারের সহনশীলতা কতটুকু এমন বিষয় সূচক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
সুশাসন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯। এতে শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড ও নরওয়ে। শাসনব্যবস্থা, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও আইনের শাসনের মতো বিষয়গুলোকে এ সূচকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শিক্ষা সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে ১১৯ নম্বরে। এ সূচকে শীর্ষ তিনে রয়েছে যথাক্রমে সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও ফিনল্যান্ড। শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার, শিক্ষার মান ও মানবসম্পদকে এ সূচক নির্ধারণে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯ নম্বরে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে উন্নত দেশ হলো লুক্সেমবার্গ। এরপরের অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ড। একটি দেশের নাগরিকেরা প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন কি না, চিকিৎসা অবকাঠামোর মান ও বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক ব্যবস্থার মতো পদক্ষেপগুলোকে এ সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ব্যক্তিস্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ১০৫ নম্বরে স্থান পেয়েছে। এ সূচকে শীর্ষে রয়েছে লুক্সেমবার্গ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে কানাডা ও নিউজিল্যান্ড। মৌলিক আইনগত অধিকার সুরক্ষায় একটি দেশ কতটুকু উন্নতি করল, সামাজিক সহনশীল অবস্থান আছে কি না, এসব বিষয় এ সূচকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।