মহান বিজয় দিবস উদযাপিত

Bijoyআমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের ৪৬তম জন্মদিনে লাল-সবুজের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল গোটা দেশ। মহান বিজয়ের ৪৫তম বার্ষিকীতে শুক্রবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নানা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় শোক-শ্রদ্ধা আর আবেগের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের এই দিনটিতে তাদের প্রতি যেমন ঘৃণা জানানো হয়, তেমনি বীর সেনাদের প্রতি জ্ঞাপন করা হয় ফুলেল শ্রদ্ধা। এদিন জাতির পক্ষ থেকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার বিজয় দিবসে দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের শপথ নেন।
সরকারি ও সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় বিজয়ের সাজপোশাকেই নাগরিকরা ঘরের বাইরে বের হয় সকালে। বিজয় র‌্যালি করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও হয় নানা অনুষ্ঠান। সার্বিক আবহে মনে হয় যেন, দেশপ্রেমিকরা আরেকটা যুদ্ধ করতে চায় অব্যাহত শোষণ-বৈষম্য আর গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা হলো গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়বিচার। একাত্তরে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর একগুয়েমী ও শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই এদেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সূর্যোদয়ের সময় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকা পুরাতন বিমান বন্দর এলাকায় একত্রিশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির অনুষ্ঠানমালার সূচনা করা হয়। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
কুচকাওয়াজ-২০১৬ অনুষ্ঠিত: শুক্রবার সকাল দশটায় জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে বিজয় দিবস কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি থেকে কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও  সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল আবু এসরার প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানান। কুচকাওয়াজ শেষে প্রেসিডেন্ট প্যারেডে অংশগ্রহণকারী সকল কন্টিনজেন্ট কমান্ডারদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ, সংসদ সদস্যগণ, উর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাগণ এবং বৈদেশিক কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এবারের বিজয় দিবস কুচকাওয়াজে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর লেঃ জেনারেল (অব.) জি এস সিহোতার নেতৃত্বে ২৭ জন বীর যোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিলেন। এছাড়াও রাশিয়া সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি দলও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত বিজয় দিবস কুচকাওয়াজে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, সশস্ত্র বাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অংশগ্রহণ করে। কুচকাওয়াজে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১২০ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বৃহৎ জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হয়। বিজয় দিবস প্যারেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৯ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং এবং এরিয়া কমান্ডার, সাভার এরিয়া, মেজর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন ৮১ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ টি এম আনিসুজ্জামান।
এছাড়া যান্ত্রিক বহরের অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন ৯ আর্টিলারি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নোমান মো: শিব্বির আহমেদ। কুচকাওয়াজের যান্ত্রিক বহরে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্বলিত সুসজ্জিত গাড়ি বহর প্রদর্শিত হয়। এছাড়া সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপারগণ আকাশ থেকে অবতরণ করে কুচকাওয়াজকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলেন। বিভিন্ন যান্ত্রিক বহরের প্রদর্শনীর পরই শুরু হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মনোজ্ঞ ফ্লাইপাস্ট ও এরোবেটিক ডিসপ্লে। বিমান বাহিনীর ফ্লাইপাস্টের নেতৃত্ব দেন এয়ার কমডোর মোহাম্মদ মফিদুর রহমান।
কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ অন্যান্য বেসরকারি টেলিভিশন এবং রেডিও চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এবারের প্যারেড বিভিন্ন আঙ্গিকে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন ও প্যারেডকে উপভোগ্য করতে সার্বিক সাজসজ্জায় নতুন মাত্রা আনা হয়। বিজয় দিবস কুচকাওয়াজ উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে আসার পথে সড়কগুলোতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় দিবসের চেতনা সম্বলিত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যানার ও বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সেনাবাহিনী, সদরঘাট এলাকায় নৌবাহিনী এবং মিরপুর ২ নম্বর স্টেডিয়ামে বিমান বাহিনীর বাদক দল দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাদ্য পরিবেশন করে। এছাড়াও সেনাসদরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ভিডিপি এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বাদক দল কর্তৃক বাদ্য পরিবেশন করে।  নৌবাহিনীর নির্ধারিত জাহাজসমূহ ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জের পাগলা নেভাল জেটি, চট্টগ্রামের নিউমুরিং-এর নেভাল জেটি, খুলনার বিআইডব্লিউটিএ রকেট ঘাট, বাগেরহাট মংলার দিগরাজ নেভাল বার্থ এবং বরিশালের বিআইডবি¬উটিএ জেটি রকেট ঘাটে সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য দুপুর ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা হয় বলে আইএসপিআর’র এক প্রেস  বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
বিভিন্ন পেশার হাজার-হাজার মানুষ প্রায় দুই ঘণ্টারব্যাপী কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন। এ উপলক্ষে প্যারেড গ্রাউন্ডকে সুচারুভাবে স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় চার নেতা এবং সাত বীর শ্রেষ্ঠদের ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৬তম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ৫টি স্মারক ডাক টিকেট, দু’টি উদ্বোধনী খাম, দু’টি ডাটা কার্ড এবং একটি স্মরণিকা অবমুক্ত করেছেন। সকালে গণভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি স্মারক এবং বিশেষ সীলমোহরের মাধ্যমে ডাকটিকেট অবমুক্ত করেন। বিজয়ের ৪৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে (১৯৭১-২০১৬) প্রধানমন্ত্রী ১৬ টাকা মূল্যের বিশেষ একটি স্মারক ডাকটিকিট এবং একই সঙ্গে ৩, ৭, ১০ ও ১২ টাকা মূল্যের আরও চারটি ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন। পাশাপাশি দশ টাকা মূল্যমানের দুইটি উদ্বোধনী খাম এবং ৫ টাকা মূল্যমানের দুইটি ডাটা কার্ড এবং ৪৫ টাকা মূল্যমানের একটি স্যুভেনির অবমুক্ত করেন তিনি।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব মো. ফয়জুর রহমান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, ডাক বিভাগের মহাপরিচালক প্রবাস চন্দ্র সাহাসহ ডাক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সকাল ১০ টায়  বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ সাহানে কুরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় ১৬ ডিসেম্বর শাহাদাতবরণকারী সকল শহীদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মুনাজাত করা হয়। এছাড়া দেশ ও জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করেও মিলাদ ও মুনাজাত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪৫তম বার্ষিকীতে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এদিন সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বিজয় শোভাযাত্রা শুরুর আগে নাট্যকর্মী-শিল্পী-সংগঠকরা এ আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button