চলে গেলেন আযানের পাখি ক্বারি উবায়দুল্লাহ

ubaydullahকিছু কণ্ঠ ব্যতিক্রম। সামান্য পয়সা কামাতে ব্যবহার হয় না। হয়, অসামান্য প্রতিদানের আশায়। স্রষ্টার নিয়ামতের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার করেন তারা। ক্বারি উবায়দুল্লাহ। এরকমই এক কণ্ঠের অধিকারী। তাঁর সুললিত কণ্ঠকে ব্যবহার করেছেন জগতের সর্বোৎকৃষ্ট কাজে। কুরআনের তিলাওয়াত আর নামাযের আহ্বানের সাথে তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল, যেন তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, এই কাজের জন্যই।
রেডিও-টিভিতে তাঁর দেয়া আজান শুনেনি বাংলাদেশে এমন একজন অমুসলিমও পাওয়া যাবে না। টিভিতে আজানের সাথে দেয়া মক্কা-মদিনার ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেকেই ভাবতেন, সৌদি আরবের কোনো শায়খের আযান। আমি এমনও মহিলাকে চিনতাম, যিনি জীবনে টিভিতে আযান ছাড়া কিছু দেখতে বসেন নি। আযানের সুর শুনে দৌড়ে আসতেন টিভির সামনে।
কিন্তু এই মহামূল্যবান মানুষটির মূল্যায়ন জাতি কীভাবে করল! ৮-১০ বছর ধরে অর্থের অভাবে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মানবেতর জীবন কাটিয়ে চলে গেলেন আল্লাহু আকবারের সান্নিধ্যে। রাজধানীর ঐতিহাসিক চকবাজার শাহী জামে মসজিদের খতিব কারী উবায়দুল্লাহ আর নেই। ধানমন্ডিতে নিজের কন্যার বাসায় মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ৭টায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
কারী মো. উবায়দুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তিনি ২ ছেলে, ৬ মেয়ে, স্ত্রী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে চকবাজার এলাকায় শোকের ছায়া নেমে অাসে।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা গ্রামে ১৯৪৪ সালে জন্মেছিলেন কারী উবায়দুল্লাহ। ১৯৬২ সাল থেকে ২০০৬ সালে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী চকবাজার শাহী মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই কারী। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের ৩৩টি দেশ সফর করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন কারী উবায়দুল্লাহ। তার রেকর্ড করা আজান দীর্ঘদিন প্রচারিত হয়েছে সরকারি এ দুটি চ্যানেলে। জাতীয় সংসদের প্রতিটি অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে তার কোরআন তেলাওয়াত ছিল নিয়মিত।
বাংলাদেশের জাতীয় ক্বারীর স্বীকৃতি পাওয়া মাওলানা ক্বারী উবায়দুল্লাহ রাষ্ট্রপতির ভাষণ, বাজেট অধিবেশনসহ জাতীয় সংসদের গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন, রাষ্ট্রপতির বিশেষ কোনো প্রোগ্রামে, রেডিও, টেলিভিশনে, সর্বত্র কোরআনের তেলাওয়াত দিয়ে মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক ক্বিরাআত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য সুনাম কুড়িয়েছেন। সেই সাথে চকবাজার শাহী মসজিদের খতীব হওয়ায় প্রতি জুম্মায় পবিত্র কোরআনের মর্মবাণীও ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছেন মুসলমানদের।
বিভিন্ন দ্বীনি মাহফিলে বক্তব্য রেখেছেন। নসিহত করেছেন লোককে। জীবন ভর কোরআন সংশ্লিষ্ট খেদমতে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। কোনো প্রতিদান চান নি। নীতির প্রশ্ন আপোষও করেন নি কখনও। কাউকে হেয়-ও করেন নি আবার তেলও মারেন নি। যে যুগে টেলিভিশনে সুযোগ পাবার জন্য একশ্রেণীর ক্বারী সাহেবান লাইন ধরে থাকেন, সেই যুগে এমনও হয়েছে যে, টেলিভিশন থেকে লোক এসছে গাড়ী নিয়ে, টিভিতে তেলাওয়াতের উদ্দেশ্য নিয়ে যাবার জন্য কিন্তু তিনি গাড়ী ফিরিয়ে দিয়েছেন কিরআতের ক্লাস করাচ্ছিলেন বলে। দারস্ ছেড়ে উঠেন নি। রাষ্ট্রীয় অফার ফিরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট বড় ঈমানী কলিজা লাগে। সেরকম বিশাল একটি কলিজা নিয়েই জন্মেছেন তিনি।
কখনোই কোনো দুর্বলতা ছিল না তাঁর। নিজের জন্য কিছুই করেনি। এবং তার’চেও আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সেই চেষ্টাই করেন নি কখনো। ঢাকার লালবাগ চাদনীঘাটে জীর্ণ-শীর্ণ এক ঝুপড়ীতেই বাস করেছেন। খাট-বিছানাও ছিল সাধারণ মানের। চাইলে অনেক কিছুই করতে পারতেন তিনি, কিন্তু কোরআনের সুর যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে, তার আর কী চাই?

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button