ডটবাংলা ডোমেইন ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ

banglaবহুল প্রত্যাশিত ডটবাংলা ডোমেইন ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ। গত ৫ অক্টোবর ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এই তথ্য নিশ্চিত করার পর দেশে তথ্যপ্রযুক্তি জগতে বিরাজ করে আনন্দের আমেজ। তবে ডোমেইন প্রক্রিয়া সহজ করার দাবি করছেন প্রযুক্তিবিশারদরা। নইলে এর ব্যবহার জনপ্রিয় করা যাবে না বলে শঙ্কা তাদের।
ডটবাংলা পাওয়ার ঘটনা দেশের জন্যে বড়ো গৌরবের বিষয় বলে মনে করছেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার।
তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ, যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে। জীবনও দিয়েছে।এর বিনিময়ের আমরা বাংলাকে পেয়েছি মাতৃভাষা হিসেবে। এদেশের মানুষ বাংলা ডোমেইন ব্যবহার করতে পারবে না তা হতে পারে না।’
ডটবাংলার সুবিধার বিষয়টি সামনে এনে তিনি বলেন, ‘বাংলায় ডোমেইনের নাম লিখতে পারবো এটাই বড় সুবিধা। আমরা অনলাইনে বাংলা ব্যবহার করি, কিন্তু যে ডোমেইন নামটা থাকে সেটায় রোমান হরফ ব্যবহার করতে হয়। আমরা বাংলা হরফ ব্যবহার করতে পারি না। আমি মনে করি এটাই বড় সুবিধা।’
বেসিস সভাপতি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯৬ ভাগের একমাত্র ভাষা হচ্ছে বাংলা। অতএব আমি যখন এই জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চাই, তখন আমাকে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। অনলাইনে যোগাযোগে মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রবণতা কিন্তু পৃথিবীজুড়েই বাড়ছে।’
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ ও সিয়েরা লিওন ডটবাংলা ডোমেইন পেতে ডোমেইন নাম বরাদ্দকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারনেট করপোরেশন অব অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস-আইসিএএনএন এর কাছে আবেদন করেছিলো। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বরাদ্দ পেল বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ ২০১২ সালে একবার এই ডোমেইন ব্যবহারের অনুমতি পেয়েও সেটি সক্রিয় করতে পারেনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বলেন, ‘এটা খুব আনন্দের বিষয় যে আমরা বাংলায় ডোমেইন ব্যবহার করতে পারবো। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আগের যে ডোমেইন ডটবিডি বার বার ডাউন হয়ে যায়। যার কারণে ব্যবহারকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এমন যেন ডটবাংলার ক্ষেত্রে না হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডটবাংলার নিবন্ধন প্রক্রিয়া যেন সহজভাবে করা যায়। নিবন্ধন করতে গিয়ে যেন আমলতান্ত্রিক হয়রানিতে পড়তে না হয়। তবেই দেশের মানুষ এর সুফল পাবে।’
ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের সভাপতি রাজিব আহমেদ বলেন, ‘ডটবাংলা একটি সেবা, এটাকে সেবার মত করেই দেখতে হবে। এটাকে জটিলতামুক্ত রেখে পরিচালিত করতে হবে।আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশ তাদের ডোমেইনকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেয়। আমাদের দেশেও তা নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিটিসিএলের মনিটরিং টিম যাতে সচল থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ২৪ ঘন্টা সেবা দিতে পারলে ডটবাংলা ডোমেইন অবশ্যই জনপ্রিয়তা পাবে।’
ডট বাংলা হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য একটি দ্বিতীয় ইন্টারনেট কান্ট্রি কোড টপ-লেভেল ডোমেইন (সিসিটিএলডি)। এই ডোমেইন বাংলা ভাষায় ওয়েব ঠিকানার জন্য বোঝানো হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এ দুটি ডোমেইনের মালিক। মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ডট বিডি ডোমেইন ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। এ বিষেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ-ই মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ডোমেইন উদ্ধারে এখন তারা তত্পর হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ শুধুমাত্র সেকেন্ড লেভেল ডোমেইন ব্যবহার করতে পারছে। দেশে .com.bd, .net.bd, .org.bd, .gov.bd, .ac.bd, .mil.bd ইত্যাদি ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও ২০১২ সালে অনুমদন পেলেও .বাংলা ডোমেইন ব্যবহার শুরু করেনি বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, .বাংলার তত্তাবধানকারী ঠিক না হওয়া, টিএলসিডি দেশগুলোর ক্লাবে সদস্যপদ না পাওয়া এবং .বাংলার রুট ডেলিগেশন না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এ প্রকল্প দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। অন্যদিকে কোন পদ্ধতিতে ডট বাংলা ডোমেইন চালু করা হবে সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। এমন নানান জটিলতার মধ্যে দিয়ে পার হয়েছে তিন বছর। সবশেষে তার মালিকানাও হারালো বাংলাদেশ।
সমগ্র পৃথিবী জুড়ে অনেক দেশ তাদের নিজেদের এবং অনেক শহর নিজেদের টপ লেভেল ডোমেইন ব্যবহার করছে। যেমন .ca – কানাডা, .ru – রাশিয়া, .se – সুইডেন, .fr – ফ্রান্স, .in – ভারত ইত্যাদি। বাংলাদেশও এই টপ লেভেল কান্ট্রি ডোমেইন (টিএলসিডি) চালু করার জন্য ৫ বছর আগে উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে আইকানের কাছে আবেদন করেন। এতে আইসিএএনএন বাংলা ভাষার জন্য স্ট্রিং ইভ্যালুয়েশন (বাংলা অক্ষরগুলো চেনার জন্য নির্দিষ্ট কোড- (আইডিএন সিসিটিএলডি) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ইন্টারনেট অ্যাসাইন্ড নাম্বারস অথরিটি (আইএএনএ) বাংলার জন্য কোডটি (আইডিএন সিসিটিএলডি) অনুমোদনও (ডিএনস রুট জোনে ডেলিগেট) করে। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে .বাংলার অনুমোদনও পাওয়া যায়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক ঠিক না হওয়ায় চূড়ান্তভাবে এটি পায়নি বাংলাদেশ। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) না বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) কে তত্ত্বাবধান করবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার।
আইকান (ইন্টারনেট কর্পোরেশন ফর অ্যাসাইন্ড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস) ইন্টারনেটে ডোমেইন নাম তালিকাভূক্তির প্রতিষ্ঠান। আইকানের কাছে ডট বাংলা নিবন্ধিত হওয়ার পর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি বাংলা ভাষাভাষী বাংলায় ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল। ফলে ইংরেজি, চায়নিজ, ফ্রেঞ্চ, কোরীয়, আরবি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ ভাষার পাশাপাশি বাংলায়ও ইন্টারনেটের কার্যক্রম চলতে পরতো। জানা গেছে, বিশ্বের ১৫০টি দেশ টিএলসিডি সদস্য হলেও বাংলাদেশ এখনও এই ক্লাবের সদস্য নয়। গত বছর ২৪ মে ঢাকা সফরকালে এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের (এপনিক), সাধারণ পরিচালক পল উইলসন ও জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা শ্রীনিবাস চেন্দি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিউ ইয়ু-চাং বাংলাদেশে এক মতবিনিময় সভায় জানিয়েছিলেন, টপ লেভেল কান্ট্রি ডোমেইন পেতে হলে বাংলাদেশকে আগে এই ক্লাবের সদস্য হতে হবে। এদিকে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, তাহলে এই ৫ বছরে এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটি কী করেছে? ওই ক্লাবের সদস্য না হলে যেখানে অন্য কোনও কাজের মূল্য নেই সেখানে ডট বাংলা ডোমেইনের অগ্রগতি কী তা সহজেই অনুমেয়।
এদিকে ২০১৩ সালে ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি চায়নিজ ও আরবিসহ নতুন ২৭টি ভাষায় ইন্টারনেট ঠিকানার (ডোমেইন) নামের প্রাথমিক অনুমোদন দেয় আইকান। তবে এ তালিকায়ও বাংলা ডোমেইনের নাম পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালে আইক্যান ডোমেইনের পরিধি বিস্তারের ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণায় প্রায় ২ হাজার আবেদন জমা পড়ে। বাংলাদেশের আবেদন আগে থেকেই জমা ছিল। ওই তালিকা থেকে ২৭টি ভাষায় ডোমেইনের অনুমোদন দেওয়া হলেও বাংলা ছিল না। ধারণা করা হয়েছিল ওই তালিকায় বাংলা থাকবে। তবে বাংলা না থাকলেও কেন বাংলা নেই সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে দেয়া যায়নি।
ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম বাংলাদেশ চ্যাপ্টার সূত্রে জানা গেছে, কর্তৃপক্ষ ঠিক না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে এ কাজে কোনও অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে গঠিত কমিটির একাংশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে ডট বাংলা চালু করা যেতে পারে বলে মত দিলেও অন্য অংশ বলেছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখলে এটি কার্যকারিতা হারাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডোমেইন ডট বিডি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) নিয়ন্ত্রণে থাকায় এটি সফল হয়নি। বরং ডট বিডির মাধ্যমে যারা সেবা নিচ্ছেন তারাই অনেক ক্ষেত্রে বিপদে পড়ছেন।
এদিকে অনলাইনে বাংলা কনটেন্টের দৈন্যও প্রকট। লিনাক্স ছাড়া সব অপারেটিং সিস্টেম ইংরেজিতে (যদিও বাংলা সমর্থিত), ইউনিকোডে না লিখে এখনো বাংলায় কোনো সার্চইঞ্জিনে তথ্য সার্চ দেয়া যায় না। অথচ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানালেন এসবের ৩৫ শতাংশ কাজ করা আছে, ৬৫ শতাংশ কাজ করলেই তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা আরো সমৃদ্ধ হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে ওসিআর (অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিকগনিশন), বাংলা অভিধান, স্পেল চেকার, টেক্সট টু স্পিচ, স্পিচ টু টেক্সট এবং স্ক্রিপ্ট ফন্ট (বাংলায় সনদ লেখার জন্য) নেই। এসবের অনেকাংশ প্রস্তুত থাকলেও শেষ করা যাচ্ছে না। শেষ করা হলে বাংলার অবস্থান তথ্যপ্রযুক্তিতে আরো ভালো হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button