সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই
ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বিদেশ সফরে শনিবার সকালে সৌদি আরব পৌঁছেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার এই সফরে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক চুক্তিসহ কয়েকেটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সৌদি বাণিজ্যমন্ত্রী মাজেদ কসবী বলেন, তার দেশ ২৩ বছরের জন্য কয়েকটি বড় বড় মাকির্ন কোম্পানিকে সৌদিতে বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দিবে। রিয়াদে আল-জাজিরার প্রতিনিধি জানান, যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের মধ্যে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১১০ বিলিয়ন ডলার সাবেক সামরিক চুক্তির জন্য। এর ভিত্তিতে ওয়াশিংটন সৌদি কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষনিকভাবে অস্ত্র সরবরাহ করবে। পাশাপাশি আগামী দশ বছরের জন্য ৩৫০ বিলিয়ন ডলার নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে। তিনি দুই দেশের মধ্যে শনিবার সম্পাদিত এই চুক্তিকে ঐতিহাসিক বলে বর্ণনা করেন।
শনিবার রিয়াদে ইয়ামামা প্রাসাদে মাকির্ন প্রেসিডেন্ট ও তার সহকর্মীদের অভ্যর্থনা জানানোর পর ট্রাম্পকে সৌদি বাদশাহ কিং আব্দুল আজিজ মেডেল পরিয়ে দেন। যে মেডেলকে সৌদিতে সবচেয়ে মর্যাদাবান মনে করা হয়।
এদিকে দৈনিক আল-আরাবিয়্যাহ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদির মাঝে যৌথ স্ট্রাটেজিক পরিকল্পনায় মোট ২৮০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সংঘটিত হয়েছে। এর ফলে দুই দেশেই হাজার হাজার কর্মসংস্থার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তেমনিভাবে দুই দেশের মাঝে সামরিক, ব্যবসায়িক, শক্তি, তেলক্ষেত্রে বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। সৌদির জাতীয় তেল কোম্পানী আরামকোর সাথে কয়েকটি চুক্তি হয়। স্বাস্থ্য, রিয়েল স্টেট, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা খাতে সহযোগিতা চুক্তি হয়। সামরিক খাতে যেমন ১৫০ টি ব্লাকহক হেলিকপ্টার, আকাশ প্রতিরক্ষা, বিমান প্রতিরক্ষা, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ, গোয়েন্দা তথ্যবিনিময় ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে।
সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের আমন্ত্রণে রোববার ‘আরব ইসলামিক আমেরিকান সম্মেলন’ এ যোগ দিবেন ট্রাম্প। সম্মেলনে ইসলামের শান্তিপূর্ণ দিক নিয়ে বক্তব্য দেবেন তিনি। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫৪টি দেশের সরকারপ্রধান যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
শনিবার দুপুরে রিয়াদ বিমানবন্দরে ট্রাম্পকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছেন সৌদি বাদশাহ। এই সফরে ট্রাম্পের সঙ্গী ছিলেন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প, ফার্স্ট ডটার ও ট্রাম্পের পরামর্শক ইভানকা ট্রাম্প, ট্রাম্পের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক জ্যারেড কুশনারসহ ট্রাম্প প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বিদেশীদের জন্য সৌদি সফরে পোশাকের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা থাকলেও সফরে কালো জাম্পস্যুট পরেন মেলানিয়া। কোমরে ছিলো সোনালি রঙ্গের বেল্ট। গলায় হালকা গহনা ও চুল ছেড়ে দেন তিনি। অন্যদিকে কালো রঙের ওপর সাদা কাজ করা গাউন পরেন ইভানকা।
ট্রাম্প পরিবারের সৌদি সফরের আগে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল বিন আহমেদ আল-জুবাইর বলেছেন, ‘মেলানিয়া ট্রাম্পের পোশাকের বিষয়ে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়নি। যে কোনো পোশাকেই তাকে সৌদি আরবে স্বাগত জানানো হবে।’
ট্রাম্পসহ যুক্তরাষ্ট্রের অতিথিদের সংবর্ধনা দেওয়ার পর বিমানবন্দরেই ট্রাম্প ও মেলানিয়ার সম্মানে ‘অ্যারাবিক কফি’ পানের আয়োজন করেন সৌদি বাদশাহ। আরব নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, কফি পান শেষে কফির পেয়ালা নাড়িয়ে বাদশাহ সালমান বুঝিয়ে দেন পেয়ালায় আর কফি অবশিষ্ট নেই এবং এটাই আরবের ঐতিহ্য বলে তিনি ট্রাম্পকে জানান।
এদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনএর খবরে বলা হয়, দেশের বিপর্যস্ত মূহুর্তে সৌদি সফরে গিয়েছেন ট্রাম্প। এফবি আই পরিচালক জেমস কোমিকে বরখাস্ত করার পর ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েছেন ট্রাম্প। চলতি সপ্তাহে রাশিয়া ইস্যুতে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে গিয়েছেন তিনি। তবে বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা এই পুরো পরিস্থিতিকে পেছনে ফেলে সামনের দিকেই এগিয়ে যেতে চাই।’
ট্রাম্পের এই সফর নিয়ে হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ সফরটাকে ‘বলা যায় বাঁচা-মরার ব্যাপার’। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফর সফল হলে চলমান সমালোচনা কিছুটা হলেও কাটাতে পারবেন ট্রাম্প। সিএনএন জানায়, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এই সফর নিয়ে চাপের মধ্যে আছেন। ট্রাম্পের সুনজরে আসার জন্য এই সফর সুন্দর ও সফল করাটাই এখন তাদের চেষ্টা। ইতোমধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বিদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় শান্তি, মানবাধিকারের বিষয়টিতে জোর দিতে ট্রাম্পকে পরামর্শ দিয়েছেন।
অন্যদিকে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুসলিম দেশ সফর করলেন ট্রাম্প। সিএনএনকে ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’র অ্যান্থনি কর্ডেসম্যান বলেন, বেশিরভাগ প্রেসিডেন্টই প্রথম বিদেশ সফরে মেক্সিকো কিংবা কানাডা গেছেন। তাই ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর নিয়ে দেশ ও দেশের বাহিরে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ট্রাম্প কি দেশের স্বার্থ নাকি নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন এটি পরিষ্কার নয়।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচআর ম্যাকমাস্টার বলেছেন, ট্রাম্পের এই সফরের তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব নতুন করে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে গড়া। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোসহ বিশ্বের প্রধান তিনটি ধর্মের মানুষের প্রতি একতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সৌদি ও মুসলিম বিরোধী অবস্থান নেন ট্রাম্প। ক্ষমতা গ্রহণের পর ৭টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ২০১৬ সালে উইকনসিস রাজ্যের রেসাইন কাউন্টিতে এক নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প সৌদি আরবকে সুরক্ষা প্রদানের যে নীতি ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করছে তার বিরোধিতা করেন। এর আগে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা। কারণ সৌদি আরবের তেলের ওপর ওয়াশিংটনের নির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমান হারে কমছে।