পল্লী কবির মেয়েকে এ কেমন সম্মাননা !
স্টালিন সরকার: ‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর; আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর; যে মোরে করিল পথের বিবাগী; পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি; দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হয়েছে মোর; আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর’ (জসীম উদ্দীন)। আবহমান বাংলার সুখ-দুঃখ, ধুলো-বালি, হাসি-কান্না, গ্রাম বাংলা নদ-নদী, ধান-শালিক-ঘাস-বন-বাদার-মাটির সোঁদা গন্ধ চিত্র যার কবিতায় উঠে এসেছে তিনি কবি জসীম উদ্দীন। যারা কবিতা লেখেন তারা সবাই কবি কিন্তু ‘দেশজ’ কবি নন। পল্লী কবি জসীম উদ্দীন প্রকৃত অর্থেই দেশজ কবি। পল্লী কবির এক মেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর ঘরে; আরেক মেয়ে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রবীণ রাজনীতিক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ঘরে। ‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর’ এই মানসিকতার জসীম উদ্দীন হলেও তাঁরই কন্যাকে ঘরছাড়া হতে হলো! কবির প্রতি এ কেমন সম্মাননা? যে দেশে কলকাতা বাংলা সিনেমার নায়িকা ‘সুচিত্রা সেনের’ স্মৃতি রক্ষার্থে পৈতৃক বাড়ি রক্ষায় গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র অস্থির হয়ে পড়ে; সে দেশে কবি জসীম উদ্দীনের কন্যাকে আইনের প্যাঁচে এমন অপদস্ত! জসীম উদ্দীন প্রতি আমাদের এটাই কি সম্মান? দেশের আইন আদালত তার নিজস্ব গতিতে চলবে সেটাই সবার প্রত্যাশা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেয়া রায় বাস্তবায়ন নিয়ম অনুযায়ী হবে সেটাও স্বাভাবিক। আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো দেশের প্রত্যেক নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু আদালতের রায় যারা কার্যকর করবেন প্রশাসনযন্ত্রের সেই বিভাগগুলো কী ‘সবার ক্ষেত্রে’ যথাযথ নিয়ম প্রয়োগ করছে? নাকি আদালতের রায় বাস্তবায়নের অজুহাতে রাজনৈতিক হিংসা-বিদ্বেষ বাস্তবায়ন হচ্ছে? প্রশাসনের কিছু বিভাগের কর্মকর্তাদের এই অতি দলবাজি কর্মকান্ড সরকারকে যেমন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছে; তেমনি সরকারের নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গুলশান-২ নম্বর সেকশনের ১৫৯ নম্বর প্লটের বাড়ি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আদালতে মামলা করে ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর। ১৩ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ওই বাড়িতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ স্ত্রী কবি জসীম উদ্দীনের কন্যা প্রখ্যাত সমাজকর্মী হাসনা মওদুদকে নিয়ে বসবাস করেন। জসীম উদ্দীনের কবিতা এ দেশের মানুষের চলার পথে পরতে পরতে উচ্চারিত। আর স্বনামধন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শুধু রাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নন; তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধেও তরুণ ব্যারিস্টার মওদুদের অবদান অসামান্য। পবিত্র রমজান মাসে প্রখর রোদে সেই মওদুদ আহমদকে যখন এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়; সে দৃশ্য দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয় সে চিত্র কী দৃষ্টিকটু নয়? এতে কার সম্মান বাড়ল এবং কার সম্মান হানি হলো সে প্রশ্নে না গিয়ে রাজউকের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রতি দেশের একজন নাগরিক হিসেবে প্রশ্ন ওই প্রতিষ্ঠানটি কী যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে? গুলশানের আলোচিত ওই বাড়ি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে তা কি যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়েছে? আইনের নিয়ম হলো আদালত কোনো রায় দিলে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ দখলদারকে বাড়িঘর বা স্থাপনা ছাড়তে নোটিশ দেয়ার মাধ্যমে সময়সীমা বেঁধে দেবেন। সেটা পালিত না হলে আইন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আদালত মওদুদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়নি। সময় চাওয়া বা আপিল করার সুযোগও দেয়া হয়নি। রাজউক নোটিশ না দিয়েই হঠাৎ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে এক কাপড়ে উচ্ছেদ করল। কবি জসীম উদ্দীনের কন্যাকে ঘড়ছাড়া হতে হলো? রাজউকের পক্ষে সাফাই গাইতে রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ সময় চাননি। প্রশ্ন হলো তাকে ‘সময় চাওয়ার’ কি সময় দেয়া হয়েছে? অবস্থা যেন ওই বাড়ি উদ্ধার করে রাজউক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করল। এই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ২৯৪টি এবং আজিমপুরে ১১৪টি বাড়ি অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেগুলো উদ্ধারে রাজউকের ভূমিকা কী?
প্রশ্ন হলো রাজউক আর কয়টি ক্ষেত্রে এত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে? রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাজ হলো পরিকল্পিতভাবে রাজধানীর উন্নয়নে রোডম্যাপ করা এবং তা বাস্তবায়ন করা। কিন্তু রাজউক কার্যত জমি ক্রয়-বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। এই ঢাকা শহরে শত শত বাড়ি বেদখল হয়ে রয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারি অনেক জমি-বাড়ি দখল করে রেখেছে প্রভাবশালী দখলদাররা। রাস্তা, পার্ক, ডোবা-নর্দমা দখল করে অনেকেই স্থাপনা নির্মাণ করে ব্যবসা করছে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। শুধু কী রাজউকের জমি! রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৪ একর এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৩ হাজার ৩৮৭ একর জমি বেদখল হয়ে আছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ২৯৪টি বাড়ি, আজিমপুরে ১১৪টি বাড়ি বেদখল বাড়ি নিয়ে মামলা চলছে যুগের পর যুগ ধরে। আরো অসংখ্য বাড়ি-স্থাপনা বেদখল রয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথের বহু ভ‚মি বেদখল অবস্থায় রয়েছে যুগের পর যুগ ধরে। ওই সব বাড়ি-ঘর ও জমি দখলমুক্ত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও রাজউকের উৎসাহ তেমন দেখা যাচ্ছে না। আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে বাড়ি ছাড়ার আইনি নোটিশ না দিয়েই মওদুদের বাড়ি দখলমুক্ত করতে এত তৎপরতা কেন? তাহলে কি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যে অভিযোগ করেছেন সেটাই সত্য? মওদুদ আহমদের অভিযোগ বিরোধী দল তথা বিএনপির রাজনীতি করেন বলেই তাকে অন্যায়ভাবে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলে এই বয়সে তাকে এই পরিণতি ভোগ করতে হতো না। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ করে বলেছেন, তাঁকে (বেগম জিয়া) যেমন ৪০ বছর ধরে বসবাসরত বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দেয়া হয়েছে; ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বেলায় সেটাই হয়েছে। ওদেরকেও (যারা অতি উৎসাহী হয়ে মওদুদকে বাড়ি ছাড়া করছে) একদিন জনগণ এভাবে এক কাপড়ে বের করে দেবে। প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি বাড়ি রক্ষায় রাজউকের এত ক্যারিশমার রহস্য কী?
মুক্তিযুুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনা’ বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতো একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনকে এভাবে ঘর থেকে বের করে দেয়া কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায়? গতকালও পত্রিকায় খবর বের হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ৭ বীরশ্রেষ্ঠের অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ আবদুর রউফের স্মৃতি মধুমতি নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভ্রুক্ষেপ শুধু গুলশানের একটি বাড়ি থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কন্যা সমাজকর্মী হাসনা মওদুদকে বের করে দিয়ে স্বীয় ‘দায়িত্ব’ পালন করা?