বন্যায় সিলেটে দুর্ভোগ চরমে
বন্যায় সিলেট ও মৌলভীবাজারে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছেন। এর মধ্যে সিলেটের ছয় উপজেলা ও মৌলভীবাজারের পাঁচ উপজেলার প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। দুই জেলার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রয়েছে।
খলিলুর রহমান সিলেট থেকে জানান, সিলেটের সাতটি উপজেলা দীর্ঘমেয়াদী বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে এসব উপজেলার প্রায় সকল রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর। এমনকি কয়েকটি উপজেলা পরিষদও বন্যার পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দী মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ। ফলে পানিবন্দী মানুষ ত্রাণের জন্য করছেন হাহাকার। তবে ত্রাণ বিতরণের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও গতকাল সোমবার সকাল থেকে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর, শরিফগঞ্জ ও বাদেপাশা ইউনিয়নের বন্য্কাবলিত এলাকা ঘুরে দেখেন এবং বন্যা কবলিত মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ।
এ সময় তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সরকার বন্যার্তদের পাশে আছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারি কাজ ফেলে আপনাদের পাশে ছুটে এসেছি। বন্যাকবলিত এলাকার একজন মানুষও না খেয়ে থাকবে না’ বলে প্রতিশ্রুত ব্যক্ত করেন শিক্ষামন্ত্রী। এছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী বন্যা কবলিত মানুষের খোঁজ-খবর নেন। দুর্গত লোকজনের হাতে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাতে প্রশাসনকে জোর তাগিদ দেন। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী সঙ্গে ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মিসবাহ।
সিলেটের ওসমানীগরে বন্যা কবলিতদের মধ্যে সরকারি ত্রাণ বরাদ্ধ অপ্রতুল হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। প্রথম ধাপে চৈত্র মাসের অনাকাংখিত বন্যায় ফসল হানির পর এলাকার প্রায় ৮ হাজার কৃষকের মধ্যে ৪হাজার কৃষক পরিবারকে ৩ মাস ৮ দিনের জন্য প্রতিমিাসে ৩০ কেজি হারে চাল ও নগদ ৫শ’ টাকা হারে বরাদ্ধ দেয়া হয়। এছাড়া ৩শ’ পরিবারকে ৫হাজার টাকা হারে মোট ১৫লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তা, শতাধিক দুস্থদের মধ্যে ১হাজার টাকা হারে আর্থিক সহায়তা বরাদ্ধ দেয়া দেয়। ঈদ উপলক্ষে ভিজিএফ’র আওতায় ২হাজার পরিবারকে ১০ কেজি হারে চাল প্রদান করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় দাপের বন্যায় প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে এলাকার অন্তত ৫ সহস্রাধিক পরিবার বন্যা কবলিত অবস্থায় মানবেতর অবস্থায় অনাহার অর্ধাহারে জীবন যাপন করলেও এখন পর্যন্ত দুই ধাপে ৬ মে. টন গম, ৮ মে. চাল ও নগদ ৩৬ হাজার টাকার বরাদ্ধ পাওয়া গেছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। অপ্রতুল এই ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে জনগণের গালমন্দ শোনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে ১টন চাল প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের জন্য প্রয়োজন বলে দাবি করেন জনপ্রতিনিধিরা।
গতকাল সোমবার উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন কেন্দ্রীয় আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মিসবাহ্ উদ্দিন সিরাজ, জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরী। তাদের সাথে ছিলেন আ.লীগ নেতা আতাউর রহমান, আনহার মিয়া, আবদুর রহমান, অরুনদয় পাল ঝলক, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রব প্রমূখ। অতিথিরা সাদীপুর ইউপির খসরুপুর গ্রামে সরকারি বরাদ্ধ পাওয়া ১টন চাল ১০ কেজি হারে বিতরণ করেন। এসময় অতিথিরা বন্যা কবলিতদের সরকারি সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দিয়ে হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানান।
গতকাল সোমবার উপজেলা দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরী সভায় ওসমানীনগরকে বন্যা দূর্গত উপজেলা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত চেয়ারম্যানবৃন্দ। এসময় স্থানীয় বিত্তবানরা বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
এদিকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এসএম নাছিমুল হোসেন জানিয়েছেন, এপর্যন্ত এলাকার ৩হাজার ৯শ’ ৭০ হেক্টর আউশ ফসলের মধ্যে বন্যায় ৪৩০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। তবে এই পরিসংখ্যান মনগড়া বলে দাবি করেছেন জনপ্রতিনিধিরা। ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মানিক, ময়নুল আজাদ ফারুক, তাজ মোহাম্মদ ফখর বলেন, হাজার হাজার পরিবার বন্যা কবলিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বর্তমান পরিস্থিতি একেকটি গ্রামে ১টন করে চালের প্রয়োজন রয়েছে। ত্রাণ বরাদ্ধ অপ্রতুল থাকায় জনগণের কাছে কোন জবাব দিতে পারছি না। অনেক সময় তাদের গরম সুরের কথাও শোনতে হচ্ছে।
এদিকে, মৌলভীবাজারে নতুন করে বন্যার পানি বাড়েনি। কিন্তু কুশিয়ারা নদী এবং হাকালুকি, কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওরের পানি না কমায় জেলার পাঁচটি উপজেলায় প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। বন্যাকবলিত এলাকার সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জেলার ১৪২টি প্রাথমিক ও ৪১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ আছে। এছাড়া জেলার বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া, রাজনগর ও সদর উপজেলার ২৩টি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিলেও বিশেষত হাকালুকি ও কাউয়াদীঘি হাওর এলাকায় এর প্রকোপ বেশি। এখানকার মানুষ প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কিছু পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য জুড়ীতে চারটি ও কুলউড়ায় আটটি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে । কুলাউড়ার ৭০টি গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছে। কুলাউড়ার উপজেলার ভুকশিমইল ইউপির চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ৭০ শতাংশ বাড়িঘরে পানি উঠেছে।’
অন্যদিকে, রাজনগর উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৩০ হাজার মানুষ। নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। পানি উঠায় অনেকে মাচা বেঁধে কোনও রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। এখানে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, জেলায় মোট ১৫২টি প্রাথমিক স্কুল বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বলেন, হাওর পাড়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। স্কুলগুলো তলিয়ে যাওয়ায় জেলার ৪২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক বলেন, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত জেলায় সর্বশেষ ২৯৪ মেট্রিক টন জিআর চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ৫৯ হাজার ২০০ ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে তিন ধাপে ৬৫০ মেট্রিক টন চাল, ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তিন মাসের জন্য ৫ হাজার ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল এবং ৫০০ করে টাকা দেওয়া হচ্ছে।