বিশ্বজয়ী হাফেজের হৃদয়কাড়া সুর
বিশ্ব মিডিয়ায় উঠে এসেছে এক বাংলাদেশি কিশোরের সাফল্যের কথা। ১০৩টি দেশের প্রতিযোগীদের পরাজিত করে বাংলাদেশের হাফেজ তরীকুল ইসলাম দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ২১তম আন্তর্জাতিক হিফজ প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অর্জন করেছেন। কোরআন প্রতিযোগিতায় এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অর্জন। বিশ্বজয়ী হাফেজ তরীকুলের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেন তানজিল আমির।
কোরআনের মাস রমজানে এক গৌরবময় অর্জনে দেশবাসীর অহঙ্কারে পরিণত হয়েছেন তরীকুল। রমজানের শেষের দিকে এক রাতে কথা হল তার সঙ্গে, বেড়ে ওঠা ও সফলতার গল্প শুনেছি তার মুখেই। স্কুল শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিকের ছেলে তরীকুলের হাতেখড়ি হয় কুমিল্লা দাউদকান্দির মালিগাঁও শামসূল উলুম মাদ্রাসায়। মক্তবের প্রাথমিক শিক্ষা শেষে হিফজ শুরু হয় যথাসময়ে। চাকরির কারণে বাবা থাকতেন বিক্রমপুর, তাই পড়াশোনায় শুরুর দিকে মনযোগ ততটা ছিল না। ভগ্নিপতি মাওলানা মাহমুদের নিয়মিত উৎসাহ ও প্রেরণায় এক সময় তিনি পড়ালেখায় মনযোগী হয়ে ওঠেন। একজন ভালো হাফেজ ও আলেম হতে হবে, এ প্রত্যয়ে নব উদ্যমে শুরু হয় তার পড়ালেখা। ভালো হাফেজ হওয়ার কেউ সে সংকল্পই তরীকুলকে আজ পরিচিত করেছে বিশ্বমহলে। ঢাকার কয়েকটি মাদ্রাসা মিলিয়ে হিফজ সমাপ্ত হয় তরীকুলের। হিফজ শেষে দাওরের জন্য ভর্তি হন হাফেজ নেসার আহমদ আন নাসীরি পরিচালিত মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায়। আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন দেখা তখন থেকেই।
তার ওস্তাদ নেসার আহমদের ভাষায়- ‘হাফেজ তরীকুল যখন আমাদের মাদ্রাসায় ভর্তি হল, তার তিলাওয়াত শুনে আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছি, এ ছেলেটির মাধ্যমে নতুন কিছু করা সম্ভব হবে। তাই শুরু থেকেই তাদের কয়েকজনকে নিয়ে আমাদের আলাদা মেহনত ছিল’। স্বপ্ন পূরণে পূর্ণ চেষ্টা শুরু করে তরীকুলও। সারা দিন পড়াশোনার পর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে যেত, মাদ্রাসার ওপরের তলায় তরীকুলের শুরু হতো আরেক সাধনা। প্রায়ই রাত ২-৩টা বেজে যেত। এ সময় দেশীয় বিভিন্ন হিফজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া শুরু করেন তরীকুল। ২০১৪ সালে মাছরাঙা টিভির আল কোরআনের আলো অনুষ্ঠানে ২য় স্থান অর্জন করেন। আকাশছোঁয়ার স্বপ্নটা যেন সত্যি হতে লাগল এবার। এ ছাড়া এনটিভি ও বাংলাভিশনের দুটি প্রতিযোগিতায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। এভাবে ধারাবাহিক সফলতায় ওস্তাদরাও তাদের এ মেধাবী ছাত্রকে নিয়ে আলাদা করে ভাবা শুরু করলেন। তিলাওয়াত ও কিরাতের গভীরতায় প্রবেশ করলেন তারা। গুরু-শিষ্য উভয়েই যেন নতুন কিছুর হাতছানি পেয়েছেন। এবার তাদের টার্গেট বিশ্বজয়ের। এরই মধ্যে দুবাই আন্তর্জাতিক হিফজ প্রতিযোগিতার বাছাইপর্ব শুরু হল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উত্তীর্ণ কোরআনের অলৌকিক পাখিদের নিয়ে প্রতিবছরই এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে দুবাইয়ের ধর্ম মন্ত্রণালয়। এ প্রতিযোগিতাটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোরআনের আসর। বিভিন্ন দেশের শ্রেষ্ঠ হাফেজরা এ আসরে অংশগ্রহণের জন্য মুখিয়ে থাকেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে বাংলাদেশের বাছাইপর্ব শুরু হল। ২৬০ জন প্রতিযোগী অংশ নেন বাছাইপর্বে। বাছাইপর্বে কয়েকটি ধাপে পরীক্ষা দিয়ে ১ম স্থান অর্জন করে তরীকুল বাংলাদেশ থেকে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। এভাবে ১২০টি দেশ থেকে উত্তীর্ণ হাফেজদের বাছাই করা হয়। বড় স্বপ্ন নিয়ে তরীকুলরা যখন দুবাইয়ে পৌঁছান, মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগেই ১৬টি দেশের প্রতিযোগী বাদ হয়ে যায়। এ যাত্রায় পরীক্ষার ধাপ আরও বেড়ে যায়। দুরু দুরু মনে তরীকুল মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। প্রতিদিন ৮টি দেশের প্রতিযোগীদের পরীক্ষা হতো। আরবের বিখ্যাত হাফেজ ও স্কলারগণ মোট ৫টি প্রশ্ন করতেন একজন প্রতিযোগীকে। তিলাওয়াত, ইয়াদ, উচ্চারণ, কণ্ঠ, দ্রুত উত্তর প্রদান সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছেন বিচারকরা। বিদেশের মাটিতে এত বড় আয়োজনে তরীকুল প্রথমে খানিকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মনোবল হারায়নি সে। চেষ্টার সঙ্গে দোয়াও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘প্রতিযোগিতা যেহেতু দেশভিত্তিক হচ্ছিল তখন ভয় হল, আমার জন্য বাংলাদেশের সুনাম যেন ক্ষুন্ন না হয়। এ জন্য সব সময় দোয়া করেছি, অন্তত প্রথম কয়েকজনের মধ্যে আমার নামটা যেন থাকে।’ কিন্তু সবাইকে পেছনে ফেলে তরীকুলের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ এক বিরল গৌরব অর্জন করবে, সেটি তরীকুলের ভাবনাতেও ছিল না। সে দিনের কথাটুকু তরীকুলের মুখেই শুনি, ‘বিজয়ীদের নাম ঘোষণা হচ্ছে, আমার অস্থিরতাও বেড়ে যাচ্ছে। একে একে সব বিজয়ীদের নাম বলা হল, মনে করেছি সুযোগটা এবার হয়তো হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু ১ম স্থান অধিকারীর নাম যখন বলা হল হাফেজ তরীকুল ইসলাম বাংলাদেশ, তখন সত্যি যেন আমি কিছু শুনিনি। বিশ্বাসই হচ্ছিল না ১০৩টি দেশের হাফেজদের আমি পরাজিত করেছি।’
তরীকুলের কাছে জানতে চেয়েছি, নাম ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার কাদের কথা মনে হয়েছে, তার কথা হল ‘তখন যে কী অবস্থা হয়েছিল নিজেই বলতে পারব না। আমার মনে হল দেশের ১৬ কোটি মানুষের দোয়া আমার সঙ্গে রয়েছে। তাদের দোয়াতেই আমি এতদূর এসেছি’। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে তরীকুল বিশ্বজয় করেছেন, সবাইকে আমরা জানিয়েছি, বাঙালিরাই এখন সবচেয়ে সুন্দর তিলাওয়াত করে।
হাফেজ নেসার জানালেন, প্রতিযোগিতা শেষে আরবের বিখ্যাত শাইখরা বাংলাদেশের তিলাওয়াত ও হিফজের পদ্ধতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে জেনেছেন। দুবাইয়ের আল মামজারের কালচারাল অ্যান্ড সায়েন্টিফিক অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়। দুবাইয়ের প্রিন্স শেখ আহমাদ বিন মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম তরীকুলের হাতে সম্মাননা ও নগদ অর্থ প্রদান করেন। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ষাট লাখ। আল কোরআন পুরস্কার সংস্থার প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বু-মুলহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সব দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন দুবাই ও উত্তর আমিরাত বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল এস বদিরুজ্জামান, কনস্যুলেটের লেবার কাউন্সিলর এএসএম জাকির হোসেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে তরীকুল জানান, ‘যে দেশের প্রতিনিধি হয়ে এতবড় অর্জন আমি করেছি, সে দেশের প্রতি অবশ্যই আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। কোরআনের মেহনতের জন্য বাংলাদেশ চমৎকার জায়গা। এ দেশের লাখো শিশু-তরুণ ছোট বয়সেই কোরআন মুখস্থ করে। কোরআনের প্রতি সবার আলাদা ভালোবাসা রয়েছে। আমার স্বপ্ন বড় হয়ে কোরআনকেন্দ্রিক নতুনভাবে কিছু কাজ করার, যা বিশ্বে আমরাই প্রথম শুরু করব। এ জন্য অবশ্যই বড় আলেম হতে হবে আমাকে। সবার দোয়া হবে আমার পাথেয়।’