মাওলানা মুহিউদ্দীন খান : তাঁর সাহিত্যকর্ম

mohiuddinমাহমুদ সালেহীন খান: যাদের হাত ধরে রচিত হয় ইতিহাস। কর্ম ও সাধনার এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে ওঠে তাদের দীর্ঘ প্রচেষ্টায়। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বাংলাদেশের এমনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। বাংলাভাষী মুসলমানদের তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। সে আলোয় তিনি এ দেশের মুসলমানদের পথ দেখিয়েছেন। দেখতে দেখতে এই মহান কর্মবীর আমাদেরকে ছেড়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন গত বছরের ১৯ রমজান। আজ এক বছর হয়ে গেল। তিনি রেখে গেছেন তার হাতে গড়া অসংখ্য সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং তার নিজ কর্মযজ্ঞ- যা আগামী এক শতাব্দীরও বেশি সময় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বড় নসিহত হয়ে থাকবে আমাদের জন্য।
মুুহিউদ্দীন খান সাহিত্য রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্যচর্চা ও অনুবাদ শাখাকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে তিনজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তির নাম না নিলে নয়। মাওলানা আব্দুর রহিম, অধ্যাপক আখতার ফারুক ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। সাহিত্যের মাধ্যমে পূর্ববাংলার গণমানুষকে জাগৃতির জন্য একযোগে কাজ করতে বিভাগ-উত্তর সময়ে ক’জন ধীমান ব্যক্তি পারস্পরিক অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন- তার মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান, কবি বেনজির আহমেদ, কবি ফররুখ আহমদ অন্যতম। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন তাদের উত্তরসূরি। তিনি ১০৫ খানা গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন। ইসলামি সাহিত্যচর্চায় অনুবাদ ও সীরাত সাহিত্য তার লেখার মান সর্বোচ্চ পর্যায়ের। কঠিন আরবি ফারসি, ঊর্দু ভাষাকে সহজ-সরলভাবে বাংলা অনুবাদ করেছেন। তিনি অনুবাদে একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করতে পেরেছেন। সেটি হলো- তিনি বাংলা উর্দু আরবি ফারসি মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করেননি। তার রচিত মৌলিক গ্রন্থেও এই বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রতি যত্নবান ছিলেন। মুফতি শফী উসমানী রচিত তাফসিরে মা’আরিফুল কুরআন (৮ খণ্ড) সাবলীলভাবে বাংলায় অনুবাদ করে তিনি বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে বিশুদ্ধভাবে কুরআন বোঝার সুযোগ করে দিয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য অনুবাদ সাহিত্য হচ্ছে- মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী রচিত চেরাগে মুহাম্মদ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ রচিত জীবনসায়াহ্নে মানবতার রূপ, আল্লামা মানজুর নুমানী রচিত ইরানী ইনকিলাব, ইমাম খোমেনী ও শিয়া মতবাদ, হযরত শায়খ শরফুদ্দীন বিন ইয়াহিয়া মানিরী-এর মালুফুজাত বাংলায় মারেফাত জ্ঞানের রত্নভাণ্ডার প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থ । বাংলাদেশে সীরাত সাহিত্য নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন। আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী এর “সিরাতে রাসুল আকরাম (সা)’ ও ‘আদাবুল মাসাজিদ’, আল্লামা শিবলী নোমানী ও আল্লামা সাইয়িদ সুলায়মান নদভী প্রণীত ‘সীরাতুনন্নবী’ সা, আল্লামা আব্দুর রহমান জামি কৃত ‘শাওয়াহিদুল নবুওয়াত’, ডা: আব্দুল হাই লিখিত ‘উসওয়ায়ে রাসুলে আকরাম (সা)’, শায়খুল হাদিস যাকারিয়া কান্ধলভী এর ‘প্রিয় নবীজীর অন্তরঙ্গ জীবন’ অনুবাদ করেন। এ ছাড়া সীরাতের ওপর রওজা শরীফের ইতিকথা, হাদিসে রাসুল (সা), স্বপ্নযুগে রাসুলুল্লাহ (সা), প্রিয় নবীজীর প্রিয় সুন্নতসমূহ, ‘নূরুল ঈমান (২ খণ্ড)’, ‘কুড়ানো মানিক’ (২ খণ্ড), ‘দরবারে আউলিয়া’, হযরতজী মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ (রহ), ‘ইসলাম ও সমকালীন বিস্ময়কর কয়েকটি ঘটনা’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।
তা ছাড়া তার রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের খেলাঘরে’। এই গ্রন্থটিতে তিনি চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রায় ইংরেজ শাসনামল থেকে এই অঞ্চলের মুসলমানদের রাজনীতি-সংস্কৃতির ইতহাস। এবং আধুনিক আরবি বাংলা ও বাংলা আরবি অভিধান ‘আল কাওসার’ প্রসিদ্ধি লাভ করে। তার সম্পাদিত মাসিক মদীনার প্রশ্নোত্তর সঙ্কলন ‘সমকালীন জিঙ্গাসার জবাব’ বিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
আলেমসমাজকে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধকরণে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সফল এক ব্যক্তিত্ব। তার প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় কওমি মাদরাসায় শিক্ষিত বিপুলসংখ্যক আলেম আজ বাংলায় সাহিত্যচর্চা করছেন বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় এবং টিভি মিডিয়ায়। তার এ অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় যুক্ত না হলে আলেমসমাজ জাতির মূল শ্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তেন।
১৯৬১ সালে তিনি মাসিক মদীনা প্রকাশ করেন, তখন বাংলা ভাষায় লেখালেখিতে আলেমসমাজের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। মাসিক মদীনার মাধ্যমে এক দিকে বাংলাভাষী শিক্ষিত মানুষের সামনে ইসলামকে তুলে ধরেছেন, অন্য দিকে বাংলা সাহিত্যচর্চায় উদাসীন উলামা সমাজের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছেন। মাসিক মদীনার সবচেয়ে জনপ্রিয় বিভাগ প্রশ্নোত্তর বিভাগ। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সুন্দর করে উপস্থাপন বিভাগটির জন্য পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নানা বিরূপতা সত্ত্বেও আজ বাংলা সাহিত্যে আলেমদের উপস্থিতি কোনোক্রমেই গৌন নয়। মাসিক মদীনার মাধ্যমে তিনি অসংখ্য লেখকের হাতে কলম তুলে দিয়েছেন যারা আজ আমাদের সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করছেন। সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান-এর মাধ্যমে তিনি অসংখ্য সাংবাদিক তৈরি করেছেন। তারা আজ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় টেলিভিশন চ্যানেলে সুনামের সাথে কাজ করছেন। বাংলাদেশে আদর্শিক ভাবধারা গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি আমাদেরকে ঋণী করে গেছেন মদীনা পাবলিকেশন্স প্রকাশনা সংস্থা করে। প্রায় অর্ধ যুগে ধরে এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে বের হয়েছে মহামূল্যবান গ্রন্থ। আজকে মূল্যবোধের ওপর যত প্রকাশনা সংস্থা আছে এবং যত আদর্শিক সাহিত্য পত্রিকা এমনকি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ইসলামি পাতা রয়েছে সবাই মুহিউদ্দীন খানের দেখানো পথ অনুসরণ করছেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের সম্পাদনায় সাহিত্য সঙ্কলন ও প্রচুর পত্রপত্রিকা বের হচ্ছে। বাংলা সাহিত্য ও প্রকাশনার অঙ্গনে এই কাম্যপ্রবাহ সৃষ্টির পেছনে মুহিউদ্দীন খান ও মাসিক মদীনার প্রভাব ও প্রণোদনাই প্রধান। লেখক, অনুবাদক, গবেষক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনেকের কাছে সমকালে সর্বাধিক সমৃদ্ধ অগ্রসর ব্যক্তিত্ব।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button