মুসলিম উম্মাহর বিভেদ নয় ঐক্য চাই

সরদার সিরাজ: চার-পাঁচশ বছর পরাধীন অবস্থায় মুসলিম জাতি চরম নির্যাতন, নিষ্পেষণ, শাসন-শোষণের কবলে পড়ে দরিদ্র জাতিতে পরিণত হয়। ফলে শিক্ষা, বিত্ত, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদিতে পিছিয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোরকালে বেশিরভাগ মুসলিম দেশ স্বাধীনতা লাভ করে অন্য কিছু অমুসলিম দেশের সাথে। কিন্তু অমুসলিম দেশগুলোতে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠত হলেও অধিকাংশ মুসলিম দেশে তা হয়নি। তাই সার্বিক উন্নতি হয়নি। ফলে বেশিরভাগ মুসলমান পূর্বাস্থাতেই রয়ে গেছে। তাই সামগ্রিকভাবে মুসলিম জাতি এখনো দুর্বলই রয়েছে। সর্বোপরি সমাজতন্ত্রের পতনের পর ইসলামী পুনর্জাগরন ঘটতে পারে সে আশঙ্কায় ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের দমিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহণ করেছে। যার অন্যতম হচ্ছে- মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ-সংঘাত সৃষ্টি ও সন্ত্রাসী বানানো। এসব ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে। বেশকিছু মুসলিম দেশে সন্ত্রাসী সংগঠন জন্মলাভ করেছে তাদের মদদে। তারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তবুও তারা বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে। তাতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা অতি নগণ্য হলেও দোষটা চাপানো হচ্ছে সমগ্র মুসলমানের ওপর। কিন্তু ইসলাম শান্তির ধর্ম। প্রকৃত মুসলমান সন্ত্রাস ঘৃণা করে এবং অন্য ধর্মের প্রতিও খুবই সহনশীল। তবুও বিধর্মীরা সমগ্র মুসলিম জাতিকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করছে। অথচ বিধর্মীদের মধ্যে বহু সন্ত্রাসী সংগঠন ও ব্যাপক সংখ্যক সন্ত্রাসী আছে এবং তারা ব্যাপক সন্ত্রাসীমূলক কর্ম করছে। তবুও তাদের ধর্মাবলম্বীদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে না। কারণ, তারা শক্তিশালী ও স্বধর্মীয়। আর মুসলমানরা দুর্বল বলে তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। কোন কোন দেশে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আবার কোথাও কোথাও দমন করার জন্য সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে! এছাড়া মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ-সংঘাত সৃষ্টিতেও সফল হয়েছে।
কয়েকটি মুসলিম দেশে সম্প্রদায়-টু-সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠি-টু-গোষ্ঠি তথা শিয়া-সুন্নি-কুর্দি ইত্যাদির মধ্যে চরম অনৈক্য-বিভেদ-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত। এসব সর্বাধিক সৃষ্টি হয়েছে ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায়। তাতে দেশগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এছাড়া, নারী শিশুসহ লাখ লাখ নিরহ-নিরস্ত্র মুসলমান এ পর্যন্ত নিহত আহত হয়েছে। কোটির অধিক মানুষ বিপদসংকুল সমুদ্র ও মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। এবং এখনো যাচ্ছে। সেখানে তারা চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে। এছাড়া, সেখানে যেতে হাজার হাজার মানুষ অকাল মৃত্যুর শিকার হয়েছে। উপরন্তু ওইসব দেশের অভ্যন্তরেও সমপরিমাণ মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এই বাস্তুচ্যূত মানুষের লাখ লাখ সন্তানের লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে! সর্বপরি শিয়া-সুন্নি দ্ব›দ্ব সৃষ্টির কারণে কয়েকটি দেশের মধ্যে ব্যাপক অনৈক্য ছাড়াও যুদ্ধংদেহীভাব সৃষ্টি হয়েছে। ইরান শিয়াপন্থীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে মনে করে দেশটিকে কোণঠাসা করে ফেলার জন্য কতিপয় দেশ উঠেপড়ে লেগেছে। ইরান সবকিছু মোকাবেলা করে শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করছে। সামরিক শক্তিতে বলিয়ান হওয়া ছাড়াও শক্তিশালী দেশ রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, তুরস্ক, পাকিস্তান ইত্যাদির সাথে দীর্ঘদিনের গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। এছাড়া, শিয়া অধ্যুষিত কয়েকটি দেশের সাথে গভীর সম্পর্ক তো রয়েছেই। এভাবে ইরান আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে একমাত্র ইরানেই ইসলামী রাজনীতি বিদ্যমান। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর হতে তা অব্যাহত আছে। এই বিপ্লব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইহুদী-খ্রিস্টান চক্র ইরানের বিপ্লবকে অংকুরেই ধ্বংস করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। আর সেটা কখনো নিজেরা বাস্তবায়ন করেছে, আবার কখনো কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার চেষ্টা করেছে। ইরানের উপর অবরোধ আরোপ করে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা করেছে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে অজুহাতে। তাতে তেল সমৃদ্ধ ইরানের অর্থনৈতিকভাবে যতটা বলিয়ান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ততটা হতে পারেনি। অবশ্য ২০১৫ সালে পরমাণু কর্মসূচি স্থগিত করার বিনিময়ে বৃহৎ ৬ জাতির সাথে চুক্তি করায় অবরোধ প্রত্যাহার হয়েছে। ফলে দেশটির উন্নতির দ্বার খুলে গেছে। বড় বড় দেশের সাথে বিপুল অর্থের চুক্তি করছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ফ্রান্সের টোটাল কোম্পানির সাথে তাদের গ্যাস উত্তোলনের চুক্তি। তাতে চীনও শামিল হয়েছে।
কাতার মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে মদদ দিচ্ছে অভিযোগ তুলে সৌদি আরব, মিসর, বাহরাইন, লিবিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, মালদ্বীপ, জর্দান, মৌরিতানিয়া ও মরিশাস দেশটির সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করেছে। তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সমর্থন জানায়। ফলে দেশটি চরম বেকায়দায় পড়ে যায়। পণ্যমূল্য ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। শিল্পকারখানার অনেকগুলো বন্ধ হয়ে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়। অবশ্য ২-৩ দিনের মধ্যেই কাতার সে ধকল সামলে উঠে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় মরক্কো, তুরস্ক, ইরান, ওমানসহ কয়েকটি দেশে। তারা বিপুল খাদ্য পাঠানো ছাড়াও বিমান বন্দর ব্যবহার করতে দেয়। যা অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। অপরদিকে, রাশিয়া, জার্মান, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশ আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসন করার আহ্বান জানায়। কুয়েত মধ্যস্থতার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কাতার তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাখান করে উল্টো সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তোলে। এই অবস্থায় সৌদি জোট (সৌদি আরব, মিশর, সংযুক্ত আরব আমীরাত ও বাহারাইন) কাতারের প্রতি ১৩ দফার শর্ত জারী করে কুয়েতের মাধ্যমে এবং তা কার্যকরের জন্য দশদিন সময় নির্ধারণ করে দেয়। উপরন্তু এই সময়ের মধ্যে শর্তগুলো বাস্তবায়ন করা না হলে দেশটির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করা হবে বলে জানানো হয়। এই অবস্থায় বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্রাংক গার্ডনার বিবিসি বাংলাকে বলেন, যদি আপসের কোন জায়গা না থাকে, তাহলে কাতারের সামনে দুটি পথ খোলা থাকবে। হয়, এসব দাবি মেনে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে উপসাগরীয় আরব জোটে ফিরে যাওয়া। অথবা সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইরানের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয়া।
যাহোক, কাতারের প্রতি সৌদি জোটের উক্ত আচরণে শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী বিস্মিত। কারণ, কাতার ছোট্ট একটি দেশ এবং পোনে এক কোটি লোক। তবে দেশটি খুবই ধনী কিন্তু সকলেই শান্তিপ্রিয়। অন্যদিকে, কাতারবাসীসহ সমগ্র মুসলিম স¤প্রদায় আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে অজানা আশংকায়। ফলে সংকট নিরসনে বৃহৎ দেশগুলো তৎপর হয়ে উঠে। রাশিয়ার, যুক্তরাষ্ট, জার্মান, ফ্রান্স যুক্তরাজ্য, চীন, তুরস্ক, পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কাতার ও সৌদি জোটের সাথে আলাপ করেন এবং আলোচনার মাধ্যমে সংকট দূর করার আহ্বান জানান।
মুসলিম দেশ ও মুসলমানদের মধ্যে চলছে চরম বিভেদ ও সংঘাত। অথচ পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানের অস্তিত্ব রক্ষা এবং বিধর্মীদের অপতৎপরতা মোকাবেলা করে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মাধ্যমে অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য মুসলমানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। কিন্তু তা না করে উল্টো নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ-সংঘাত সৃষ্টিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে ইসলামের শত্রুদের মদদে। এতে করে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দেশ ক্ষতি গ্রস্ত হওয়া ছাড়াও সমগ্র মুসলিম জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে। যার সুফল যাচ্ছে বিধর্মীদের ঘরে! কিন্তু না, এই অবস্থা আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। তাই অবিলম্বে মুসলিম দেশ ও জাতির মধ্যে সৃষ্ট বিভেদ-সংঘাত বন্ধ করা এবং মুসলামানদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলা আবশ্যক। এ কামনা শুধু আমাদের নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর। স্মরণীয় যে, মুসলমানদের অতীত ঐতিহ্যে ফিরে যেতে শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা অপরিহার্য। আর এসবের জন্য প্রয়োজন সার্বিক উন্নতি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button