ঐশী আজানে ছিল হজের আহ্বান
সৈয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন: আর মানবজাতির জন্য হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং ক্লান্ত উটের পিঠে সওয়ার হয়ে। তারা আসবে দূরদূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা-হজ, আয়াত-২৭)
আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.)কে এভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন হজের জন্য আজান দিতে। মানুষকে হজের জন্য আহ্বান করতে। কাবাঘর তৈরি শেষ হলে হজরত ইবরাহিম (আ.) আবু কুবাইস পাহাড়ের চূড়ায় উঠে হজের আজান দিলেন। সেই আজান শুনে হজ পালন করতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ কাবাঘরে উপস্থিত হন। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে, লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির), লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক (আমি উপস্থিত, কোনো শরিক নেই তোমার, আমি উপস্থিত), ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক (নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই আর সব সাম্রাজ্যও তোমার), লা-শারিকা লাক (তোমার কোনো শরিক নেই)।
আল্লাহর প্রেমে বান্দারা হজরত ইবরাহিমের (আ.)-এর আজানে সাড়া দিয়ে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আল্লাহর ঘরে হাজির হয়েছেন। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে এখনও প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ আরাফার প্রান্তরে হাজির হন। যদিও বান্দা হেঁটে কিংবা উটের পিঠে চড়ে আসছেন না- হয়তো পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তারা আল্লাহর এ নির্দেশ পালন করতে পারছেন না; কিন্তু তাদের অন্তরে এ অনুভূতি থাকবে তারা আল্লাহর আদেশ প্রতিপালন করছেন। তারা আবেগ ও প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহর এ বাণী হৃদয়ে উপলব্ধি করবেন।
পবিত্র হজ পালনের জন্য বান্দাকে শারীরিক, আর্থিক, মানসিক শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এত কিছু করেও কাক্সিক্ষত ফল অর্জিত না হলে এর চেয়ে দুঃখের কী হতে পারে। শুধু লোক দেখানো হজের কোনো মাহাত্ম্য নেই। হজের আরকান-আহকামগুলো সঠিকভাবে জানতে হবে। বাহ্যিক এসব ইবাদতের রুহানি শিক্ষাও রয়েছে। প্রতিটি আরকান-আহকামের অন্তরালে নিগূঢ় প্রেম ও ত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। তা আত্মোপলব্ধি করতে হবে। বিন্দুমাত্র লৌকিকতা, সামাজিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকলে হজ কবুল হবে না। খালেস নিয়তে আল্লাহর প্রেমে বিলীন হয়ে শুধু তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হজ করলে বান্দা নিষ্পাপ শিশুর মতো পবিত্র হয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসূল (সা.)কে বলতে শুনেছি, যে আল্লাহর জন্য হজ করে, তারপর অশ্লীল কথা না বলে এবং গুনাহের কাজ না করে সে প্রত্যাবর্তন করে সেদিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। তাই হাজীদের উচিত হজের সফরে অতি বিনয় ও একগ্রতার সঙ্গে হজের আহকামগুলো পালন করা। ছোট-বড় সব গুনাহের কাজ, অশ্লীল কথাবার্তা, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, নফসের কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত থাকা ও সব রিপু থেকে দূরে থাকা। স্বামী-স্ত্রী একত্রে হজে গেলে হজের সফরে তাদের অবশ্যই সংযমী হতে হবে।
অপরাধ ও গুনাহের কাজ থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টি শুধু হজকালীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং হাজী যতদিন বেঁচে থাকবেন হজের পরও তিনি তা ধরে রাখবেন। হাজীর এ ধরনের গুনাহ থেকে মুক্ত থাকাকে হজে মাবরুর বা মকবুল হজ বলে। যার বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।
আল্লাহর অলি হজরত হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন, দুনিয়ার প্রতি অনীহা প্রকাশ এবং আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে হজ পালন করার নাম হজে মাবরুর বা মকবুল হজ। এর জন্য প্রয়োজন সৎ ও বিশুদ্ধ নিয়ত, রিয়ামুক্ত ইবাদত, হারামমুক্ত অর্থ, শিরকমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে কৃত আমল। মকবুল হজ শুধু হজকালীনই অর্জিত হয় তা নয়, বরং হজের মুহূর্তে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকার যে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে তা জীবনে পালিত হচ্ছে কিনা এর ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়। হাজী যদি সারা জীবন হজকে ধরে রাখতে পারেন তা হলেই বোঝা যাবে তিনি তার হজকে মকবুল করতে পেরেছেন। কিন্তু হাজী হজের মুহূর্তে হাজী ছিলেন হজ করে দেশে ফেরার পর সুদ, ঘুষ, অন্যায়-অপরাধ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেননি এমন ব্যক্তির জন্য কখনও মাবরুর হজ নসিব হয় না। মোটকথা, মকবুল হজ লাভের উপায় হচ্ছে ইহরাম থেকে আমৃত্যু হজের নির্দেশ ও আমলকে ধরে রাখা। সগিরা ও কবিরা গুনাহ থেকে পবিত্র থাকা।
হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিবস ৯ জিলহজ বা ইয়াওমুল আরাফা। এ দিন সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে রওনা হয়ে আরাফার ময়দানে যেতে হয়। আরাফার ময়দানে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই অবস্থান করতে হবে এবং সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি মসজিদে নামিরা থেকে যে খুতবা দেবেন তা শুনতে হবে। খুতবা শেষ হলে জোহরের আজান হয়। একই আজানে ও দুই ইকামতে জোহর ও আসরের কসর দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হবে। এ দুই ওয়াক্ত নামাজের আগে ও পরে বেশি বেশি দরূদ, দোয়া ও জিকির করতে হয়। আরাফাতের ময়দানে থাকা অবস্থায় সূর্য অস্ত যাবে; কিন্তু সেখানে মাগরিবের আজান দেবে না এবং নামাজও পড়া যাবে না। মাগরিবের ওয়াক্ত বারেক হওয়ার পর ধীরস্থিরভাবে আরাফার ময়দান ত্যাগ করে মুজদালিফায় যেতে হবে। মুজদালিফায় পৌঁছে এক আজান ও দুই ইকামতে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করতে হবে। মুজদালিফায় অবস্থান করে রাতভর দোয়া এবং জিকিরে মশগুল থাকবে। রাত শেষে আজানের পর ফজরের নামাজ পড়ে ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বক্ষণে মুজদালিফা থেকে তালবিয়া পড়তে পড়তে মিনার উদ্দেশে রওনা করতে হবে। তারপর কঙ্কর কুড়াতে হবে। মিনার পথে জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। তারপর কোরবানি আদায় করতে হবে। সম্ভব হলে সামনে দাঁড়িয়ে কোরবানি করা দেখবে এবং অন্তরে উপলব্ধি করবে নিজের ভেতরের পশুবৃত্তি কোরবানি হয়ে গেল। এমনকি এও উপলব্ধি করবে, আল্লাহর প্রেমে নিজের জীবনও এভাবে কোরবানি করতে প্রস্তুত। এরপর মাথা মুুণ্ডন ও গোসল করে এহরাম ছেড়ে দেবে। অতঃপর কাবা শরিফ তাওয়াফ ও সায়ী করতে হবে। পাথর মারার উদ্দেশ্যে মিনাতে তিন দিন অবস্থান করতে হবে। যেসব নবীপ্রেমিক হজ করবেন তারা অবশ্যই হজের আগে বা পরে রাসূল (সা.) এর রওজা মোবারক জেয়ারত করবেন। রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমার কাছে না আসে, সে আমার প্রতি জুলুম করে।
পবিত্র হজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বহু আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে, যা শুধু দৈহিক পরিপালনের বিষয় নয়। আত্মিক উপলব্ধি ও প্রেমানুভূতি প্রকাশেরও উপলক্ষ। তাই হৃদয়পটে ভালোবাসার ঢেউ জাগিয়ে হজের প্রতিটি আহকাম, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কাজে আল্লাহর প্রেমের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ, গদিনশীন পীর সুরেশ্বর দায়রা শরিফ