বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ বন্যা কবলিত, ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধকোটি মানুষ
উজানে ভারি বৃষ্টির কারণে চলমান বন্যায় দেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে অর্ধকোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; এক সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ৭৭ জনের।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর শুক্রবার জানিয়েছে, চলতি মৌসুমের দ্বিতীয় দফার এ বন্যায় এ পর্যন্ত ছয় লাখ ১৮ হাজার ৭০৯ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিভিন্ন নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করায় দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও পদ্মায় পানি বাড়ায় অবনতি হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি জেলার পরিস্থিতির।
এরই মধ্যে অগাস্টের শেষভাগে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকায় তৃতীয় দফা বন্যার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেক্ষেত্রে দুই দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের কারণে দুর্ভোগ বহুগুণে বেড়ে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজনীন শামীমা জানান, শুক্রবার পর্যন্ত ২৭ জেলার ১৩৩ উপজেলা ও ৪৩টি পৌরসভা এ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
এসব এলাকায় প্রায় ১১ লাখ ৪১ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ ১৮ হাজার ৭০৬ জন বানভাসি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে তথ্য পাঠিয়েছেন মাঠ কর্মকর্তারা।
নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, রাঙামাটি, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজবাড়ী নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ এখন বন্যা কবলিত।
এর মধ্যে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নেত্রকোণা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, যশোর ও টাঙ্গাইলে তিন হাজার ১৯৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতি
>> ১৪ হাজার ৭৩৭টি ঘর সম্পূর্ণ এবং ২ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৬টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
>> কুড়িগ্রামে ১৮ জন, লালমনিরহাচে ৬ জন, সুনামগঞ্জে ২ জন, নেত্রকোণায় ২ জন, নীলফামারীতে ৫ জন, গাইবান্ধায় ৩ জন, সিরাজগঞ্জে ৪ জন, দিনাজপুরে ২৮ জন, জামালপুরে ৪ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ১ জন, নওগাঁয় ১ জন মিলিয়ে মোট ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে গত এক সপ্তাহে।
>> দুর্গত জেলাগুলোতে অন্তত ৪২ হাজার ৩১১টি টিউবওয়েল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ বলেন, “চলমান বন্যায় দেশের ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিস্তার ও স্থায়ীত্বে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের দুটি বড় বন্যার মতো ভয়াবহ না হলেও এবারের বন্যায় মৃতের সংখ্যা ওই দুই বছরের হিসাব ছাড়িয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, এবার আকস্মিক বন্যায় বাঁধ ভেঙে গেছে অনেক এলাকায়। দিনাজপুরসহ কয়েকটি নতুন এলাকায় হঠাৎ করে বড় বন্যা হয়েছে। সাপে কাটাসহ নানা কারণে এবার প্রাণহানি বেড়েছে।
দেশে বড় বন্যাগুলোর মধ্যে ১৯৯৮ সালে প্রায় ৬৮ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। আর ১৯৮৮ সালে বন্যা কবলিত হয়েছিল প্রায় ৬৪ শতাংশ এলাকা। সে সময় অনেক এলাকায় বন্যা দুই মাসের বেশি সময় স্থায়ী হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ পায়।
এবার অর্ধকোটির বেশি মানুষ বন্যা দুর্গত হলেও আগের দুটি প্রলয়ঙ্কারী বন্যায় এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলে রিয়াজ আহমেদ জানান।
অধিদপ্তরের পরিচালক আবু সৈয়দ মোহাম্মদ হাশিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই দুই বছরের পরিস্থিতি ও সক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করলে এখন আমরা অনেক এগিয়ে রয়েছি। বন্যার বিস্তার ও স্থায়ীত্ব তুলনামূলকভাবে কম। চলমান বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
পানি কমা শুরু করায় ইতোমধ্যে উত্তরের জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ভারি বৃষ্টি না হলে মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলের অবনতিশীল পরিস্থিতিরও শিগগিরই উন্নতি হতে পারে।”
শুক্রবার দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ জানান, দুর্গতদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে নগদ সাত কোটি টাকা এবং সাড়ে ১৯ হাজার মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুদ রাখা হয়েছে।
এর মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত ২৭ জেলার বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ৫ কোটি ৯৮ লাখ ৮১ হাজার ৯৫০ টাকা নগদ, ১৬ হাজার ৪ মেট্রিক টন চাল এবং ৩৬ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য।
উজানের পরিস্থিতি
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, গঙ্গা- ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা এই তিন অববাহিকার মধ্যে গঙ্গায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্রের উজানের ভারতীয় অংশে এবং মেঘনা অববাহিকার ভারতীয় ও বাংলাদেশ অংশে পানি কমছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর ভারতীয় অংশের গোহাটিতে (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮০ কিলোমিটার উজানে) ৩৩ সেন্টিমিটার, পাণ্ডুতে (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৬০ কিলোমিটার উজানে) ২২ সেন্টিমিটার, গোয়ালপাড়ায় (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৯০ কিলোমিটার উজানে) ২৭ সেন্টিমিটার এবং ধুবরী (বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ২৫ কিলোমিটার উজানে) ১৮ সেন্টিমিটার পানি কমেছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি সমতল নুনখাওয়া, চিলমারী, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি এবং সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে কমছে।
পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ভারতীয় অংশে আগামী ২৪-৩৬ ঘণ্টায় গড়ে ২১ সেন্টিমিটার পানি কমতে পারে।
বাংলাদেশ অংশের ব্রহ্মপুত্র-যমুনার বিভিন্ন পয়েন্টে আগামী ৭২ ঘণ্টায় পানি কমা অব্যাহত থাকলেও গঙ্গা-পদ্মার পানি আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বাড়বে।
মেঘনা অববাহিকার নদীর পানি আগামী ৪৮ ঘন্টায় কমতে থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
তৃতীয় দফা বন্যার শঙ্কা
এ বছর জুলাই মাসের দ্বিতীয়ার্ধে মৌসুমের প্রথম বন্যায় অন্তত ১৩ জেলার অনেক উপজেলা প্লাবিত হয়। অগাস্টে চলমান বন্যায় ২৭ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়েছে।
এর মধ্যে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে ফের বন্যার আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, বহ্মপুত্র-যমুনা ও মেঘনায় পানি কমতে থাকায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
পদ্মার পানি বাড়ায় মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরের বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে। তবে ৪-৫ দিনের মধ্যে অধিকাংশ এলাকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির পূর্বাভাস রয়েছে।
“কিন্তু অগাস্টের ২৪-২৫ তারিখ থেকে উজানে ফের বৃষ্টি বাড়তে পারে। দেশেও বৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে ঈদের আগে থেকে বা সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকে আবার বন্যা দেখা দিতে পারে। তাতে দুর্ভোগ বাড়তে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা।” -বিডিনিউজ