বিজ্ঞান ও মাজহাব মানুষের জন্য রহমত
আলহাজ্ব মাওলানা এরফান শাহ্: তথ্য-প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে মানব জীবন এখন কল্পণাও করা যায় না। বিজ্ঞানের আর্শিবাদে মানবজীবন ধন্য। মানুষ প্রতিটি মুহুর্ত বিজ্ঞানের ছায়ায় অতিবাহিত করছে। বিজ্ঞান থেকে উপকৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করছে। বিজ্ঞানের নিত্য নতুন গবেষণা ও আবিস্কার মানুষের জীবন-মান সুন্দর, উন্নত ও সহজ করেছে। যে জাতি বিজ্ঞানকে যতবেশি গ্রহণ করেছে সেই জাতি ততবেশি এগিয়ে রয়েছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ও অগ্রযাত্রায় “বিজ্ঞান আর্শিবাদ নাকি অভিশাপ” অতীতের সেই বিতর্ক এখন সেকেলে হয়েগেছে। তেমন আর শুনা যায় না। তবে এজন্য বিজ্ঞান নয় বরং তথ্য-প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকরাই দায়ী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মহাসড়কে সবাই এখন ঐক্যবদ্ধ এক কাতারে শামিল। এক কথায় বিজ্ঞান ছাড়া মানবজীবন পঙ্গু ও অচল।
বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিস্কার, তথ্য-প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা, গবেষণা ও অবদান যেমন অনস্বীকার্য, অনুরূপভাবে ইসলামী শরীয়ায় ফিকহ তথা মাসআলা-মাসায়েলে মাজহাবের সম্মানিত মুজতাহিদ ইমাম, ফকিহ ও অভিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের প্রচেষ্টা, গবেষণা ও অবদান অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানীরা তাদের ত্যাগ, গবেষণা ও আবিস্কারের মাধ্যমে দৈনিন্দন চলার পথ উন্নত ও সহজ করেছেন। অনুরূপভাবে মাজহাবের সম্মানিত ইমাম ও ফকিহগণ উনাদের ইজতিহাদ, র্নিঘুম রাত ও গবেষণার মাধ্যমে মাসআলা-মাসায়েল তথা ফিকহশাস্ত্র আবিস্কারের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদীকে দ্বীনের উপর চলা সহজ করেছেন। অতএব বিজ্ঞান যেমন মানব জীবনে চলার পথের পাথেয় অনুরূপভাবে ফিকহ তথা মাজহাবও দ্বীনের পথের পাথেয়। তথ্য-প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান ছাড়া যেমন দৈনিন্দন জীবন অচল অনুরূপভাবে মাসআলা-মাসায়েল ফিকহ তথা মাজহাব ছাড়াও দ্বীন হতে পারে না সচল।
ভাবতে অবাক লাগে বাড়ী করার জন্য প্রকৌশলীর শরণাপন্ন হতে হয়। চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। আইনের জন্য আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বিশ^নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দ্বীন কি এতই সস্তা? এতই গুরুত্বহীন ও মূল্যহীন হয়ে গেছে? ব্যাখা, পরামর্শ, দিকনির্দেশনা, জানা ও বুঝার জন্য কোনো ইমাম তথা মাজহাবের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই? ওংষধস রং ঃযব পড়সঢ়ষবঃব পড়ফব ড়ভ ষরভব. মহাগ্রন্থ আল-কুরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক মহাসাগর। আর রাসূল (সাঃ) এর লক্ষ লক্ষ হাদিস মহা সাগরের পানি। পানিতে পরিপূর্ণ এই মহাসাগর একা একা পাড়ি দেয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। এই মহাসাগর পাড়িতে দিতে হলে ইসলামী শরীয়া, ফিকহ্, মাধ্যম তথা জাহাজের সাহায্য নিতে হবে। আর এই ইলমের মহাসাগর পাড়ি দেয়া জাহাজের নাম হচ্ছে ফিকহ তথা মাজহাব। অতএব এ পৃথিবী দ্রæত ও সহজে পাড়ি দেয়ার জন্য বিজ্ঞানের সূত্র গুলো গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন জাহাজ, গাড়ী ও বিমান। আর ইসলামী শরীয়ার ইলমের মহাসাগর দ্রæত ও সহজে পাড়ি দেয়ার জন্য মুজতাহিদ ইমামগণ ইসলামী শরীয়ার দলিল কুরআন-হাদিস ও ইজমা-কিয়াসের সূত্রগুলো গবেষণা করে আবিস্কার করেছেন মাসআলা-মাসায়েল, ফিকহ্ ও মাজহাব।
মাজহাব শব্দের অর্থ চলার পথ, রাস্তা তথা মাধ্যম। ইসলামি পরিভাষায় কুরআন-সুন্নাহ প্রদর্শিত রাসূল (সাঃ), সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) খোলাফায়ে রাশেদীন, সিদ্দিকীন ও সালফে সালেহীনদের মনোনীত পথের নামই হলো মাজহাব। অন্য অর্থে এটিই হলো সিরাতে মুস্তাকিম তথা সহজ, সরল ও সঠিক পথ। সুতরাং মাজহাব কোন নতুন আবিস্কার, মতাদর্শ, মতবাদ বা কুরআন-সুন্নাহ বর্হিভূত ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব কোন মত ও পথের নাম নয় বরং মাজহাব হলো পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-কিয়াসের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধর্মীয় সমস্যার প্রদত্ত সমাধান। যা এ বিষয়ে পরিপক্ষ, অভিজ্ঞ ও মুজতাহিদ ইমাম ও ফকিহগণ প্রদান করেছেন।
যেহেতু কোনো ইমাম কুরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো মত দেননি, সেহেতু বর্তমান চার মাজহাবই ইসলামের মূলভিত্তি কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-কিয়াসের আলোকে প্রণীত। মাজহাবের ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) এর ইশারা, ইংগিত ও সমর্থণ আছে যা মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) এর হাদিস থেকে প্রমাণিত। তিরমিজি ও আবুদাউদ শরীফে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামনের গর্ভণর করে পাঠানোর প্রাক্কালে জিজ্ঞাসা করলেন কিভাবে তুমি উপস্থিত সমস্যার সমাধান করবে? হযরত মুয়ায (রাঃ) আরজ করলেন কুরআনের আলোকে ফায়সালা করবো। নবীজী প্রশ্ন করলেন কুরআনে কোনো সমাধান খুজেঁ না পেলে? তাহলে হাদিসের আলোকে সমাধান করবো। হাদিসেও কোনো সমাধান খুজেঁ না পেলে? মুয়ায বললেন তখন আমি ইজতিহাদ করবো এবং সত্যের সন্ধান পেতে কোনো ত্রæটি করবো না। নবীজী তখন তার প্রিয় সাহাবীর বুকে পবিত্র হাত মোবারক দ্বারা মৃদু আঘাত করে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহপাক তার রাসূলের দূতকে রাসূলের সন্তুষ্টি মোতাবেক কথা বলার তাওফিক দিয়েছেন।
হযরত হুযায়ফা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, জানি না আর কত দিন তোমাদের মাঝে থাকবো, তবে আমার পরে তোমরা আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ) এ দু’জনের ইত্তেবা তথা অনুসরণ করে যাবে-তিরমিজি ও ইবনে মাজা। সাহাবী ও তাবেয়ীনদের যুগে ফিকহ্ লিপিবদ্ধ না হলেও অঘোষিত ভাবে মাজহাবের প্রচলন ছিল। তারা মুজতাহিদ সাহাবায়ে কেরামের তাকলিদ তথা অনুসরণ ও অনুকরণ করতেন-আহসানুল ফতওয়া-১/৪১৫। অতএব মাজহাব মানা মানে রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ তথা আদর্শকে অনুসরণ করা। যারা সহিহ হাদিসের দোহাই দিয়ে মাজহাবের বিরোধীতা করেন, তারাও কিন্তু প্রতিটি কাজ কুরআন-হাদিস খুলে তারপর আমল করেন না। যা কোনো ভাবে সম্ভবও নয়। উনাদের নিকট গ্রহণযোগ্য শাইখ ও ইমামের অনুসরণ ও অনুকরণ করেন এবং রেফারেন্স দেন। আর এটির নাম হল মাজহাব। যা নিজের অজান্তে তথাকথিত লা মাজহাবী ও আহলে হাদিস দাবীদার ভাইয়েরাও অনুসরণ ও অনুকরণ করেন। আর জেনে রাখা দরকার সহিহ হাদিস শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিম শরীফে সীমাবদ্ধ নয়। বুখারী ও মুসলিম ছাড়াও সহীহ হাদীসের বড় বড় অনেক কিতাব রয়েছে। মাত্র কয়েক হাজার হাদিস বুখারী ও মুসলিমে আছে এর বাইরেও হাজার হাজার সহিহ হাদিস রয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ জাবিয়া নামক স্থানে হযরত ওমর (রাঃ) খুতবা দিতে গিয়ে বলেন, হে লোক সকল! কুরআন সম্পর্কে তোমাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) এর কাছে, ফারায়েজ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে যায়েদ ইবনে সাবেত (রাঃ) এর কাছে, আর ফিকহ সংক্রান্ত কিছু জানার থাকলে মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) এর কাছে, তবে অর্থ সংক্রান্ত কিছু জানার থাকলে আমার কাছে আসবে। দেখুন ওমর (রাঃ) নির্দেশ দিচ্ছেন সাহাবা আজমায়িনদের অন্য সাহাবায়ে কেরামের তাকলিদ তথা অনুসরণ-অনুকরণ করার জন্য। কেননা যেসব সাহাবা মুজতাহিদ ছিলেন না তারা মুজতাহিদ সাহাবাগণকে অনুসরণ ও অনুকরণ তথা তাকলিদ করতেন। রাসূল (সাঃ) ইবনে মাসুদ (রাঃ) এর ব্যাপারে বলেন, আমি তোমাদের জন্য তাই পছন্দ করি, ইবনে মাসুদ যা পছন্দ করে- মুসতাদরাক-৩/৩১৯ হাঃ ৫৩৯৪। হাদিসে ইবনে মাসুদের পছন্দই রাসূলের পছন্দ বলে মত ব্যক্ত করা প্রমাণ বহন করে উনার কথা অনুযায়ী অন্যরা আমল করলে তা রাসূল (সাঃ) এর নিকট গৃহীত হবে। এর মাধ্যমে তাকলিদে শাখসি তথা ব্যক্তি পর্যায়ে তাকলিদ প্রমাণিত হলো।
উল্লেখ্য হানাফি মাজহাবের মাসআলা-মাসায়েল তথা ফিকহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদের বর্ণনা, রায়, মতামত ও আমলের ভিত্তিতে রচিত ও প্রণীত। সরকারের প্রতিনিধি, কথা ও আইন মানা মানে সরকারকে মানা। এই দৃষ্ঠিকোণ থেকে বলা যায় ইমাম আবু হানিফা (রঃ) কে অনুসরণ ও অনুকরণ করা মানে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ(রাঃ) কে অনুসরণ করা। আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদকে অনুসরণ করা মানে স্বয়ং মুহাম্মদুর রসূল (সাঃ) কে অনুসরণ করা। অতএব আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) কে কেউ যদি অনুসরণ করতে চান, তবে কুরআন-হাদিস পড়ে নিজের মনমত ব্যাখা দাড় করালে চলবে না। এটি সুন্নাত পদ্ধতিও নয়। বরং সুন্নাত হলো সাহাবায়েকেরাম, তাবেয়ীন-তবেতাবেয়ীন, মুজতাহিদ ইমাম, ফকিহ ও অভিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের অনুসরণ ও অনুকরণ করা। যা কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কুরআনে ‘উলূল আমর’ দ্বারা মুজতাহিদ ইমাম ও ফোকাহায়ে কেরামের কথা বলা হয়েছে। সরকারের প্রতিনিধি ও মাজহাব মানাকে অতিরঞ্জিত করে প্রতিনিধি ও ইমামের মাঝে ছায়া সরকার ও ছায়া ধর্ম কল্পণা করা মানসিক বিদ্বেষপ্রসূত, বিভ্রান্তিমূলক ও বাড়াবাড়ি।
দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান। রাসূল (সাঃ) ও মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) প্রশ্নোত্তর, রাসূলের সন্তুষ্টি, সম্মতি ও অনুমোদন দলিল ও প্রমাণ বহন করে ইজতিহাদ তথা গবেষণা ইসলামে জায়েজ তথা বৈধ। যা রাসূল (সাঃ) থেকে অনুমোদিত, উৎপত্তি ও সৃষ্টি এবং যা রাসূল (সাঃ) এর যুগেও বিদ্যমান ছিল। যারা মাজহাবের বিরোধীতা করেন উনারা মুয়ায বিন জাবাল (রাঃ) এর হাদিসটি ভাল করে স্টাডি ও গবেষণা করা উচিত। ইজতিহাদ তথা ইজমা ও কিয়াস যদি না মানা হয় তাহলে মানব জীবনে সৃষ্ট নতুন নতুন সমস্যা গুলোর সমাধান কিভাবে হবে? ফতোয়া কিভাবে দিবে? কিভাবে দিকর্নিদেশনা দিবে? বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কার ও ব্যবহার হালাল নাকি হারাম? জায়েজ নাকি নাজায়েজ? বৈধ নাকি অবৈধ তা কিভাবে নির্ধারণ করবেন? অতএব রাসূল (সাঃ) এর সম্মতি ও অনুমোদিত ইজমা ও কিয়াসকে বাদ দিলে বা অস্বীকার করলে দ্বীনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে। যা হবে কুরআনের সাথে সাংর্ঘষিক।