শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় কবি নজরুলকে স্মরণ
বিদ্রোহ, প্রেম, মানবতা ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে সমগ্র জাতি। রোববার সকালে কবির ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ফুলে ফুলে ভরে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদসংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধি। শ্রদ্ধা নিবেদনের শুরুতেই কবির রূহের মাগফিরাত কামনা করে সমাধি প্রাঙ্গণে প্রার্থনা করা হয়।
সকাল ৮টায় কবি পরিবারের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান কবির নাতনী খিলখিল কাজী, তার ভাই বাবুল কাজীর স্ত্রী লুনা কাজী, তার মেয়ে আবাছা কাজী। পরে তারা কবির রূহের মাগফিরাত কামনায় মোনাজাত করেন। পরে ঢাবি ভিসির নেতৃত্বে ঢাবি শিক্ষকবৃন্দ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের নেতৃত্বে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষে এবং ব্যক্তিগতভাবে কবির অনুরাগীরা পুষ্পস্তবক অর্পন করেন।
আওয়ামী লীগের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের অন্যান্যরা। বিএনপির পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের অন্যান্যরা। শ্রদ্ধা নিবদেনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির সভাপতিত্বে এক সংক্ষিপ্ত সভায় কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়।
ফুলেল শ্রদ্ধার পর খিলখিল কাজী সাংবাদিকদের বলেন, আমরা নজরুলকে সবার কাছে পৌছে দিতে পারিনি। এর জন্য আমরাই দায়ী। কেননা আমরা নজরুলকে নিয়ে তেমন কোন চর্চা করি না। তিনি বলেন, নজরুল ছিলেন সবার কবি। গ্রাম থেকে শহরে সব প্রতিষ্ঠানে নজরুলকে পড়াতে হবে, তাঁর জীবন দর্শন জানাতে হবে।
খিলখিল কাজী বলেন, কবির জীবন আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। হিন্দু-মুসলমান আমাদের পরিচয় নয়, আমরা সকলেই মানুষ। এটাই ছিল তার আদর্শ। এই আদর্শ যদি আমরা সকলের কাছে পৌছে দিতে পারি তবেই আমরা শোষণমুক্ত হব এবং সুখী সমৃদ্ধ একটা সমাজ গঠন করতে পারবো।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ফেরদৌস আরা বলেন, নজরুলের গানের র্চচার পাশাপাশি তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে।
কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা সভায় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজী নজরুলের সাহিত্যকর্ম ই-বুকে পরিণত করতে হবে। এটা একটা বড় কাজ সেই সঙ্গে সমস্ত গানের আদি রেকর্ড ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে নজরুল রচনাবলী বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। একুশ শতকে শুধু আমাদের নজরুলকে মাতৃভাষায় বন্দি রাখলে চলবে না, নজরুলকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে হবে।
কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করে। সকালে কবির সমাধি প্রাঙ্গণে ঢাবি ভিসির সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী। বাংলা একাডেমিও নানা কর্মসূচির মাধ্যমে জাতীয় কবির ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে।
বিকাল চারটায় বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান স্বাগত বক্তৃতা দেন। অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর নজরুল বিষয়ে একক বক্তৃতা প্রদান করেন। সন্ধ্যায় নজরুলসঙ্গীতের পরিবেশনা করা হয়। এতে দেশের খ্যাতিমান শিল্পীগণ সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নজরুল ইনস্টিটিউট ‘নজরুল পদক’ প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠান হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ছায়ানট এ উপলক্ষে গত শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় ছায়ানট মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ,ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্রময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। প্রেম, দ্রোহ, সাম্যবাদ ও জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।