জ্বলছে রাখাইন, কাঁদছে মানবতা
রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন আরও বেড়েছে। দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। গুলি চালাচ্ছে নির্বিচারে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের গ্রামের পর গ্রামে বোমা ছুড়ে তছনছ করছে। নারী ও কন্যাশিশুদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এমন অত্যাচারের মুখে নারী-পুরুষ-শিশু স্থল ও নৌপথ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবির কড়া সতর্কতায় তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে সীমান্তের ওপারে নোম্যান্সল্যান্ডে ও বন-বাদাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা না পারছেন স্বদেশে ফিরতে, না পারছেন বাংলাদেশে ঢুকতে। বাধ্য হয়ে নোম্যান্সল্যান্ডেই কাঁদছেন।
মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযানে গুলিবিদ্ধ আরও তিন রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে প্রবেশের পর চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। গৃহহারা সহায়-সম্বলহীন এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের পাশাপাশি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ছয়টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়েও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাখাইনে একসঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ওই রাতের পর থেকে এ পর্যন্ত ৯৮ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছাড়া বাকিদের সবাই রোহিঙ্গা মুসলিম।
আরও সহিংসতার আশঙ্কায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদী ও স্থলসীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ অংশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের গুলি করার ঘটনাও ঘটেছে।
শনিবার ভোরে মিয়ানমার থেকে আসা গুলিবিদ্ধ ৪ রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে মুছা নামে একজন শনিবার সকালেই মারা যান। এর পর শনিবার গভীর রাতে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কুতুপালং থেকে আরও তিন রোহিঙ্গাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যালে নেওয়া হয়।
ওদিকে কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় গতকাল আরও ৯২ জনকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনের পর বলেছেন, ‘আমাদের সীমান্তে কোনো সন্ত্রাসীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’
তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারের বাহিনী সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করলে বিজিবি তার সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুত। টেকনাফ থেকে আব্দুল্লাহ মনির জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার কারণে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী রোহিঙ্গাদের ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সীমান্তে সতর্ক অবস্থানের পাশাপাশি স্থল ও নৌপথে টহল বাড়িয়েছে। এ ছাড়া অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা যেন লোকালয়ে ঢুকতে না পারে, সে জন্য পুলিশকেও সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।
এদিকে মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে সহিংস ঘটনার পর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্যবাহী কোনো ট্রলার আসেনি। তা ছাড়া শাহপরীর দ্বীপ করিডরে পশু আমদানিও কমে এসেছে। টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা এএসএম মোশারফ হোসেন জানান, মিয়ানমারে সহিংস ঘটনার আগে পণ্যবোঝাই যেসব ট্রলারের বন্দরে আগমন ঘটেছে, তা ফিরতে না পেরে বন্দরের জেটিতে নোঙর করে আছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলির মুখে আহত রোহিঙ্গারা চিকিৎসা নিতে ছুটে আসছেন বাংলাদেশে। গত ৩ দিনে অনেক গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এ দেশে এসেছেন বলে সীমান্তের বিভিন্ন বাসিন্দা জানান। সব রোহিঙ্গা উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। বর্তমানে নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়া সীমান্তে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা পাড়ি দিতে সীমান্তে অপেক্ষা করছেন।
এদিকে রবিবার ভোরে টেকনাফ নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ ও দমদমিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে ২০ রোহিঙ্গাকে আটক করে মানবিক সাহায্য দিয়ে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয় বলে জানায় বিজিবি। এসব রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ ও অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
শাহপরীর দ্বীপে আটক আহত রোহিঙ্গারা হলেন মিয়ানমার মংডুর মেরুল্লা এলাকার আব্দুস সালামের ছেলে আব্দুর রহমান, একই এলাকার কবির আহমদের ছেলে জাহেদ হোসেন, জাহেদ হোসেন মেয়ে আছিয়া বেগম, হাচ্ছুরতার সলিম উল্লাহর ছেলে রিজুয়ান, আবুল কালামের ছেলে মফিজুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে সলিম ও আব্দুল হকের ছেলে হাসিবুর রহমান।
গুলিবিদ্ধ জাহেদ হোসেন জানান, মিয়ানমার সরকারি বাহিনী অতর্কিত গুলি ও বোমা মেরে এলাকা তছনছ করে দিচ্ছে। একের পর এক গ্রাম ধ্বংস করছে। বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে তারা দেশ ছাড়ছেন।
রোহিনা আক্তার নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘আমার স্বামীকে শনিবার সকালে বিনাকারণে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি দল। আমার স্বামী আনোয়ার সেলিম নিরপরাধ। কিন্তু তিনি উগ্রপন্থি দল ‘আলকিন’-এর সদস্য বলে অভিযোগ করে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার চোখের সামনে ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করে। এ কারণে আমি বাংলাদেশে পালিয়ে এসে সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছি।’
২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা আহত রোহিঙ্গাদের বিজিবি হেফাজতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অবস্থার উন্নতি হলে তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরও জানান, সীমান্ত দিয়ে কোনো রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সীমান্তজুড়ে বিজিবি কঠোর অবস্থান থাকায় রোহিঙ্গারা সহজে ঢুকতে পারছেন না। গত কয়েক দিনে প্রায় দুইশত রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ বিশাল সীমান্ত এলাকা শতভাগ পাহারা দেওয়া বিজিবির একার পক্ষে সম্ভব নয়।
জেলা সহকারী পুলিশ সুপার (উখিয়া-টেকনাফ) সার্কেল চাই লাউ প্রু মারমা জানান, গত শনিবার উখিয়া থানা পুলিশের টিম কুতুপালং এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনুপ্রবেশকারী ৭১ রোহিঙ্গাকে আটক করে। পরে তাদের মানবিক সাহায্য দিয়ে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য উখিয়া বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। একই দিন ভোরে টেকনাফ থানা পুলিশের হোয়াইক্যং এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৭ রোহিঙ্গাকে আটক করে। পরে তাদের মানবিক সাহায্য দিয়ে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য টেকনাফ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এদিকে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এ বিশাল সীমান্তের কোনো না কোনো পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছেন রোহিঙ্গা। তারা সীমান্তরক্ষীদের পাহারার মাঝেও ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ছেন। এসব রোহিঙ্গা ঢুকলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গারা টেকনাফ-উখিয়ার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ক্যাম্প এবং লোকালয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
টেকনাফ লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন জানান, শুক্রবার থেকে মিয়ানমারে সহিংস ঘটনা শুরু হয়ে তা দিন দিন বেড়ে চলছে। সে দেশের সেনাবাহিনীসহ প্রশাসন মুসলমানদের ওপর চালাচ্ছে ব্যাপক নির্যাতন। এ ঘটনার পর থেকে নতুন কোনো রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তবে ক্যাম্পে নতুন রোহিঙ্গা ঢুকলে বিষয়টি ইউএনওসহ স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
ঘুমধুম সীমান্ত থেকে পলাশ বড়–য়া জানান, ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলি, ঘুমধুম লাল ব্রিজ, তুমব্রু সীমান্ত পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা কাঁটাতারের ওপারে আহাজারি করছেন।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের সহিংতায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার সন্নিকটে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে বিরতিহীন গুলি চালিয়েছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি। বিজিপির গুলিতে ঢেকিবনিয়া এলাকার মাওলানা এরশাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এ ছাড়াও ফকিরাবাজার এলাকার আব্দুর রহিম (৭০) নামের এক বৃদ্ধ মারা যান বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গারা।
এদিকে বিজিবির কড়া পাহারায় জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর ও বয়োবৃদ্ধরা।
৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মনঞ্জুরুল হাসান খান জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায় শনিবার দুপুরে। এতে সীমান্তে অবস্থানকারী স্থানীয়রাও আতঙ্কে পালিয়ে যাচ্ছেন অন্যত্র। তার পরও বিজিবির রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে বাধা দিয়ে আসছে।
ঘুমধুম বিজিবির নায়েক সুবেদার জাকির বলেন, সীমান্তের জলপাইতলি এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ৫ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটকানো হয়েছে। তাদের সুযোগ বুঝে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে। ওপারে গুলিবর্ষণ করছে, এপারে বিজিবিও কঠোর নজরদারিতে রেখেছে। তবুও প্রাণ রক্ষায় রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশকালে বাধা দিলে নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন অনেকে।
বয়োবৃদ্ধ আনু মিয়া (৮৫) অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, বিজিপির গুলিতে তাদের এলাকার হাবিবুল্লাহর ছেলে মাওলানা এরশাদ মারা গেছেন। একই এলাকার জয়নাল আবেদীন (৩৩) বলেন, শনিবার দুপুরে অতর্কিত অবস্থায় প্রচ- গুলির শব্দ পেয়ে তিনি স্ত্রী-সন্তানসহ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন।
অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা মো. আলম জানান, তাদের গ্রামের আব্দুর রহিম নামের এক যুবক বিজিপির গুলিতে গুরুতর আহত হলে তার আত্মীয়স্বজন বাংলাদেশে নিয়ে আসার সময় ওয়ালিদং পাহাড়ের চিককুম এলাকায় পৌঁছলে সে মারা যায়। তার মৃতদেহ এখনো সেখানেই আছে বলে জানান। -আমাদের সময়