অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়
সাড়ে এগার বছর আগে ফতুল্লা টেস্টে ম্যাথু হেইডেন এবং রিকি পন্টিং বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিলেন। প্রায় এক যুগ পর ফিরে আসে সেই টেস্টেই দুঃসহ স্মৃতি। এবার হেইডেন-পন্টিংয়ের ভূমিকা নেন ডেভিড ওয়ার্নার ও স্টিভেন স্মিথ।
২৬৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে অস্ট্রেলিয়া ২৮ রানে ২ উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে গেলে জয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে গোটা বাংলাদেশ। কিন্তু এই সময়ই ১৩০ রানের দুর্দান্ত জুটি গড়ে টাইগারদের স্বপ্নে হানা দেন ওয়ার্নার-স্মিথ। ক্রমেই ফিকে হচ্ছিল বাংলাদেশের স্বপ্ন। তবে কি ফতুল্লার মতো আরেকটি শোকগাথা হয়ে থাকবে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে? না; কোনো শোকগাথা নয়; বাংলাদেশ লিখল বীরত্বগাথা।
২০০৬ সালে শত চেষ্টা করেও পারেননি মোহাম্মদ রফিকরা। এবার পারলেন সাকিব আল হাসান ও তাইজুল ইসলামরা। মিরপুর টেস্টে চরম নাটকীয়তা শেষে অস্ট্রেলিয়াকে ২০ রানে হারিয়ে ফতুল্লা টেস্টেরই যেন বদলা নিল বাংলাদেশ। না, প্রতিশোধ নয়; টেস্ট ক্রিকেট নতুন উপাখ্যান লিখল লাল সবুজের প্রতিনিধিরা।
সিরিজ শুরুর আগেই সাকিব বলেছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে দুই টেস্টেই হারাতে চান। সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে স্মিথের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কূটনৈতিক উত্তরে তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ১০০ টেস্টের মধ্যে ৯টিতে জয় পাওয়া দলের জন্য এটা একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী উক্তি! স্মিথের এই কথা শুনে কি সাকিব মাঠেই জবাব দেয়ার পণ করেছিলেন? অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশ দুই টেস্টেই হারাতে পারে- এমন বিশ্বাস নিয়ে শুধু অটলই থাকেননি সাকিব; বলতে গেলে একক নৈপুণ্যে দলকে জেতালেন এই টাইগার অলরাউন্ডার।
প্রথম ইনিংসে ২৬০ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে ২১৭ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া। ৪৩ রানের লিড নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমে ২২১ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ফলে অজিদের সামনে ২৬৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায়। একসময় ২ উইকেটে ১৫৮ রান করে ফেলার পরও সফরকারীদের জিততে দেয়নি বাংলাদেশ। সাকিব-তাইজুলের দুর্দান্ত বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ২৪৪ রানে গুটিয়ে দিয়ে দুর্দান্ত জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে।
বুধবার টেস্টের চতুর্থ দিন ২ উইকেটে ১০৯ রান নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামে অস্ট্রেলিয়া। ওয়ার্নার ৭৫ এবং স্মিথ ২৫ রান নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামেন। শুরু থেকেই দুজনই খেলতে থাকেন আস্থার সঙ্গে। তাইজুল ইসলামের করা ৩৯তম ওভারের প্রথম বলে কভারে ঠেলে দিয়ে দুই রান নিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন ওয়ার্নার। এশিয়ার মাটিতে এটি অস্ট্রেলিয়ান ওপেনারের দ্বিতীয় এবং উপমহাদেশের মাটিতে প্রথম সেঞ্চুরি। সবমিলিয়ে ক্যারিয়ারের ১৯তম সেঞ্চুরি।
সেঞ্চুরি পর আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন ওয়ার্নার। তবে সাকিবের করা ৪২তম ওভারের পঞ্চম বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফিরতে হয় তাকে। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে রিভিউ নিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি ওয়ার্নারের। তবে আউট হওয়ার আগে ঠিকই বাংলাদেশের কাছ থেকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেন এই অজি ওপেনার।
ওয়ার্নারের আউটের পর ক্রিজে আসেন হ্যান্ডসকম্ব। তাকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন স্মিথ। তবে সাকিবের করা ৪৬তম ওভারের পঞ্চম বলে মুশফিকের দুর্দান্ত ক্যাচের শিকার হয়ে স্মিথ ফিরে গেলে বাংলাদেশের জয়ের ম্রিয়মান স্বপ্ন আলোর মুখ দেখতে শুরু করে।
দলীয় ১৮৭ রানের মাথায় হ্যান্ডসকম্ব আউট হয়ে ফিরে গেলে বাংলাদেশ আরো উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।দলীয় ১৮৭ রানের মাথায় তাইজুলের বলে কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ তুলে দেন হ্যান্ডসকম্ব। মুশফিকের গ্লাভসে লেগে বল স্লিপে সৌম্য সরকারের কাছে যায়। প্রথম চেষ্টায় ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় চেষ্টায় ঠিকই ক্যাচ লুফে নেন সৌম্য।
দলীয় ১৯২ রানের মাথায় ম্যাথু ওয়েডকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে গর্জন তোলেন সাকিব। এর রেশ কাটতে না কাটতেই অ্যাস্টন অ্যাগারের ফিরতি ক্যাচ নিয়ে বাংলাদেশকে চালকের আসনে নিয়ে যান তাইজুল।
অ্যাগার ফিরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর লাঞ্চের বিরতিতে যায় দুই দল। বিরতি থেকে ফিরে প্রথম বলে অস্ট্রেলিয়া শিবিরে হানা দেন সাকিব। বিরতির পর সাকিবের করা প্রথম বলেই বোল্ড হয়ে ম্যাক্সওয়েল সাজঘরে ফিরলে আনন্দে মেতে ওঠে মিরপুরের হোম অব ক্রিকেট।
নবম উইকেটে নাথান লায়ন ও প্যাট কামিন্স কিছুটা চিন্তায় ফেলে দেন বাংলাদেশকে। এসময় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন অধিনায়ক মুশফিক। তাইজুলকে সরিয়ে আক্রমণে আনেন মিরাজকে। প্রতিদান দিতে সময় নেননি তিনি। মিরাজের অফ-ব্রেকে স্লিপে সৌম্য সরকারের দুর্দান্ত ক্যাচের শিকার হয়ে লায়ন ফিরে গেলে বাংলাদেশের জয়ের জন্য দরকার পড়ে ১ উইকেটের।
চার-ছক্কায় বাংলাদেশকে ভড়কে দিয়েছিলেন প্যাট কামিন্স। তবে আস্থা হারায়নি বাংলাদেশ। চিন্তা না বাড়তেই ফের বোলিং আক্রমণে পরিবর্তন আনেন মুশফিক। আর তাতেই সফলতা পান টাইগার দলনায়ক। তাইজুলের করা ৭১তম ওভারের পঞ্চম বলে হ্যাজলউড লেগ বিফোরের ফাঁদে উল্লাসে মেতে ওঠেন সাকিব-মুশফিকরা। সেইসঙ্গে মিরপুর স্টেডিয়ামের হাজার হাজার দর্শক এবং টিভি পর্দায় কোটি কোটি দর্শক।
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের করা ২৬০ রানের জবাবে ইংল্যান্ড গুটিয়ে যায় ২১৭ রানে। মঙ্গলবার ১ উইকেটে ৪৫ রান নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ ২২১ রানে গুটিয়ে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৭৮ রানের ইনিংস খেলেন তামিম ইকবাল। এছাড়া মুশফিক ৪১, মেহেদী হাসান মিরাজ ২৬ এবং সাব্বির রহমান করেন ২২ রান।
অস্ট্রেলিয়ার সফলতম বোলার নাথান লায়ন। ৮২ রানে ৬ উইকেট নেন তিনি। এছাড়া অ্যাস্টন অ্যাগার দুটি ও প্যাট কামিন্স নেন একটি উইকেট। দুই ম্যাচ সিরিজের শেষ টেস্ট খেলতে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া ঢাকা ছেড়ে যাবে চট্টগ্রামে। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর শুরু হবে সিরিজের শেষ টেস্ট।