আরবি ভাষা শিখতে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন জুলিয়া
জাকারিয়া হারুন: কখনও কখনও খুব সহজ সরল ঘটনা বদলে দেয় মানুষের ভাগ্য ও জীবনের মোড়। মার্কিন নও-মুসলিম জুলির জীবনই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ২৩ বছর বয়সী জুলি একটি কোম্পানির পক্ষ থেকে এক আরব কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের দায়িত্ব পেয়ে আরবি ভাষা শিখতে বাধ্য হন।
এ প্রসঙ্গে জুলি বলেন, ‘ওই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বুঝলাম যে আমাদের সঙ্গে ওই কোম্পানির পুরো চুক্তিনামাই অবশ্যই আরবি ভাষায় লিখতে হবে। আমি আরবি জানতাম না বলে ওই চুক্তিপত্রের বক্তব্য বা শর্তগুলো সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তাই বিদেশি ভাষা শেখার একটি প্রতিষ্ঠানে আরবি ভাষার কোর্সে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।’
জুলি আরবি ভাষা শেখার জন্য যাকে শিক্ষিকা হিসেবে পেয়েছিলেন তার আচার-আচরণ, দয়া ও আন্তরিকতা জুলিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। হানিয়া নামের এই শিক্ষিকাও জুলির মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও উৎসাহ দেখতে পেয়ে তাকে শুধু আরবি ভাষাই শেখাতেন না, পাশাপাশি ইসলামের পরিচয়ও জুলির কাছে তুলে ধরার জন্য আরবি ভাষায় লেখা কিছু বই তাকে পড়তে দিয়েছিলেন।
হানিয়া সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘আমার শিক্ষিকা মিসেস হানিয়া খুব সুন্দরভাবে দরকারি বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতেন ও শেখাতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী মহিলা। তিনি অন্য বিষয়েও আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যা আমার জীবনের জন্য খুব উপকারী হয়েছিল। আরবি ভাষা শেখার পাশাপাশি আমি এই ভাষায় লেখা ইসলাম সম্পর্কিত অনেক বই পড়েছিলাম ও অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছিলাম। পড়াশোনার সময় আমি বেশ অর্থনৈতিক সমস্যার শিকার হয়েছিলাম এবং আমার নিজ পরিবার থেকেও দূরে ছিলাম। আমি পড়াশোনা করতাম আমেরিকার পূর্ব উপকূলে। আর আমার পরিবার থাকত পশ্চিম উপকূলে। তাই খুবই একাকিত্ব অনুভব করতাম। আর এই অনুভূতি আমার পড়াশোনা ও আমার কাজের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলত।’
জুলির শিক্ষক মিসেস হানিয়া তার ছাত্রীর একাকিত্ব ও উদ্বেগের বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে সহায়তার চেষ্টা করতেন। জুলিকে সাহায্যের জন্য হানিয়া তাকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করতেন যাতে তার মনে জমে থাকা হতাশা ও দুশ্চিন্তার কালো মেঘগুলো কেটে যায়। হানিয়া ইসলামের শিক্ষাগুলো যত বেশি সম্ভব তুলে ধরতেন জুলির কাছে যাতে একদিকে তার সমস্যারও সমাধান হয় এবং ইসলাম সম্পর্কেও তার জ্ঞান বাড়তে থাকে।
জুলির ভাষায় ‘মিসেস হানিয়া আমার দুঃখ ও চিন্তাগুলো বুঝতে পেরে আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তিনি আমার সমস্যাগুলোর কথা শুনে সান্ত্বনা দিতেন এবং তার সমবেদনাগুলো ছিল খুবই হৃদয়গ্রাহী।
তিনি আমাকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দিতেন ও বলতেন, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন। হতাশা মানুষের কর্ম-উদ্যম কেড়ে নেয় এবং থামিয়ে দেয় তার অগ্রগতি। আর মানুষ যদি আল্লাহ ও তাঁর সাহায্যের প্রতি বিশ্বাসী হয় তাহলে বিজয় তার ঘটবেই।’
মিসেস হানিয়া বলতেন, মহান আল্লাহর ওপর ভরসা সংকট বা সমস্যাগুলোকেও কাটিয়ে দেয়। আল্লাহর ওপর ভরসা করলে তিনি তোমার সব দুঃখ-বেদনাগুলো দূর করে দেবেন।’
মার্কিন নও-মুসলিম জুলিয়া আরো বলেন, ‘হানিয়া মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক নিয়ে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করার বা নির্ভরশীলতার সুফল সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু বলেছেন। আমি আধ্যাত্মিকতার জগত থেকে অনেক দূরে ছিলাম বলে হানিয়া যা বলতেন সে সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। প্রথম প্রথম বিশ্বাস হতো না যে এ ধরনের কোনো শক্তি বিশ্বে রয়েছে। কিন্তু তার কথাগুলো শুনে হৃদয়ের গভীরে যেন নতুন অনুভূতি জেগে উঠত। আর এই অনুভূতি বাস্তবতা মেনে নিতে আমাকে উৎসাহ যোগাত। হানিয়ার হৃদয়-জুড়ানো কথাগুলো শুনে হৃদয় প্রশান্ত হতো। অবশ্য এর আগেও কোনো কোনো বই বা প্রবন্ধে মানুষের জন্য এক আল্লাহর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছু বক্তব্য শুনেছিলাম। কিন্তু তখনও এইসব কথা বিশ্বাস করতাম না।’
এভাবে জীবনের কঠিন সময় বা দুঃসময় জুলিকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য উৎসাহি করেছিল। তিনি যখন বুঝলেন যে দয়াময় আল্লাহ বান্দার কথা শোনেন ও তাদেরকে বোঝেন, তখন আল্লাহর সাহায্য চাইলেন ও নিজেকে আল্লাহর ওপর সোপর্দ করলেন।
এরপর জুলি দেখলেন যে তিনি বিস্ময়কর প্রশান্তি অনুভব করছেন। ফলে তিনি হানিয়ার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে আরো বেশি জানতে আগ্রহী হলেন।
নিজের অনুভূতি তুলে ধরে জুলি বলেন, ‘আমি বেশ উপকারী তথ্য পেলাম। খুব ভালোভাবে অনুভব করলাম ইসলাম মানুষকে যোগায় আশা, আনন্দ ও উদ্দীপনা এবং জীবনে যোগায় কল্যাণ। ইসলাম মানুষের জীবনের ব্যাপক বিস্তৃত ও বিচিত্রময় চাহিদাগুলোও জুগিয়ে থাকে। আমি ইসলামে মানুষের অস্তিত্বের বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে এটা বুঝতে পেরেছি যে, এই মহান ধর্ম মানুষকে বস্তুর ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মিক মর্যাদা দেয়।’
ইসলাম মানুষকে যে মর্যাদা দিয়েছে তা বহু অমুসলিমকে এই মহান ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের সত্যিকারের মর্যাদা হল তার আধ্যাত্মিক মর্যাদা অর্থ-সম্পদ বা জাগতিক পদ-মর্যাদা নয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে সেই বেশি মর্যাদাশীল যে বেশি খোদাভীরু। আধ্যাত্মিক ও আত্মিক সৌন্দর্য মানুষকে দেয় উচ্চতর মানুষের সম্মান।
মার্কিন নও-মুসলিম জুলিকে অন্য যে বিষয়টি গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে তা হল জীবনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব। আল্লাহ বা স্রষ্টা আছেন এবং তিনি সব সময় মানুষের আচরণ লক্ষ্য করছেন এই বিশ্বাস মানুষের আচার-আচরণকে প্রভাবিত করে। সৎ কাজের পুরস্কার ও মন্দ কাজের শাস্তি রয়েছে- এই বিশ্বাস মানুষকে আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে। আর এই বাস্তবতা বা মহাসত্যটি জুলিকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। তিনি এই সত্যের ছোঁয়ায় খুঁজে পেয়েছেন জীবনের অর্থ। শেষ পর্যন্ত তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও উপাস্য হচ্ছেন এক আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সা. তাঁর মনোনীত রাসূল- এই সাক্ষ্য দিয়ে আমি মুসলমান হয়েছি। মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, তিনি এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন যে তার মধ্য দিয়ে আমি আলোর পথ খুঁজে পেয়েছি। অতীতের অন্ধকার জীবনের সঙ্গে তুলনা করে আমি বুঝতে পারছি যে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস বা ঈমান মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই মুসলমান হওয়ার পরের ও আগের জীবনের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারছি।’
নও-মুসলিম জুলি আরো বলেন, ‘মিসেস হানিয়াসহ যেসব মুসলমান আমাকে জ্ঞানের স্বচ্ছ ঝর্ণাধারার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার বিষয়টিও আমি শিখেছি ইসলামের কাছ থেকেই। কারণ, ইসলাম কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রতি ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন, ‘যদি শোকর কর তাহলে আমি তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত বাড়িয়ে দেব।’ আর কেউ যদি আল্লাহর নেয়ামতগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায় তাহলে আল্লাহ যেসব বিষয় নিষেধ করেছেন সেসব থেকে দূরে থাকতে হবে। মহান আল্লাহর সহায়তায় তাঁর সৎ বান্দাদের সাহচর্যের ফলে আমি সচেতনতা অর্জন করেছি। এখন প্রতিটি দিনই আমার জীবন গতকালের জীবনের চেয়ে উন্নত হচ্ছে। আমার আত্মা যেন প্রশান্তি ও পবিত্রতা অর্জন করেছে এবং আমি যেন ভিন্ন এক জগতে এসেছি যেখানে রয়েছে আলো, আশা আর ভালোবাসার বন্যা। আর নতুন এ জগতেই আমি জীবন যাপন করছি।’ -আই আর আইবি