আত্মঘাতী আমেরিকার জন্য শোক ও ভয়
ফারুক ওয়াসিফ: আমেরিকাকে বোঝা বড়ই কঠিন। এক বছরের মধ্যে ২৭৩তম এবং এক মাসের মধ্যে ২৯তম গুলিবাজির ঘটনায় মারা গেল ৫৯ জন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত মারণাস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ নয় বরং আরও বেড়ে গেল। এই অস্ত্র-গুলি পাখি শিকারের জন্য নয়, মানুষ হত্যার জন্য বানানো হয়েছে। হত্যার অস্ত্র বাঁচানোর উপায় হয় না, তা তাদের কে বোঝাবে? দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি দেশে হামলা করা যুক্তরাষ্ট্র, দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বন্দুকবাজির মৃত্যুরও দেশ। এত অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস—যার বেশির ভাগের সঙ্গেই আইএস বা আল-কায়েদার সম্পর্ক নেই, তা থেকে আমেরিকাকে কে বাঁচাবে?
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছয়টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং দুটি অমুসলিম (ভেনেজুয়েলা ও উত্তর কোরিয়া) দেশের নাগরিকদের আমেরিকা ভ্রমণ নিষিদ্ধ করতে পারেন, কিন্তু ৪২টি বন্দুক ও হাজারো গুলি নিয়ে খুনি স্টিফেন প্যাডক লাস ভেগাসের হোটেলের ৩২তলা পর্যন্ত উঠে গেলেন, কিন্তু কেউ সন্দেহ করল না, ঠেকাল না! সেই ২০০১ সালের ৯/১১-এর ঘটনার পর জারি করা জরুরি অবস্থা নবায়ন করে গেলেন নতুন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা; কিন্তু নিজ দেশের বন্দুকবাজদের গণখুনের উৎসব ঠেকাতে কিছুই করলেন না। এই দেশের প্রেসিডেন্টরা কখনো ইরাক কখনো উত্তর কোরিয়া, কখনো কমিউনিস্ট, কখনো ইসলামপন্থীদের ‘সভ্যতার শত্রু’ ‘আওয়ার ওয়ে অব লাইফের’ শত্রু বলে দাগালেও গড়পড়তা মার্কিনদের বন্দুকমত্ত গণবিধ্বংসী ‘ওয়ে অব লাইফে’ কোনো ‘প্রবলেম’ দেখতে রাজি নন। এই দেশ ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করে কিন্তু নিজ দেশের নাগরিকদের অস্ত্র ব্যবসার বলি করা থেকে বাঁচাতে কিছুই করে না। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সশস্ত্র নাগরিকের দেশ আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি বন্দুকবাজির খুন হয়, আত্মহত্যা করে সবচেয়ে বেশি মানুষ। তবু বদলায় না অবাধে ব্যক্তিগত অস্ত্র বিক্রির মারাত্মক আইন।
ঘরে ঘরে আগ্নেয়াস্ত্র রাখা তাদের নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অংশ। প্রতি ১০০ জনে ৮৮ জনের কাছে মারণাস্ত্র আছে। ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২৯৩ দিনই কোথাও না কোথাও গুলিতে হত্যা হয়। কোনো কিশোর বা বয়স্ক কোনো স্কুলে, কোনো কনসার্টে কিংবা কোনো স্টেশনে নির্বিচার গুলি করে মানুষ মারে। পরে দোষ দেওয়া হয় তার মানসিক অসুস্থতার; গণহারে অস্ত্র বিক্রির আইনের দোষ দেখা হয় না। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা লাস ভেগাসের মতো এ রকমই এক গণমৃত্যুর ঘটনায় কাঁদতে কাঁদতে ওই আইন বাতিলের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু যে আমেরিকায় জীবনের চাইতে অন্ধ ব্যক্তিস্বাধীনতা বড়, অস্ত্র কোম্পানির নোংরা হাত বড়, সেই আমেরিকার ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সিনেটরদের বড় অংশই সংবিধান সংশোধনে বিমুখ থাকল।
খুনি হিসেব অভিযুক্ত ব্যক্তিটি মারা গেছেন। কীভাবে, তা এখনো জানা যায়নি। (ইতিমধ্যে বিতর্কিত ওয়েবসাইট সাইট ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার রিতা কার্টজ বলেছেন, আইএস নাকি তাঁর কাছে এ ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত তা অস্বীকার করেছে।) স্টিফেন প্যাডক মুসলিম হলে বা ইসলামের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক বের করা গেলে, আওয়াজ অন্য রকম বেরোত। মুসলিম নামগন্ধ আছে, এমন কেউ ঘাতক হলে হয় ‘জঙ্গি’, দায় নিতে হয় তার সম্প্রদায়কেও। কিন্তু অন্য কেউ জড়িত হলে তাকে বলা হয় নিঃসঙ্গ নেকড়ে (Lone Wolf)। হত্যার পর ঘাতকের পরিচয় মুছে তাকে ‘নেকড়ে’ বা ‘পাগল’ বানিয়ে দেওয়ারও রাজনীতি আছে বৈকি! কিন্তু একের পর এক ‘নেকড়ে’র আবির্ভাব আমাদের ভাবায়, কেন আমেরিকানদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা ও আত্মহত্যা এমন ভয়ানকভাবে বাড়ছে? সমাজ মনস্তত্ত্বে কী অসুখ দানা বেঁধেছে?
আমেরিকার ভেতর সবচেয়ে বেশি গণবিধ্বংসী হাতিয়ার সন্ত্রাসবাদী তথা মুসলিম সন্ত্রাসীরা বহন করছে না, তা বহন করছে আদি ও অকৃত্রিম মার্কিন জীবনধারায় আসক্ত বন্দুকধারীরা এবং এদের বড় অংশই শ্বেতাঙ্গ। ওয়েস্টার্ন ছবির সেই নায়ক বন্দুকবাজদের হাতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, মুসলিম বা শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান সন্ত্রাসবাদ এখন অবধি ততটা ক্ষতি করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তরের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসী ঘটনায় (টুইন টাওয়ারে নিহত ২ হাজার ৯৯৬ জনসহ) মারা গেছে ৩ হাজার ৪১২ জন। আর ওই সময়ে বন্দুকধারীদের আক্রমণ, আত্মহত্যা ও দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৯৫ জন। অন্য আরেক হিসাবে ২০১৫-এর আগের দশকে সন্ত্রাসী ঘটনায় (টুইন টাওয়ার হামলা বাদে) মারা গেছে মাত্র ২৪ জন, আর বন্দুকধারীদের হামলায় মারা গেছে ২ লাখ ৮০ হাজার ২৪ জন! প্রতিবছর ওই দেশে লক্ষাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান এই সত্য মানতে নারাজ। অস্ত্র যখন স্বাধীনতার অংশ, অস্ত্র যখন মতাদর্শ, তখন মানুষ বহুভাবেই আত্মঘাতী হয়; বন্দুকবাজির আত্মহত্যা এবং খুন তারই অংশ। গত ২০ বছরে বন্দুকবাজির ঘটনা যত বাড়ছে, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষের জনমত তত দুর্বল হয়েছে বলে জানিয়েছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক সাম্প্রতিক জরিপ। অথচ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ব্রিটেন বেসামরিক অস্ত্র মালিকানা নিয়ন্ত্রণের পর দেখতে পেল, গানশুটিং তথা গুলিবাজির ঘটনা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এই শিক্ষা আমেরিকা নেবে না। তারা শান্তির জন্য যুদ্ধ করবে আর ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বার্থে নাগরিকদের কাছে অস্ত্র বিক্রি চালিয়ে যাবে। স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভো জিজেক বলেছেন, আমেরিকানরা যে ব্যক্তিস্বাধীনতার পূজারি, এসব বন্দুকবাজির খুন তারই খেসারত।
আত্মঘাতী আমেরিকার জন্য দুঃখ, শোক ও ভয় হয়। ভয়, কারণ আমেরিকার সংস্কৃতি ভয়ানক সংক্রামক। ফাস্টফুড আর ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে যদি বন্দুকবাজির সংস্কৃতিও আমাদের মতো দেশে ছড়িয়ে পড়ে?
পৃথিবীর যেখানেই অপঘাতে মানুষ মারা যায়, তা মানবতারই অপচয়। হোক তা রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গা কিংবা মূল্যবান আমেরিকার নাগরিক। মানুষের জন্য শোক মানে হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণা, অস্ত্র ব্যবসার প্রতি ঘৃণা, সহিংস মানসিকতার প্রতি ঘৃণা। তার অর্থ আরও আরও জীবনবাদী হওয়া, ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে আরও আরও মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু মানুষের প্রতি আমাদের ভালোবাসা যথেষ্ট নয়, যদি না অমানবিকতাকে ঘৃণা করি। অথচ ভিডিও গেম থেকে শুরু করে হলিউডি চলচ্চিত্রের প্রধান বিষয় যুদ্ধ, মানুষের রক্তই সেসব রঙিন চলচ্চিত্রের বিনোদন এবং আমরাও সেসবের ভক্ত ও ভোক্তা। বিনোদনের রক্ত আসলে রং, কিন্তু তার মানসিকতাটি সহিংস, সেই সহিংসতা বাস্তবের মাটিতে যে খুন ছড়ায় তার রক্ত কিন্তু সত্যিকার মানুষের।
লাস ভেগাসের গণমৃত্যুর পর অস্ত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়া থেকে মনে পড়ল, রোহিঙ্গা গণহত্যা চলার সময় মিয়ানমারের কাছে চীন ও ইসরায়েলের অস্ত্র বিক্রিও বেড়ে গিয়েছিল! যত যুদ্ধ, যত সহিংসতা, তত ব্যবসা। অস্ত্র ব্যবসার এই কুযুক্তির কাছে মানুষ মরে গেলে মানবতার মৃত্যু হয়, এই যুক্তি কি হেরে যাবে?
-ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।