সিলেটের অর্থনীতিতে শুরু হয়েছে নতুন দিনের পদযাত্রা
শুয়াইব হাসান: আজ শনিবার সিলেটে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী এনআরবি গ্লোবাল বিজনেস কনভেনশন-২০১৭। বিশ্বের ২৬ দেশের প্রায় দুই হাজার এনআরবি (অনাবাসী বাংলাদেশি) এই সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন। প্রবাসীদের এই মিলনমেলার মধ্য দিয়ে সিলেটের অর্থনীতিতে নতুন দিনের পদযাত্রা শুরু হবে-এমনটা আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার বিকেলে সিলেটের আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে জাতীয় সংগীত ও পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সম্মেলন। ২৬ দেশের এনআরবি প্রতিনিধিরা নিজ নিজ দেশের পতাকা নিয়ে পরিচিত হবেন এই সম্মেলনে।
প্রথম দিন থেকেই প্রবাসী বিনিয়োগের সম্ভাব্য খাত, সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবে। বিশেষ করে আইসিটি, পর্যটন, সিরামিজ শিল্প, টেক্সটাইল, ফিশারিজ, তাঁত ও হস্তশিল্প, রাবার, আগর-আতর, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহকে গুরুত্ব দিয়ে পৃথক আলোচনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সম্মেলনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, ফুড ফ্যাস্টিভেলসহ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা রয়েছে পুরো আয়োজনে।
সম্মেলনের আয়োজক ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, সহযোগিতায় রয়েছে দি সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে ব্রিটিশ-বাংলাদেশ চেম্বারের প্রেসিডেন্ট এনাম আলী এমবিই বলেন, আমরা প্রবাসে থাকি, মন থাকে জন্মভূমি বাংলাদেশে। এদেশের বাড়িঘর, অনেক ব্যবসাও রয়েছে। কিন্তু, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান নাগরিক। তারা পূর্ব পুরুষের পরিচয় ভুলে যাচ্ছে, তারা এদেশে বিনিয়োগেও অনীহা দেখাচ্ছে।
এ অবস্থায় নতুন প্রজন্মকে দেশের সংস্কৃতি, পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করে দেয়ার পাশাপাশি এদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে এই উদ্যোগ বলে জানান তিনি।
সিলেট চেম্বারের সভাপতি খন্দকার সিপার আহমদ বলেন, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অনেক নাগরিক বিশ্বে স্বনামে খ্যাত। তাদের অবদান যেমন বিশ্বে ছড়িয়ে আছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও রয়েছে। জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখেন প্রবাসীরা।
কিন্তু, প্রবাসীদের পরবর্তী প্রজন্ম যেভাবে দেশের থেকে বিমুখ হচ্ছে, সে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে চেম্বার সভাপতি বলেন, তারাও যেন এদেশকে ভালোবাসে, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে সে বিষয়টি মাথায় রেখে এ আয়োজন।
সিলেটের প্রবাসীরা দেশে লাভজনক কোনো খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না; বরং, প্রবাসী বিনিয়োগের প্রায় ৭০ ভাগ অর্থ বাড়িঘর নির্মাণে ব্যয় হয়। এ বিষয়ের পর্যালোচনায় প্রবাসী ব্যবসায়ী নেতা ও বিশ্লেষকরা এতদিন বলে আসছেন সিলেটে বিনিয়োগের তেমন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।
তবে, সম্প্রতি সরকারের বিনিয়োগবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এখন সিলেটসহ সারা দেশে এখন বিনিয়োগের বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর সে সুযোগ কাজে লাগাতে এই এনআরবি সম্মেলন।
সরকারের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার নীতিমালায় সিলেটে একটি বিশেষ অথনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে সিলেটের মৌলভীবাজারের শেরপুরে। মন্ত্রিপরিষদের ৬৩ তম সভায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (সংশোধন) আইন-২০১৫ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল’ নামে শেরপুরে ৩৫২ একর জমির উপর অবস্থিত অর্থনীতির এই নতুন সম্ভাবনার পূর্বদিকে রয়েছে সিলেট, পশ্চিমে হবিগঞ্জ, উত্তরে সুনামগঞ্জ ও দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা। ইতোমধ্যে সেখানে দেশিয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জমি বরাদ্দ পেয়েছে। গড়ে উঠছে বড় বড় শিল্পকারখানা।
সিলেটের গোয়াইনঘাটের তামাবিল এলাকায় আরেকটি ইকোনমিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে। শিগগির এর কার্যক্রম শুরু হবে। এরফলে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যাবে।
এদিকে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ১৬২ দশমিক ৮৩ একর জায়গায় দেশের প্রথম ইলেকট্রনিক সিটি গড়ে তোলা হচ্ছে। হার্ডওয়্যার পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে গড়ে তোলা এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০১৮ সালে শেষ হবে। এর ফলে সিলেট হয়ে উঠছে ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম প্রবেশদ্বার।
এ ব্যাপারে তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমদ পলক গণমাধ্যমকে বলেছেন, হার্ডওয়্যার শিল্পের বিকাশ ঘটাতে সিলেটে ইলেকট্রনিক সিটি গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এখানে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
এ ব্যাপারে সিলেট চেম্বারের সভাপতি খন্দকার সিপার আহমদ বলেন, আমাদের মেধাবীরা আইটি খাতে বিভিন্ন দেশে দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। তাদের অনেকের সফলতার গল্প আমরা শুনতে পাই। সিলেট ইলেকট্রনিক সিটি গড়ে তোলা হলে এরকম দক্ষ ও বিচক্ষণ গবেষণা, চর্চা ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা শিক্ষা শাখার সহযোগী অধ্যাপক ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সল বলেন, সিলেটে ব্যবসায় বিনিয়োগের সম্ভাবনা অনেক। আমরা গবেষণা করে দেখেছি, বিদেশে বসবাসরত সিলেটিরা যে-পরিমাণ অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে পাঠায় তার বেশিরভাগই বাসাবাড়ি নির্মাণে। প্রবাসীরা সম্ভাব্য লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে এখানে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে পারেন।
পাথর সমৃদ্ধ এই অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেমন নির্মাণ ব্যয় কম, তেমনি শ্রম মূল্যও দেশের যে কোনো অঞ্চলের তুলনায় অনেক কম। কেবল প্রয়োজন হতে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি। জায়গাজমিও পর্যাপ্ত আছে।
আগর-আতর. আইটি, সিরামিক, টেক্সটাইল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, ফিশারিজ, বেত শিল্প, তাত ও হস্তশিল্প, রাবার, কুঠির শিল্প, হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম সেক্টর, কৃষিখাতসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে এখানে। এর বাইরেও বিনিয়োগ করার মতো অনেক খাত সৃষ্টি হতে পারে সিলেট অঞ্চলে।
প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের প্রবাসীরা দেশে এসে বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার হন, এ বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে, এখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি খন্দকার সিপার আহমদ বলেন, বাসাবাড়ি নির্মাণ করে প্রবাসীরা কেয়ারটেকারের কাছে রেখে চলে যান। অনেক সময় নিজ আত্মীয় বা কেয়ারটেকার সেটি জালিয়াতি করে দখলে নিয়ে নেয়। তবে, এখন সে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। প্রশাসন এখন প্রবাসীদের ব্যাপারে বেশ আন্তরিক এবং পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, আমরা দেশের নাগরিক ও প্রবাসী সকলের নিরাপত্তা চাই। অলাভজনক খাতে বিনিয়োগ না করে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করলে নিজেরা লাভবান হবেন এবং দেশও উপকৃত হবে।
এছাড়া বর্তমান সময়ে ট্যুরিজম বেশ গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে চেম্বার সভাপতি বলেন, সিলেট ট্যুরিজমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ট্যুরিজমকে কেন্দ্র করে যারা হোটেল-মোটেল ইতোমধ্যে করেছেন তারা এখন বেশ লাভবান।
নিরাপত্তা নিয়ে শংকার বিষয়ে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। নিজ বসতবাড়ি ছেড়ে সুদূর প্রবাসে পাড়ি দিয়েছেন এই অঞ্চলের অসংখ্য নাগরিক। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় দখলসহ বিভিন্ন জটিলতা বেড়েই চলছে। তাই, প্রবাসীরা দেশে এসে বিভিন্ন রকমের হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন।
প্রবাসীদের সমস্যার দ্রুত সমাধানে সিলেট জেলা পুলিশ একটি প্রবাসী কল্যাণ সেল গঠন করেছে। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে সেলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে দু‘দিন প্রবাসীদের অভিযোগ ও সমস্যার মীমাংসাপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এতে হয়রানি কমে আসছে, প্রবাসীরা এখন দেশে আগের থেকে অনেক বেশি নিরাপদ।
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এনআরবিরা দেশে প্রথমবারের মতো জড়ো হচ্ছেন সিলেটে। এ আয়োজনের ফলে সিলেট কতটা লাভবান হবে সেটি এখন দেখার অপেক্ষা।