সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বিয়নীবাজারের ছয় জনের দাফন সম্পন্ন
মঙ্গলবার সকাল ১০টা। লোকে লোকারণ্য বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস মাঠ। শোকাহত হাজারো মানুষ একনজর নিহতদের দেখতে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলছেন। শোকাহত স্বজনদের বিলাপ দেখে অশ্রুসজল অনেকেই জানান, কিভাবে এই শোক সইবে তারা। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে কোনো কোনো পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। জানাজার নামাজ শেষে নিহতদের পৃথকভাবে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ সময় জানাজায় উপস্থিত হাজারো মানুষের চোখ ছলছল করছিল।
গত সোমবার সকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাধবদী উপজেলার কান্দাইলে নিহত বিয়ানীবাজার পৌরশহরের একাধিক ব্যবসায়ী জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকেছেন। কিশোর বয়সে অন্যের দোকানের কর্মচারী হয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করা রেজাউল করিম এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি রূপসী ফ্যাশন নামক বিপণি বিতানের মালিক। তার মা আম্বিয়া বেগম বিলাপ করে বলেন, আমি শুঁটকি পছন্দ করি বলে রেজাউল আমার জন্য শুঁটকি কিনেছে। উখিয়া থেকে অনেক জাতের শুঁটকি কিনে রোববার রাতে ফোন দিয়ে বলে ‘মা তুমি খুশি তো, আমি শুধু শুঁটকি কিনেছি। আমরা একটু পর গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হবো-’ এই বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আম্বিয়া বেগম। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমার বুকের ধন এখন কই- তারে এনে দাও। আমি শুঁটকি চাই না। আমার কিচ্ছু লাগতো নায়, শুধু রেজাউলরে চাই-’।
এদিকে নিহত ব্যবসায়ী খায়রুল বাশার খান খয়েরের বাড়িতেও বইছে শোকের মাতম। শিগগিরই পারিবারিকভাবে তার যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা। পিতার আবেদনের প্রেক্ষিতে সমস্ত কাগজপত্র ঠিক হয়ে গেছে। অথচ মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে এখন তিনি না ফেরার দেশের বাসিন্দা। খয়েরের দুই পুত্র বাবার জন্য কাঁদছে। স্বজনরা অবুঝ দুই শিশুকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেরাই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
নিহত ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেনের মা সুফিয়া বেগম বিলাপ করে বলেন, ‘আমারে কইয়া (বলে) গেছে সোমবারে আইবো (আসবে)। এখন কেনে আমার পুয়া (ছেলে) আয় না। অসহায় মানুষরে সাহায্য করতে গিয়া আমার পুয়া মরলো কেনে গো। ইতা (এটা) আল্লাহর কী রকম বিচার গো। উপজেলার শেওলা ইউনিয়নের কাকরদিয়া গ্রামে তার বাড়ি।
একই অবস্থা বিরাজ করছে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অপর তিন জনের। তাদের মৃত্যুতে পুরো উপজেলা জুড়ে বইছে শোক। শোকগ্রস্ত পরিবার-পরিজনের সঙ্গে বিয়ানীবাজারের আকাশও যেন কাঁদছে। পৌরশহরের কসবা গ্রামে গাড়িচালক বাবুল আহমদের বাড়ি। তার সহায় সম্বল কিছু নেই। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম চৌধুরী তার পরিবারের সদস্যদের হাতে ২০ হাজার টাকার একটি চেক তুলে দিয়েছেন। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তার পরিবারকে চলতে হবে বলে জানান স্থানীয় ফজলুল হক। একই গ্রামের অপর যুবক রোটার্যাক্ট বাবুল আহমদ সৌদি আরব ও রাশিয়া থেকে শূন্য হাতে ফিরেছেন। বহু শখ ছিল তার ইউরোপ যাত্রার। কিন্তু সে পরপারে পাড়ি দিলো।
মানবতার ডাকে সাড়া দিতে গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য শীতবস্ত্র নিয়ে কক্সবাজার রওয়ানা হন বিয়ানীবাজারের ৮ তরুণ ব্যবসায়ীর একটি দল। একটি মাইক্রোযোগে (ঢাকা-মেট্রো-১৬-০২৫২) বিয়ানীবাজার থেকে যাত্রা করে চট্টগ্রাম হয়ে শনিবার কক্সবাজার পৌঁছায়। চট্টগ্রামের টেকনাফ ও কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর সহযোাগিতায় তারা শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।
রোববার রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে বিয়ানীবাজারের উদ্দেশে যাত্রা করে তরুণ ব্যবসায়ীদের বহনকারী মাইক্রো। নরসিংদীর মাধবদী থানার কান্দাইল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সকাল ৭টায় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যান পাঁচ তরুণ ব্যবসায়ী ও মাইক্রোচালক।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন ব্যবসায়ী দলের হাফিজুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন। নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে তারা এখন সুস্থ আছেন। ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান বলেন, বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাস ওভারটেক করতে গিয়ে আমাদের গাড়িকে চাপা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। বাসের ডানে ও মধ্যখানে থাকা আমাদের সহকর্মী ব্যবসায়ীরা নিহত হয়েছেন। বেঁচে যাওয়া দুইজনের শরীর ও মাথায় জখম রয়েছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান খান বলেন, আমরা সবাই মারা যাবো। কিন্তু এ রকম মৃত্যু কাম্য হতে পারে না। এতোগুলো তরুণ প্রাণ মুহূর্তের মধ্যে ঝরে পড়লো। পৌর মেয়র আব্দুস শুকুর বলেন, কিছু মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। নিহত ব্যবসায়ীদের মৃত্যু সেরকম।