গৃহহীনের সংখ্যা বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে
ষাটোর্ধ্ব স্ট্যানলি টিমিং ও তার বান্ধবী লিন্ডা গেটলিন- দুজনের স্বল্প আয়ে কোনো রকমে এক কক্ষের এক বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। বাসাটি ছিল তাদের এক বন্ধুর। কষ্টেশিষ্টে হলেও তাদের দিন কাটছিল। কিন্তু গত বসন্তে তাদের সেই বন্ধু কোলন ক্যান্সারে মারা যান। এদিকে, বাড়তি পয়সা খরচ করে অন্য বাসা ভাড়া করার সামর্থ্যও তাদের নেই। উপায় না পেয়ে তল্পিতল্পাসহ তারা বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের বন্দর ও বাণিজ্যিক শহর সিয়াটেলের রাস্তায়। তাদের গচ্ছিত সঞ্চয়ের মধ্যে ব্যবহৃত ‘রিক্রিয়েশনাল ভেহিকল’ (যাতে শোবার ঘর, রান্না, টয়লেটসহ নানা রকম সুবিধা থাকে) কেনা ও এতে নিবন্ধন বাবদ ৬০০ মার্কিন ডলার ব্যয় করেন এবং বাকি ২৭৫ ডলার ব্যয় করেন ব্যবহৃত কার কিনতে।
‘স্যান রোজ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের’ প্রভাষক অ্যালেন তারা জেমস-প্যানির বাড়ি ‘পুরাতন একটি ভলভো’ কার। সেখানেই তিনি তার শিক্ষার্থীদের কীভাবে পড়াবেন তার পরিকল্পনা তৈরি করেন, পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করেন। রাত হলে ঘুমিয়ে পড়েন গাড়ির বাইরে। তিনি বলেন, ‘আমি মূলত ২০০৭ সাল থেকে গৃহহীন। আমি এখন সত্যিই ক্লান্ত।’
টিমিং ও অ্যালেনের মতো এখন এমন হাজারো মার্কিনি এভাবেই রাত কাটায়। তারা সবাই কোনো না কোনো পেশার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বাসস্থানের জন্য যে পরিমাণ অর্থের যোগান প্রয়োজন, তা মেটাতে তারা অক্ষম। শুনতে অবাক লাগলেও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশটির মোট জিডিপি ১৮.৫৫৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও দেড় লক্ষাধিক মানুষ এখন গৃহহীন। দিনে দিনে এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের নির্বাহী শাখার মন্ত্রিসভার ‘ডিপার্টমেন্ট অব হাউজিং অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট’ বছরের শুরুর দিকে একটি গণনা করে। গণনা অনুসারে, ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগন ও ওয়াশিংটনে এক লাখ ৬৮ হাজার মানুষের বাড়ি নেই। একই বছর আশ্রয়হীন, অর্থাৎ যারা বাস কিংবা রেলস্টেশন, পরিত্যক্ত ভবন বা পরিবহনে ঘুমায়, তাদের সংখ্যা ১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার জনে।
এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিই এই গৃহহীনতার পরিমাণকে বাড়িয়ে তুলেছে। নিউইয়র্ক শহরের মেট্রো এলাকার চেয়ে সান ফ্রানসিসকো উপকূলীয় এলাকায় মাঝারি মানের এক কক্ষবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া বেশি। বাড়ি ভাড়া বাবদ ম্যানহাটনের চেয়েও এখানে বেশি ব্যয় করতে হয়।
২০১৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন, ওরেগন ও হুনুলুলু রাজ্যের কমপক্ষে ১০টি শহর বা পৌর এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। সেখানে গৃহহীনতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার বেড়ে গিয়েছিল। আর সান ডিয়াগোতে আশ্রয়হীন-গৃহহীন মানুষের সংখ্যা গত বছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে, পশ্চিম উপকূলে নতুন করে গৃহহারা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ নিয়ে রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান ‘জিলো’র অর্থ সহায়তায় এক গবেষণা চালায় ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন এ গবেষণায় দেখা যায়, বাড়ি ভাড়া বাড়ার সঙ্গে গৃহহীনতার সংখ্যা বৃদ্ধির একটা যোগসূত্র রয়েছে। গবেষক দলের প্রধান দাবি করেন লস অ্যাঞ্জেলসে পাঁচ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বাড়ার মানে দাঁড়াচ্ছে দুই হাজার মানুষ নতুন করে গৃহহীন হওয়া।
এই সংকট মোকাবেলায় সরকার ও অলাভজনক কিছু প্রতিষ্ঠান ভূমিকা পালন করছে। তারা ভবঘুরে মানুষদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করছে। অনেক পশ্চিম উপকূলের শহরও এমন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অংশে গৃহহীনতার এই স্রোত বেড়েই চলেছে। তা ছাড়া পশ্চিম উপকূলের আশ্রয় সেবা খুবই সীমিত।
সিয়াটলের গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করে এমন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ডিইএসসি’র গৃহায়ন প্রকল্প পরিচালক মার্গারেট কিং জানিয়েছেন, ‘যদি তোমার আয় বছরে ৯ হাজার মার্কিন ডলার হয়, তাহলে তুমি সিয়াটলে একটা স্টুডিও ভাড়া করতে পারো। এর জন্য তোমাকে ব্যয় করতে হবে এক হাজার ৮০০ ডলার, যা তোমার আয়ের দ্বিগুণ। ফলে যারা কম আয়ের, তারা ভাড়া বৃদ্ধির কারণে গৃহহীন হচ্ছে। আবার স্টুডিওর ভাড়া মেটানোর সক্ষমতা না থাকায় সেখানেও আশ্রয় নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন এবং বাধ্য হচ্ছেন রাস্তায় নামতে। তাই ভাড়া বাড়ায় নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরা গৃহহীন হচ্ছে, একই সঙ্গে গৃহহীন তরুণের সংখ্যাও বাড়ছে। -অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) অবলম্বনে হালিমা খুশি