ফিলিস্তিনীদের ভূমি দখলমুক্ত করতে ব্যর্থ জাতিসংঘ
১৯৬৭ সালে ছয়দিনের যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা দখল করে ইসরাইল। নিয়ন্ত্রণে নেয় সিনাই উপকূল, পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গোলান হাইটস। আজকের বাস্তবতা হলো সিনাই উপকূলীয় অঞ্চল বাদে বাকি এলাকাগুলো ইসরায়েলের দখলে। সেবছর ২২ নবেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রেজ্যুলেশন ২৪২ নামে একটি প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবে দখলিকৃত এলাকাগুলো থেকে ইসরাইলী সশস্ত্র বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, ‘মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সবার কাজ করতে হবে। ‘যুদ্ধ এড়িয়ে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় সেই প্রস্তাবে। প্রথমদিকে এই প্রস্তাবের ব্যাপারে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতা সংঘ-পিএলও ছিল সমালোচনামুখর। সংগঠনটির মত ছিল, ফিলিস্তিনীদের শরণার্থী হিসেবে দেখা হয়েছে ওই প্রস্তাবে। নিশ্চিত করা হয়নি তাদের জাতীয় অধিকার। সবগুলো দলই এই প্রস্তাব মেনে নিলেও পিএলও এই প্রস্তাব মানতে সময় নেয় ২০ বছর। আজ তারও ৩০ বছর পার হয়েছে। রেজ্যুলেশন ২৪২ এর ৫০ বছর পর ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। তুলে এনেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
রামাল্লার লেখক ও মানবাধিকার কর্মী মরিয়ম বাঘুতি বলেন, জাতিসংঘের এই আইনটি আসলে ইসরাইলের নীতিকে কোণঠাসা করার একটি নীতি। এটা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য করা হলেও সেটা শুধু ইতিহাস। ইসরাইল তার সহিংসতা চালিয়েই যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের কোনও কার্যকরী ববস্থা নেওয়া ছাড়াই এই আইনটি শুধুমাত্র আদর্শের কথা বলে গেছে। ফলে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। তারা কখনোই এটা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে না। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফিলিস্তিনার দখলের শিকার হচ্ছে।’ এই মানবাধিকার কর্মী জানান, এই প্রস্তাবনায় মূলত আরব দেশগুলো থেকে ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন নেওয়া হয়েছে। এর উপনিবেশিকতা, আগ্রাসন ও শান্তি ব্যহত করার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। রাজনীতি বিশ্লেষক ডায়না বুতু বলেন, এই প্রস্তাবনাটি ব্যর্থ হয়েছে এবং ইসরায়েলের দখলদারিত্বের পথ সুগম করেছে। ১৯৪৮ সালের আগে এবং ১৯৬৭ সালের পরে এই আইনের মাধ্যমেই বিস্তার ঘটিয়েছে ইসরায়েল। দেশভাগের সময় তাদের যে পরিমাণ জমি বরাদ্দ করা হয়েছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি দখল করেছে তারা। রেজুলশন ২৪২ এর মাধ্যমেই এই দখলের অনুমতি পেয়ে যায় তারা। ফিলিস্তিনী মধ্যস্থতকারীদের সাবেক এই আইনজীবী জানান, ‘কেউ কেউ বলেন যে এই প্রস্তাবটি পশ্চিমতীর ও গাজা সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এটা আসলে তার চেয় অনেক বেশি। ইসরায়েল যত জমি দখল করেছে তাদের পুরোটাই এই প্রস্তাবের অংশ।’ তিনি বলেন, ‘আপনি যদি দেশভাগের সময়টা মনে করতে পারেন তাহলে বুঝবেন এটা খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো এবং অবৈধ ছিলো। ফিলিস্তিনের ৫৫ শতাংশই ইসরায়েলকে দিয়ে দেওয়া হয়। আর সময়ের সাথে সাথে ইসরায়েল দখল করে ৭৮ শতাংশ। গাজার অধ্যাপক হায়দার ঈদ বলেন, ‘রেজুলেশ্যন ২৪২ যখন প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন সেটা অন্যরকম ছিলো। এর উদ্দেশ্য ছিলো আরব বিশ্বে ইসরায়েলকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া। এই প্রস্তাবনায় অনেক বড় কিছু ত্রুটি ছিলো। ফিলিস্তিনী নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি। এখানে দখলকারীদের দখল সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনও জমির কথা উল্লেখ করেনি। আর এটা দখলকারীদের কোনরুপ শাস্তির কথাও উল্লেখ করেনি।’ তাই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় এই আইনকে ভিত্তি করে কোনও আলোচনা করা যায় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। রামাল্লাহর সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক মোহাম্মদ দারাগমেহ বলেন, ‘এই রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে ইসরায়েলকে দখলের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এই আইনে কোনও আন্তর্জাতিক সীমারেখা বা ফিলিস্তিনী সীমান্তের কথা উল্লেখ ছিলো না। এখন এসব বিষয় পাল্টানোও সম্ভব নয়। কারণ ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনে ৭ লাখ ৫০ হাজার অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই-এর সাম্প্রতিক এক খবর থেকে জানা গেছে, ফিলিস্তিনিদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদে নতুন কৌশল নিয়েছে ইসরায়েল। এতোদিন তারা বিভিন্ন বসতির কয়েকটি বাড়ি বা স্থাপনা উচ্ছেদের চেষ্টা করত। এতে তাদের খুব বেশি লাভ হতো না। কারণ এসব উচ্ছেদের জন্য আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেত। তাই এখন উন্নয়ন পরিকল্পনার অজুহাতে বিভিন্ন স্থানে পুরো গ্রাম বা এলাকা দখলের কৌশল নিয়েছে তারা। এখনও ফিলিস্তিনী এলাকাগুলোতে নিজেদের সীমান্ত গড়ে তুলছে ইসরায়েল। আর বাস্তুহারা হচ্ছেন ফিলিস্তিনীরা। তাদের জমি দখল করে বাড়ি, ফ্যাক্টরি ও ফার্ম বানাচ্ছে ইসরায়েল। অতীতের ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ভ্রুক্ষেপই করছে না তারা।
আরেক মধ্যপ্রাচ্য পর্যবেক্ষণভিত্তিক মাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর ফিলিস্তিনের পরিসংখ্যান সংস্থাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, চলতি বছরেও ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ১৪ জন ফিলিস্তিনী শিশু নিহত হয়েছে। মিডল ইস্ট মনিটরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিস্তিনী কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থার এক বিবৃতিতে এই সংখ্যা তুলে ধরে। তারা জানায়, ২০১৬ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে খুন হন ৩৫ জন শিশু। বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে করা এই পরিসংখ্যানে তারা আরও জানায়, ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি রয়েছে ৩০০ জন শিশু। ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ৪ হাজার শিশুকে আটক করেছিলো ইসরায়েল। তাদের বেশিরভাগকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনে ঘরহীন হয়ে পড়েছে ৮৪৮ জন শিশু। সংস্থটির মতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪১৮টি বাড়ি ধ্বংস করেছে ইসরায়েল। আর ২০১৬ সালে এর সংখ্যা ছিলো ৬৪৬। এই পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে এখনও কোনও মন্তব্য করেনি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। ২০ নবেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয়। এই দিবসকে সামনে রেখে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। পশ্চিমতীরে বসবাস করা ৪৫ লাখ ফিলিস্তিনির মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশেই শিশু। বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত ৫০ বছরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাবনাটি ইসরায়েলের ফিলিস্তিনী দখলের বিষয়ে সহায়তা করেছে। এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরব এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রভাষক ঘাদা কার্মি বলেন, আসল ঘটনা হলো ইসরায়েল কখনোই রেজ্যুলেশন ২৪২ মেনে চলার চেষ্টা করেনি।’ তিনি বলেন, ফিলিস্তিনি এলাকায় ঔপিনেবিশকতা চালানোতে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইসরায়েল কখনোই নিরাপত্তা পরিষদের ওই প্রস্তাবনা মানতে চায়নি।
অন্যদিকে চলতি বছর ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ১৪ জন ফিলিস্তিনী শিশু নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের পরিসংখ্যান সংস্থার। সোমবার মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদ পর্যবেক্ষণের ব্রিটিশ সংস্থা মিডলি ইস্ট মনিটরের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিস্তিনী সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস এক বিবৃতিতে এই সংখ্যা তুলে ধরে। তারা জানায়, ২০১৬ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে খুন হন ৩৫ জন শিশু। বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে করা এই পরিসংখ্যানে তারা আরও জানায়, ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি রয়েছে ৩০০ জন শিশু। ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় ৪ হাজার শিশুকে আটক করেছিলো ইসরায়েল। তাদের বেশিরভাগকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনে ঘরহীন হয়ে পড়েছে ৮৪৮ জন শিশু। সংস্থটির মতে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪১৮টি বাড়ি ধ্বংস করেছে ইসরায়েল। আর ২০১৬ সালে এর সংখ্যা ছিলো ৬৪৬। এই পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে এখনও কোনও মন্তব্য করেনি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস পালন করা হয়। এই দিবসকে সামনে রেখে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। পশ্চিমতীরে বসবাস করা ৪৫ লাখ ফিলিস্তিনির মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশেই শিশু।