বসনিয়ার কসাই ম্লাদিচের যাবজ্জীবন
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার পূর্বাঞ্চলীয় ছোট পার্বত্য শহর স্রেব্রেনিৎসায় চালানো গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত সাবেক বসনিয়ান সার্ব কমান্ডার রাতকো ম্লাদিচ বিচারের রায়ে দোষি সাব্যস্ত হয়েছেন।
ইউরোপের সাবেক রাষ্ট্র যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ তদন্তে গঠিত জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনাল গতকাল বুধবার স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার রায় ঘোষণা করে বলে জানিয়েছে বার্তা রয়টার্স, বিবিসি ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ের ওই ঘটনায় অন্তত ৮ হাজার নিরস্ত্র মুসলিম পুরুষ ও বালককে হত্যা করা হয়েছিল, ম্লাদিচ ওই হত্যাকান্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের অভিযোগ। ‘বসনিয়ার কসাই’ খ্যাত ম্লাদিচের বিচারের রায়ের মাধ্যমে বিশেষ এই ট্রাইব্যুনাল যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কাজ শেষ হলো। এটাই ট্রাইব্যুনালের শেষ রায়ছিলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সংঘটিত সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার দায়ে ৭৪ বছর বয়সী ম্লাদিচের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের দাবি করেছেন বাদী পক্ষের কৌঁসুলিরা। ম্লাদিচের বিরুদ্ধে মোট ১১টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পাশাপাশি সারায়েভো অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগও আছে।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সার্ব বাহিনী সারায়েভো অবরোধ করে রেখেছিল। তাদের নিক্ষেপ করা গোলা ও স্লাইপারদের গুলিতে প্রায় ১১ হাজার বেসামরিকের মৃত্যু হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
ম্লাদিচ সব অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেকে নিন্দোষ দাবি করেছেন। গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত হলে তিনি আপিল করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। বসনিয়া যুদ্ধের সময় জাতিসংঘ সার্বিয়ার সীমান্তের কাছে অবস্থিত স্রেব্রেনিৎসাকে ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ডাচ সদস্যরা এলাকাটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল।
১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই ম্লাদিচের বাহিনীর আচমকা আক্রমণে হতবিহ্বল ডাচ শান্তিরক্ষীরা আত্মসমর্পণ করে।
সার্ব বাহিনী এরপর শহরটির পুরুষ ও বালকদের নারীদের কাছ থেকে আলাদা করে। পুরুষদের বাসে করে সরিয়ে নিয়ে কিংবা দূরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
পরদিন ব্রোঞ্জের বর্ম পরা ম্লাদিচ স্রেব্রেনিৎসার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ক্যামেরার সামনে তিনি শিশুদের মাঝে চকোলেট ও মিষ্টি বিলি করেন বলে জানান স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যায় ছেলে ও স্বামী হারানো মুনিরা সুবাসিচ।
“ক্যামেরার সামনে তিনি (ম্লাদিচ) বলছিলেন কিছুই হবে না এবং আমাদের ভয় পাওয়ারও কারণ নেই।
“ক্যামেরা চলে যাওয়ার পর তিনি তার সৈন্যদের যাকে যাকে হত্যা করা যায় তাদেরকে হত্যা করতে, যাকে যাকে ধর্ষণ করা যায় তাদেরকে ধর্ষণ করার নিন্দেশ দেন। সবশেষে আমাদের বলেন স্রেব্রেনিৎসায় থেকে পালিয়ে যেতে, যেন তিনি সেখানে ‘জাতিগতভাবে শুদ্ধ’ একটি শহর প্রতিষ্ঠা করতে পারেন,”বলেন মুনিরা।
ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর মিসিং পারসনের (আইসিএমপি) কর্মীরা পরে স্রেব্রেনিৎসার গণকবর থেকে মুনিরার ছেলে নারমিন ও স্বামী হিলমোর দেহাবশেষ উদ্ধার করে। গণকবরগুলোতে পাওয়া দেহাবশেষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে প্রায় ৭ হাজার নিহতের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয় বলে রয়টার্স জানিয়েছে।
ম্লাদিচের আইনজীবিদের ভাষ্য, সার্ব বাহিনী ও তার মিত্রদের গণহত্যা এবং বেসামরিকদের ওপর ‘জাতিগত নির্মূল অভিযানে’ ম্লাদিচের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ মেলে নি, যে কারণে অভিযুক্ত হলেও তাকে ১৫ বছরের বেশি কারাদন্ড দেয়ার সুযোগ নেই।
গণহত্যার দায়ে ম্লাদিচের বিচার চললেও যুগোস্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিম-ক্রোয়াটদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দ্রুতগতিতে সার্বদের হয়ে বসনিয়ার ৭০ শতাংশ দখলে নেওয়ায় এখনো অনেকের চোখেই তিনি ‘নায়ক’।
মুসলমান নিয়ন্ত্রিত বসনিয়ার সরকারি বাহিনীর ঘাঁটি হওয়ায় সারায়েভো সার্ব বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল এবং এ কারণেই শহরটি দীর্ঘদিন ধরে অবরোধ করে রাখতে হয়েছিল বলে জানান ম্লাদিচের আইনজীবিরা।
সার্ব বাহিনী যখন স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যা চালায় তখন ম্লাদিচ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না এবং পরে ঘটনা শুনে মর্মাহত হন বলেও দাবি তাদের।
ম্লাদিচের ছেলে ডার্কো রয়টার্সকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল তার বাবাকে ছেড়ে দেবে বলেই তিনি প্রত্যাশা করছেন।
“বিচারে তার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলেছে বলে আমরা দেখি নি। এখন আমরা তার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন।”
বেশ কয়েকদফা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যায় আক্রান্ত ম্লাদিচের স্বাস্থ্যের কারণেই বিচার দীর্ঘায়িত হয় বলে রয়টার্স জানিয়েছে। একই কারণ দেখিয়ে সাবেক এ সার্ব কমান্ডারের আইনজীবীরা শেষ মুহুর্তে রায় মুলতু্বি রাখারও আবেদন জানিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা তাতে সাড়া দেননি।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ম্লাদিচ যদি হত্যাকান্ডের সরাসরি নিন্দেশ নাও দিয়ে থাকেন তাও অধস্তনদের কৃতকর্মের দায় তার ওপর বর্তায়।
এর আগে যুগোস্লাভিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটিওয়াই) ম্লাদিচের চার অধস্তনকে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাবজ্জীবন দিয়েছিল।
বসনিয়ার সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ ও সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসেভিচের সঙ্গে মিলে ম্লাদিচ বসনিয়া থেকে মুসলমানদের সরিয়ে ‘বৃহত্তর সার্বিয়া’ প্রতিষ্ঠা করতে স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিকল্পনা করেন বলেও ভাষ্য তদন্ত কর্মকর্তাদের।
“(ম্লাদিচের) যাবজ্জীবন ছাড়া অন্য যে কোনো রায়ই হবে নিহতদের জন্য অপমান, ন্যায় বিচারের জন্য অপমান,” আদালতে বলেন তদন্ত কর্মকর্তা অ্যালান তিয়েগার।
গণহত্যার পর ১৯৯৫ সালে কারাদজিচের সঙ্গেই অভিযুক্ত হন ম্লাদিচ; ২০১১ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারদজিচকে ২০১৬ সালে ৪০ বছরের কারাদন্ড দেয় আইসিটিওয়াই।
আর নিজেকে নিন্দোষ দাবি করা মিলোসেভিচ ২০০৬ সালে বিচার চলাকালে জেলের মধ্যেই মারা যান।
বসনিয়া যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আইসিটিওয়াই বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো ও কসোভোর ১৬১ জনের বিচার করেছে। এর মধ্যে ৮৩ জনই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই জাতিগতভাবে সার্ব।