বিশ্বজুড়ে ‘হালাল’ ব্যবসায় আগ্রহী হচ্ছেন উদ্যোক্তারা
লম্বা হাতাযুক্ত মুসলিম নারীদের জন্য বিশেষ ধরনের ‘বিনয়ী’ পোশাকের জন্য করিম তুরে যখন তার প্রথম অর্ডার উপস্থাপন করেন, তখন উৎপাদনকারীরা তা উৎপাদনের জন্য তার কাছে আগাম পেমেন্ট দাবি করেন। দৃশ্যত তাদের ধারণা ছিল- তার এই উদ্যোগটি ব্যর্থ হবে এবং তুরে তাদের অর্থ পরিশোধ করতে সক্ষম হবেন না।
কিন্তু তুর্কি এই উদ্যোক্তা দ্রুত প্রমাণ করেন যে তাদের সন্দেহ ভিত্তিহীন ছিল এবং পরবর্তীতে তিনি খুব শিগগিরই নতুন একটি অর্ডার নিতে ফিরে আসেন এবং প্রথমবারের মতো বিক্রি শুরু করেন।
বিনয়ী পোশাক ‘মোদানিসা’ বিক্রি করার জন্য করিম তুরের প্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইটে বছরে ১০০ মিলিয়ন ভিজিটর ভিজিট করে থাকে। ১২০টিরও বেশি দেশে তার গ্রাহক রয়েছে এবং এটি উৎপাদন করার জন্য এখন আর উৎপাদনকারীদের কোনো ঘাটতি নেই।
কোম্পানির একজন মুখপাত্র আল জাজিরাকে বলেন, ‘মোদানিসা’র এখন প্রায় ৩০০ জন সরবরাহকারী এবং ৩০ জন ডিজাইনার রয়েছে। এটি এখন বিশ্বজুড়ে শত শত সরবরাহকারীর জন্য একটি প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে; যারা আমাদের সাইটে তাদের পণ্য বিক্রি করতে চায়।’
তবে, তুরের গল্প কেবল একটি কোম্পানি এবং তার নিজস্ব আর্থিক সাফল্যের গল্প নয়।
২০১১ সালে তুরে এই বিনীয় পোশাকের প্রবর্তন করেন। এটি প্রবর্তনে তার উদ্দেশ্য ছিল যেসব মুসলিম মহিলারা ‘বিনয়ী’ ইসলামি পোশাকে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে চান পরতে চান, তাদেরকে পছন্দ মতো পোশাক বেছে নেয়ার আরো সুযোগ তৈরি করে দেয়া।
গত মে মাসে বুলগেরিয়ায় একটি ট্রেড অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় তুরে বলেছিলেন, ‘তারা (মুসলিম নারীরা) আরো একটু বেশি ঢেকে রাখতে চেয়েছিলো, তবে দুনিয়া তাদের উপেক্ষা করেছিল এবং তাদেরকে একই পুরানো বিরক্তিকর পোশাক পরতে বাধ্য করেছিল।’
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমরা ভাবলাম এটা অন্যায় ছিল। বস্ত্র আপনার শরীরে পরিধান করা ফ্যাব্রিকের চেয়েও বেশি কিছু, এটা আপনার অভিব্যক্তি এবং আপনার পরিচয়ের অংশের চেয়েও বেশি কিছু, এটা অন্যায়।’
মোদানিসা হচ্ছে বৈচিত্রময় এবং বিস্তৃত ‘হালাল’ সেক্টরের একটি ছোট্ট অংশ। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মধ্যে এর বিক্রি ৩.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
আরবি ভাষায় ‘হালাল’ অর্থ কেবল ‘অনুমোদনযোগ্য’। শব্দটি যে কোনো পণ্য বা পরিষেবাতে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যা ইসলামিক আইন ও সামাজিক নিয়ম লঙ্ঘন করে না।
হালাল শিল্পের মূল পার্থক্য হচ্ছে- এতে ইসলামিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এমন বিষয়ে এড়িয়ে চলা হয়। মুসলিম ভোক্তাদের প্রয়োজনীয়তা মিটানোর একটি সচেতন প্রচেষ্টা হিসেবে এটি করা হয়ে থাকে।
হালাল শব্দটির সঙ্গে জড়িত শিল্পগুলোর মধ্য ভিন্নতা রয়েছে। যেমন ব্যাংকগুলো তাদের পরিষেবায় সুদকে এড়িয়ে চলে। হালাল খাতের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য প্রধান শিল্পগুলো খাদ্য, পোশাক এবং পর্যটন শিল্প।
হালাল পণ্য বা সেবা গ্রহণের এই প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয় পশ্চিমা দেশগুলোর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। যেমন- যুক্তরাজ্যে ‘কেএফসি’ এবং ‘সাবওয়ে’র মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডসমূহ হালাল মেনুর অফার করে থাকে।
এইচ এন্ড এম, মার্কস এবং স্পেন্সারের মতো পোশাকের দোকানগুলোতে মুসলিম নারীদের জন্য বিশেষ ধরনের পোশাক বিক্রি করে থাকে। সুপারমার্কেটগুলোতে হালাল ফুড সেক্টর এবং মূলধারার ব্যাংকগুলো ইসলামিক ফাইন্যান্স পণ্য প্রস্তাব করে থাকে।
কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জামাল আহমেদ ব্যাখ্যা করেন যে ‘হালাল’ পণ্য গ্রহণের বিষয়টি ইসলামিক রীতিনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ‘একাডেমিক গবেষণায় ধারাবাহিকভাবে রিপোর্ট করা হয়ে থাকে যে সাধারণত সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে মুসলমানরা তাদের পরিচয় সম্পর্কে অধিকতর দৃঢ়।’
তিনি আরো বলেন, ‘হালাল পণ্য গ্রহণ, হতে পারে তা খাদ্য, বস্ত্র, ভ্রমণ বা ইসলামি অর্থনীতি ইত্যাদি মুসলমানদেরকে তাদের পরিচয়ের একটি ধারনা দেয়। পাশাপশি স্থিতিশীলতা এবং চিন্তার স্বাধীনতার একটি ধারণাও প্রদান করে।’
যাইহোক, ভোক্তা পর্যায়ে এটিকে মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার পরিপূর্ণতা বা তাদের পরিচয়ের অংশ হিসেবে দেখে থাকে। অন্যদিকে, সরকার এটিকে আর্থিক বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা হিসেবে দেখে থাকে।
জাপান ও তুরস্কের সাম্প্রতিক হালাল ব্যবসার প্রদর্শনী ওইসব দেশের সরকারের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।
২০১৩ সালে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন লন্ডনকে ‘ইসলামিক অর্থনীতির’ একটি বড় বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন এবং ইসলামিক আইন অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের প্রথম সরকারি বন্ডের বিষয়টি ঘোষণা করেন। প্রথম অসমুলিম রাষ্ট্র হিসেবে এটি ঘোষণা করা হয়।
ব্রাজিলের মুসলমানরা দেশটির ২০৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র ২ লাখের কিছু বেশি। তারপরেও দেশটি হালাল গরুর মাংসের একটি প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। ২০১৫ সালে দেশটি ৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের হালাল পণ্য রপ্তানি করেছে।
একইভাবে, নিউজিল্যান্ডে মুসলমানদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও দেশটি হালাল মাংসের অন্যতম একটি প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। তারা বছরে প্রায় ৫৭৬ মিলিয়ন ডলারের হালাল পণ্য বিক্রয় করে থাকে।
সমসাময়িক ধর্মের একজন গবেষক আবদুল আজিম আহমেদ আল জাজিরাকে বলেন, হালাল সেক্টর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বিকল্প প্রবেশাধিকার প্রদান করলেও সেখানে ভোক্তাদের পছন্দের নামে মুসলিম নীতিসমূহকে ক্ষতিগ্রস্থ করার ঝুঁকি রয়েছে।
আহমেদ ব্যাখ্যা করেন যে হালাল উৎপাদনের ভোক্তাদের দিকে অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করা হলেও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ইসলামি নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি হারিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘হালাল মাংসের বৃহত্তর অ্যাক্সেসিবিলিটি নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক খাদ্যের মধ্যে একটি ভাল জিনিস। তবে সেখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে আর তা হলো ইসলামিক নীতিমালা অনুযায়ী প্রাণীদের জবাই করা হচ্ছে কিনা?’