ফররুখ তার মুসলিম ঐতিহ্য এবং সনেট
ড. গুলশান আরা: চল্লিশের দশকে কলকাতায় যে ক’জন শক্তিমান কবির আর্বিভাব ঘটে ফররুখ আহমদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর কাব্য প্রতিভা শুধু কলকাতায় নয় পরবর্তীতে এদেশেও বিপুল খ্যাতি ও দীপ্তি লাভ করে।
ফখরুখ আহমদ যখন কাব্যযাত্রা শুরু করেন তখন তাঁর সম্মুখে প্রায় একশো বছরের একটি দীর্ঘ সাহিত্য ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। আধুনিক বাংলা কবিতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণুদে পর্যস্ত বহু বন্ধুর ভাঙাগড়ার পথ। ফররুখ এদের সবার কাছ থেকে পরিগ্রহণ করলেন বটে, কিন্তু কোথাও ধরা দিলেন না, বাঁধা পরলেন না। তাঁর প্রিয়তম কবি মদুসূদন যাঁর কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করলেন নূতন নূতন রূপকল্পের পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিল্প স্বভাব, কিন্তু শব্দে, বাক্যে মাইকেলের সরাসরি প্রভাব ফররুখ আহমদের কাব্যে অকল্পনীয়। এমন যে নজরুল যাঁর কাছ থেকে তিনি নিলেন ইসলামী বিষয়ের শিল্প রূপায়নের সাহস, কিন্তুু নজরুলের ফুলকী ওড়াভাষা বা প্রবল আবেগে সব ভাসিয়ে নেবার প্রবণতা ফররুখে নেই। বরং মুসলিম ঐতিহ্য, তাহজীব ও তমদ্দুনের অনুপ্রেরণাকে প্রাণ-দীপ্ত করে তুলতে স্বীয় প্রতিভাকে নিয়োগ করেন। সাহিত্য জীবনের প্রথম থেকেই একটি স্বতন্ত্র কাব্য বিশ্বাসকে অন্তরে ধারণ করে অগ্রসর হন। তাই ফররুখীয় কবিতার অন্তরাত্মা একান্তই তাঁর নিজের জিনিস।
ফররুখ আহমদের উত্থানও এই তিরিশের দশকের শেষ দিকে। প্রারম্ভিকে ফররুখ ছিলেন আবেগ ও রোমান্টিকতায় উদ্বেল। উত্তাল। ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মন্বত্তর ১৯৪৫ সালে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার পটভূমিতে কবিতা লিখেছেন, যা পঠিত আকাশবাণীতে।
কিন্তু এর পরপরই লেখার ধারা আমূল পরিবর্তিত হয়ে যায় ফররুখের। তিনি হয়ে ওঠেন ইসলামের পুনরুজ্জীবনবাদী কবি। জীবন ব্যাপী কাব্যে সাধনায় ফররুখ কেবলমাত্র ইসলাম ও মুসলমানের পুনরুজ্জীবনের ধ্বজাবাহী।
ফররুখ আহমদ এই মুসলমানি ঢং নিয়ে গর্ববোধ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা আত্মঘাতির সমান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উর্দুকে যখন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা চলছিল তখন বিদ্রæপাত্মক কবিতা লিখেন কঠোর সমালোচনায়-
‘দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন
বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকেই করিয়াছি নিকা….
খাঁটি শরাফতি নিতে ধরিয়াছি যে অজানা বুলি
তার দাপটে চমকাবে এক সাথে বেয়ারা ও কুলি।’
নজরুল ও জীসমউদ্দীনের মতই ফররুখ ও মূলত মানবতাবাদী মানব প্রেমকি, শিশু মানবতাকে তিনি সরাসরি স্পর্শ করেছেন ইসলামের মধ্যদিয়ে।
সনেটের প্রতি ফররুখ এমন উন্মুখ ছিলেন যে ‘মুর্হূতের কবিতায়; তিনি একশো সনেট সংকলন করেছেন। এর কয়েকটি আবার সেনেট পরস্পরা। সাতত্রিশ বছরের কাব্য জীবনের রূপকল্পের ও ছন্দে ফররুখ আহমদ ছিলেন সতত ভ্রাম্যমান। তিনি মনে করতেন জীবনের উৎসরণ এবং কবিতার উৎসরণ অনি:শেষ। পুরাতনের মধ্য থেকেই উঠে আসে নূতন। বাংলা কবিতার পুরানো রূপকল্পের মধ্যদিয়েই ফররুখ আহমদ বিস্ময়কর নূতন কবিতার উৎসরণ ঘটিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও যে বিপুল প্রতিপত্তি এসবই তাঁর কবিতার ঐ প্রাণ সঞ্চারক নব অন্বেষী ভূমিকার জন্যই।
এত কিছুর পরও বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান অমর। বহু মনীষা তাঁর সম্পন্ধে মন্তব্য করেছেন তাঁর কাব্য মূল্য, কাব্য চেতনা নিয়ে। ড. আহমদ শরীফ-বাংলা প্রবন্ধের অন্যতম মনীষা। তিনি কবি ফররুখ আহমদ সম্বন্ধে অত্যন্ত মূল্যবান মন্তব্য করেছেন, তিনি বলেছেন- “আমাদের বাংলা ভাষায় স্বকীয় আর্দশে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, আদর্শ হবে কোরআনের শিক্ষা, আবার হবে মুসলমানি ঐতিহ্যানুগ আর বিষয় হবে ব্যক্তি বা সমাজ অথবা বৃহদার্থে জগৎ ও জীবন। এভাবে আমাদের জাতীয় জীবন ও জাতীয় সাহিত্য গড়ে উঠবে। সাম্প্রতিক সাহিত্যে তরুণ কবি ফররুখ আহমদ একান্তভাবে মুসলিম পরিপ্রেক্ষিতে কাব্যে সাধনা করে পথের দিশারীর গৌরব অর্জন করেছেন।”