‘হিন্দুত্বে’র লড়াইয়ে মুসলমানরা কোনঠাসা

Indian Muslimভারতে গুজরাটের আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির ‘কট্টর হিন্দুত্ব’ আর কংগ্রেসের এবারকার ‘নরম হিন্দুত্বে’র ঠেলায় রাজ্যের মুসলিম সমাজ একেবারেই কোণঠাসা। ভোটের আসরে তারা যেন একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
রাজ্যে পনেরো বছর আগে ভয়াবহ দাঙ্গার পর থেকেই ক্রমশ গুজরাটের মুসলিমরা আরও বেশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু এই ভোটের মরশুমে দুই প্রধান দলের দুরকম হিন্দুত্ব এজেন্ডায় তাদের কথা যেন সবাই ভুলতেই বসেছেন।
ভোটের ঠিক গুজরাটের প্রধান শহর আহমেদাবাদে সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিলাম, সে রাজ্যে মুসলিমরা এখন কেমন আছেন।
আহমেদাবাদের প্রাচীন ঘিঞ্জি এলাকার সরু রাস্তা দিয়ে পৌঁছতে হয় শহরের এক প্রান্তে বোম্বে সিটি এলাকায় দাঙ্গাকবলিত মুসলিম পরিবারগুলোর কলোনিতে, যাকে বস্তি বলাই ভাল।
পনেরো বছর আগে নারোদা পাটিয়াতে স্বামী-স্বজন হারানো রাশেদা বেগম বলছিলেন, ‘শহরের কোনও হিন্দু বস্তি দেখাতে পারবেন এত খারাপ অবস্থা? মুসলিমদের এরা ফেলে রেখেছে দূষণ আর আবর্জনার স্তূপের পাশে, স্কুল-হেলথ সেন্টার-রাস্তাঘাট বলে কিছুই নেই।’
আসলে এই গোটা কলোনিটাই একটা আবর্জনার বিশাল স্তূপের পাশে, যেখানে ফেলা হয় গোটা শহরের বর্জ্য। সেই দুর্গন্ধে আর দূষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন।
ছোট্ট এক চিলতে ঘর থেকে বেরিয়ে শরাফউদ্দিন বলছিলেন, ‘জানেন আমাদের এখানকার মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত হয় না, আর কেউ মেয়ে দিতেও চায় না। যদি কোনও বিয়েশাদি হয়ও বা, দুর্গন্ধে কেউ খেতে পর্যন্ত আসতে পারে না, আমাদের সব খাবার ফেলে দিতে হয়!’
২০০২-র দাঙ্গায় সর্বস্ব হারানো মুসলিম পরিবারগুলোর অবস্থা গোটা রাজ্য জুড়েই মোটামুটি এই রকমই – জানাচ্ছেন তাদের হয়ে বহু মামলা লড়া মানবাধিকার আইনজীবী, জনসংঘর্ষ মঞ্চের শামসাদ পাঠান।
তিনি বলছিলেন, ‘পনেরো বছর পরে এখনও এই এই দাঙ্গাপীড়িতরা রাজ্যের ছিয়াশিটা অস্থায়ী কলোনিতে দিন গুজরান করছেন – যেখানে পানি বা বিজলির মতো মৌলিক সুবিধাগুলো পর্যন্ত পৌঁছয়নি।’
তবু গুজরাটে গত তিনটে নির্বাচনে দেখা গেছে, অন্তত ভোটের মরশুম এলে রাজ্যের এই প্রান্তিক মুসলিমদের কথা মনে পড়ত বিরোধী কংগ্রেসের – যে দলটিকে রাজ্যের মুসলিমরা বহু বছর ধরে সমর্থন করে এসেছে।
কিন্তু এবারেই কংগ্রেসের নীতিতে দেখা যাচ্ছে বিরল ব্যতিক্রম।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী নিজেই গুজরাটে এক কর্মিসভায় সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, তিনি নিজে ও তার পরিবার হিন্দু দেবতা শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত।
তিনি যদিও দাবি করেছেন ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ নিয়ে বাইরে কথা বলা তার পছন্দ নয়, সেই সভার ভিডিও বাইরে এসেছে – এবং রাহুল গান্ধী যে পৈতে পরা ব্রাহ্মণ, কংগ্রেস সেটা মোটেও লুকোনোর চেষ্টা করছে না।
সোমনাথ থেকে শুরু করে একের পর এক মন্দির দর্শনে যাচ্ছেন তিনি, কিন্তু গত কয়েকদিনে গুজরাটের কোনও মসজিদে পা পড়েনি তার।
আর এ কারণেই বলা হচ্ছে, এই নির্বাচনে কংগ্রেসের নীতিই হল ‘সফট হিন্দুত্ব’!
গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সের বিভাগীয় প্রধান মুকেশ খটিকও বলছিলেন, ‘মুসলিম ভোট আকৃষ্ট করার জন্য আগে কংগ্রেস যেভাবে চেষ্টা করত, এবারে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। ফলে এবারের ভোটে মুসলিমরা যে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন, সেটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।’ মোটামুটি গুজরাটে মুসলিম জনসংখ্যা শতকরা দশ ভাগের মতো বলে ধরা হয়। সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট শামসাদ পাঠানের মতে, বিজেপির কাছে মুসলিমদের কোনও দিনই কোনও প্রত্যাশা ছিল না – কিন্তু কংগ্রেসই মুসলিমদের এবার অবাক করেছে।
আহমেদাবাদের অন্যতম আইকন সিদি সাঈদ জালি মসজিদের আজানের সুর ভেসে আসে – ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা জড়ো হন নামাজের জন্য। কিন্তু এই মসজিদের বিখ্যাত ‘জালি’ বা কারুকার্য শহরের বিজ্ঞাপন হতে পারে, কিন্তু গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন আসলে গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরেই চলছে বলে অনেকেরই অভিমত। -বিবিসি

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button