ইউনেস্কোর ঐতিহ্য তালিকায় এবার সিলেটের শীতলপাটি
সাদেকুর রহমান: প্রাণ জুড়ানো শীতল পাটির বিশ্ব জয় হয় বহু আগেই। এ পাটির রফতানি ইতিহাস অনেক পুরনো। বৃহত্তর সিলেটের যারা লন্ডনে বা অন্য দেশে থাকেন, কেবল তারাই নন-লোকঐতিহ্যপ্রেমী মানুষ মাত্রের কাছেই শীতলপাটির আদর-কদর কিংবন্তীর মতো। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক অধিসংস্থা ইউনেস্কোর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ) তালিকায় এবার ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সেই ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি। ইউনেস্কোর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণের জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিটি গতকাল বুধবার শীতলপাটির বয়নপদ্ধতির স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে বলে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর নিশ্চিত করেন।
মন্ত্রীর বক্তব্য সমর্থনে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী জানান, গতকাল বাংলাদেশ সময় ১টা ৩২ মিনিটে দক্ষিণ কোরিয়ায় ইউনেস্কোর দ্বাদশ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে সোমবার থেকে শুরু হয়েছে ওই কমিটির বৈঠক, চলবে শনিবার পর্যন্ত। কমিটির আলোচ্য সূচির মধ্যে অন্যতম ছিল ২০১৭ সালের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকা অনুমোদন। বাংলাদেশের শীতলপাটির বয়নশিল্পের সঙ্গে ১৯টি দেশের ১৫টি নৈর্ব্যক্তিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সদ্য অনুমোদিত তালিকায় স্থান পেয়েছে।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় জাতীয় জাদুঘর শীতলপাটির বয়নপদ্ধতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ‘ইন্টারগভার্নমেন্টাল কমিটি ফর দ্য সেফগার্ডিং অফ দ্য ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-শীর্ষক অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল।
আগের দিন সন্ধ্যায় জাতীয় জাদুঘরে শীতলপাটির এক বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে এসে সংস্কৃতিমন্ত্রী জানান, কমিটির চলতি অধিবেশনে স্বীকৃতির বিষয়টি ‘প্রায় নিশ্চিত’, এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
এর আগে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলার বাউল সঙ্গীত, ঐতিহ্যবাহী জামদানী বুনন পদ্ধতি ইউনেস্কোর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে।
বাংলাদেশের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন বাংলার শীতলপাটি। লোকশিল্পটি মুর্তা নামক গাছের বেতি থেকে বিশেষ বুনন কৌশলে শিল্পরূপ ধারণ করে। বৃহত্তর ঢাকা বিভাগ, বরিশাল ও চট্টগ্রামের কিছু অংশে এই বেত গাছ জন্মালেও শীতলপাটির বুননশিল্পীদের অধিকাংশের বসবাস সিলেট বিভাগে। বৃহত্তর সিলেটের ১০০ গ্রামের প্রায় ৪ হাজার পরিবার সরাসরি এই কারুশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে জাতীয় জাদুঘর এক সমীক্ষায় জানিয়েছে। সিলেটের শীতলপাটির এই বুননশিল্পীরা ‘পাটিয়াল’ বা ‘পাটিকর’ নামে পরিচিত।
শীতলপাটি নামের মধ্যেই রয়েছে এর গুণ। এই পাটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গরমে ঠান্ডা অনুভূত হয়। শীতলতার পাশাপাশি নানান নকশা, রং ও বুননকৌশল মুগ্ধ করে সবাইকে। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ার কারণে স্বাস্থ্যসম্মত এই পাটি। সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার শ্রীনাথপুর, আতাসন, গৌরীপুর, লোহামোড়া, হ্যারিশ্যাম, কমলপুর ইত্যাদি এলাকায় শীতলপাটি তৈরি হয়। এ ছাড়া নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ, পাবনায় কিছু কারিগরের দেখা মেলে। এসব শীতলপাটি বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন সিকি, আধুলি, টাকা, নয়নতারা, আসমান তারা ইত্যাদি। তবে সিকি, আধলি ও টাকা ব্যাপক পরিচিত।
পাটিগুলো সাধারণত ৭ ফুট বাই ৫ ফুট হয়ে থাকে। সিকি খুবই মসৃণ হয়। কথিত আছে, সিকির ওপর দিয়ে সাপ চলাচল করতে পারে না মসৃণতার কারণে। সিকি তৈরিতে সময় লাগে চার থেকে ছয় মাস। আধুলি মসৃণতা কম হয় এবং এর বুননে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। একটি আধুলি তৈরিতে সময় লাগে তিন থেকে চার মাস। টাকা জোড়া দেয়া শীতলপাটি দুই বা তার অধিক জোড়া থাকে টাকাতে। এগুলো অত্যন্ত মজবুত হয়। ২০ থেকে ২৫ বছরেও নতুন থাকে এই পাটিগুলো। এসব পাটির পাশাপাশি কিছু সাধারণ পাটি আছে, যা তৈরি করতে সময় লাগে এক থেকে দুই দিন। পাটির দাম নির্ভর করে সাধারণত বুননকৌশল ও নকশার ওপর। সর্বনিম্ন ২ থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে একেকটি পাটির দাম।
এদিকে, জাতীয় জাদুঘরের আয়োজনে নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে মঙ্গলবার শুরু হওয়া সিলেটের শীতলপাটির বিশেষ প্রদর্শনীটি চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। শনি থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকবে প্রদর্শনী, শুক্রবার খোলা থাকবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার জাতীয় জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ।
জাদুঘরের প্রদর্শনীতে যোগ দিতে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার রামতোলাপুর ও রামদুলিজুরা গ্রাম থেকে এসেছেন চার জন পাটিকর। তারা হলেন- রমাকান্ত দাশ, অজিত কুমার দাশ, অরুণ চন্দ্র দাশ ও আরতী রাণী দাশ। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পাটি বুননের কাজ করেন। তবে নারী পাটিকররা কাজে অধিকতর ভূমিকা রাখেন।
পুরুষশিল্পী মুর্তা সংগ্রহের পরে পরিবারের সদস্যরা তা পরিষ্কার করে সরু করে কেটে শুকানো, নখানি, দা দিয়ে সরু করে বেতি তোলা, রঙ করার জন্য জ্বাল দেয়া, পানিতে বা রোদে শুকানো প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বুনন উপযোগী করে তোলেন। মুর্তা গাছের বেতিকে বুননের উপযোগী করে তোলা থেকে শীতল পাটি বোনার প্রতিটি ধাপে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের হাতের ছোঁয়া থাকে। তাদের কাছে এ কাজটি ‘পারিবারিক শিল্প’ হিসেবেও স্বীকৃত।
রমাকান্ত দাশ জানান, ব্যবহারের উপর নির্ভর করে শীতল পাটি আকার-আকৃতি ও ডিজাইনের বৈচিত্র্য দেখা যায়। বুননের মাধ্যমে তারা শীতলপাটিতে ফুটিয়ে তোলেন পাখি, লতা, পাতা, ফুল বা প্রাকৃতিক নানা দৃশ্য। জ্যামিতিক নানা নকশায় কখনো নিজেদের ধর্মবিশ্বাস, পৌরাণিক কাহিনি, স্থানীয় লোকগাথার কবিতা কিংবা জাতীয় স্থাপত্যকেও শীতলপাটিতে ফুটিয়ে তুলেন তারা।
জাদুঘরের প্রদর্শনীতে ঠাঁই পাওয়া নকশাদার শীতলপাটি ‘আসমান তারা’, ‘কমলকোষ’, ‘জমিতারা’, ‘নমাঝি’-র দাম পড়বে ২ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকছেন তারা।
শীতলপাটির বয়ান পদ্ধতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাটিকরদের জীবনে কতটা পরিবর্তন আনবে, তা নিয়ে অবশ্য ওয়াকিবহাল নন রাজনগরের এই শিল্পীরা। অরুণ চন্দ্র দাশ বলেন, ওসব কি স্বীকৃতি না কি, ওসব তো আমরা বুঝি না। ওগুলো ওই বড়দের ব্যাপার স্যাপার। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ, পাটি বুনে আমাদের দিন চলে। এখনো এই একটি পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছি আমরা। আমাদের কতজনে পেশা ছেড়ে বা পেশায় থেকে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। কী করবে? পেট তো চলতে হবে নাকি? ওসব স্বীকৃতি পেলে বড় আনন্দের কথা। কিন্তু আমাদের ভাগ্য কি পাল্টাবে?”
আরতি রানী দাশ ও অজিত দাশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কিছুদিন আগেও রাজনগরের নানা গ্রামে প্রায় ১২০টি পরিবার শুধু শীতলপাটি বুনে সংসার চালাত। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে আনুপাতিক হারে কমে গেছে শীতলপাটির চাহিদা। তাই এখন শিল্পী পরিবারের পাশাপাশি বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি ধুঁকছে।